শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


বাড়ি ফিরছিলাম ট্যাক্সিতে। সাদার্ন অ্যাভেনিউর মহিলার ক্লিনিকে আমি গাড়ি নিয়ে যাই না। মনের চিকিৎসায় কি একটা কথা নিয়ে মন খুঁতখুঁত করবে। গাড়িতে চালাতে চালাতে অন্যমনস্ক হয়ে যাব। তারপর কেলেঙ্কারি।

হাসপাতালে ভর্তির পরের দিন দুপুরবেলায় আমায় ছেড়ে যাওয়া হল। সকালে এসে এই ডাক্তারনী বলছিলেন চটজলদি অ্যাম্বুলেন্স ডেকে উনিই ওঁর ক্লিনিক থেকে আমাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দেন। আমার মাকে উনি ফোন করে জানান যে আমার শরীরটা সামান্য খারাপ হয়েছে সে জন্য একদিন নার্সিংহোমে থাকতে হবে। চিন্তার কোন কারণ নেই পরের দিন আমি ছুটি পেয়ে যাব।

ভর্তির পর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত আমার বেশ কয়েকটা টেস্ট হয়েছে। কয়েকটা রিপোর্ট ম্যাডাম দেখেছেন। তাতে কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। খুব স্বাভাবিকভাবে আমার ব্লাড প্রেসার ব্লাড সুগার বেশি পাওয়া গিয়েছে। এই ব্যাপারে যে আমি একজন অন্য ডাক্তারবাবুকে দেখাই সেটা আমার মনের চিকিৎসককে আমি জানিয়েছিলাম। ইনি খুব মেটিকুলাস সেজন্য আমার মায়ের ফোন নম্বর সেই ডাক্তার বাবুর ফোন নাম্বার এ সবকিছুই তাঁর কম্পিউটারে ডেটা ব্যাংকে ছিল। তিনি জানালেন—

—এখন আপনি একদম ফিট দুপুরের পরে লাঞ্চ করে আপনার ছুটি। কোনও চিন্তার কারণ নেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন। ক’দিন লেখার চাপ একদম নেবেন না। হালকা মজার গল্পের বই পড়বেন টিভি দেখবেন। দেখতে ইচ্ছে হলে সিনেমা দেখবেন। চার দিন বাদে আপনি আমার ক্লিনিকে আসবেন।
আমার টিভি দেখার সময় রাত এগারোটার পর। খাওয়ার পর ঘুম না এলে আমি হিন্দি চ্যানেল খুঁজে বেড়াই। কোথায় সানি দেওলের ছবি দেখাচ্ছে? বাংলা চ্যানেল তো তা দেখাবে না। লোকজনকে ধরে ধরে আচ্ছা করে ঘা কতক পেটানোর দৃশ্য আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। এইসব ছবি দেখার পর আমার আনন্দ ঠিক বলে বোঝাতে পারবো না। সারাদিনের রাগ ক্ষোভ ক্লান্তি সব যেন এক নিমেষে উবে যায়। কিন্তু মনের উপর চাপ পড়ে এমন কোনও সিনেমা বা গল্পের বই পড়তে উনি মানা করেছিলেন।

আগেই বলেছি যত দিন যাচ্ছে এই কম বয়সী ডাক্তারের উপর আমার ভরসা তত বেড়ে যাচ্ছে। দেবরাজ বাবুকে সেই প্রথম দিনে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম।
—আমি ডাক্তারের এবিলিটি নিয়ে কিছু বলছি না। কিন্তু ডাক্তার টেলিভিশনে কি করে? আর ইনি তো চোখ নাক কান হার্ট কিডনি এসবের ডাক্তার নন। মনের ডাক্তার…

দেবরাজ বাবু যেন লাফিয়ে উঠে ছিলেন—

—আরে বাপরে বাপ! কী বলছেন? এদেরই তো বাজার। সমস্ত খবরের সঙ্গেই তো মন জড়িয়ে আছে। ধরুন একজন খুনি সে কেন খুন করল? জঙ্গিরা কেন নাশকতা করছে? মনের কোন অবস্থা তাদের নাশকতা করতে অনুপ্রাণিত করছে? বা কোন নায়িকা দু’নম্বর বিয়ে ভেঙে তিন নম্বরের দিকে এগোলেন কেন? এইসব নিয়ে গভীর আলোচনা এবং তার টিআরপি অত্যন্ত বেশি।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১২: ক’দিন ধরে আমি কেমন যেন মাংস পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৭: বিপৎকালে দেখতে পাই, রাখাল ছাড়া বন্ধু নাই…

যেদিন এই ডাক্তারের কাছে প্রথম গেলাম আমাকে একটি প্রশ্নাবলী ধরিয়ে দেওয়া হল। সে বিচিত্র সব প্রশ্ন। খুব খিদে পেলে কেমন লাগে? খুব খিদের পর খাবার খেতে কেমন লাগে? পেট ভরে খাবার পর ঘুমোতে ইচ্ছে করে কিনা? বাঁ দিক ফিরে ডানদিক ফিরে না চিৎ হয়ে শুতে ইচ্ছে করে। মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গে কিনা? ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখি কিনা? স্বপ্ন দেখলে কি ধরনের স্বপ্ন দেখি? সে শব্দ সাদাকালো না রঙিন? আরো অজস্র অসংখ্য প্রশ্ন। সেসব ভরে দিলাম। তারপর তিনি আমাকে নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন এবং একটা ডাইরিতে খসখস খসখস করে পেন্সিল দিয়ে লিখতে লাগলেন। দাঁত টপকে ঠোঁটের ডগায় প্রশ্নটা ঝুলছিল।

—পেন ছেড়ে পেনসিলে কেন?

প্রথম দিনেই নিজেকে বাচাল প্রমাণিত করতে চাইনি। তাই প্রশ্নটা গিলে ফেললাম। আর আমার পাবলিশার দেবরাজ বাবু লেখক হিসেবে আমার একটা গুরুগম্ভীর ইন্ট্রোডাকশন দিয়েছিলেন কথা শুরুতেই সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তাই আমার ভারিক্কি চালটা বজায় রাখতে চেয়েছিলাম। খেলো হালকা কথা বলে চালটা নিয়ে মিইয়ে যাওয়া গলা-ভাত করে লাভ কী?

অপেক্ষায় আমি বিরক্ত হই না। এই যে ট্যাক্সিতে করে চলেছি অনেকে বিরক্ত হয়ে পড়তেন। কখন বাড়ি পৌঁছাবেন বাড়ি পৌঁছে কী কী কাজ করবেন এ সব ভাবতেন। আমি ভাবি না। সত্যি সত্যি আমি জীবনকে খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। বেশি গুরুত্ব দিলেই সমস্যা। তাই কোথাও বসে থাকতে হলে। কি অনন্তকাল ট্যাক্সিতে জ্যামের পেছনে পেছনে চলতে হলে আমার দিব্যি লাগে। তখন আমি আগডুম বাগডুম ভাবি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩০: প্রচুর প্রোটিন, তাই যতখুশি ডাল খান?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৮: বাবা, ‘পিতা নোহসি’ বলো — এই কথাটি ঘুরেফিরেই কবির কানে বেজে উঠত

এই যাদের আমি দেখতে পাই তাদের ব্যাপারটাও আমার এরকম অদ্ভুত ভাবনার থেকেই শুরু হয়েছিল বলে আমার মনে হতো। আমার ডাক্তারও এটাকে মানসিক সমস্যা হিসেবেই দেখছে কিন্তু আজকে যেটা ঘটলো। সেটা আমি ব্যাখ্যা করতে পারছি না। সত্যিই কি তাঁরা আমাকে মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে? কি জানি আমরা সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

আচমকা ব্রেক দিয়ে হুমড়ি খেয়ে ট্যাক্সিটার থমকে গেল।

—কী হল দাদা?

—কেউ যেন একজন হুমড়ি খেয়ে সামনে পড়ল।

ইনস্যুরেন্সের কাগজপত্র গুছিয়ে নার্সিংহোম থেকে বের হতে বিকেল গড়িয়ে গিয়েছিল।

জায়গাটা একটু আলো আঁধারি, একটুখানি অংশে ফেন্সিং করা। কোন চায়ের দোকান নেই। তাই কেউ আড্ডা দিচ্ছে না। না হলে এতক্ষণে সকলে ঝাঁপিয়ে পড়তো।
আরও পড়ুন:

বিচিত্রের বৈচিত্র: তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম…

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৮: ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম এবং ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস

ড্রাইভার এবং আমি চট করে নেমে সামনে দেখলাম একজন বয়স্ক ভদ্রমহিলা। হাতে একটা বড় পুঁটলি মতো। সেই পুঁটলিটাই ওকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। গিয়ে হাত ধরতে উঠে দাঁড়ালেন। আমরা দুজনে চট করে ওকে নিয়ে এসে ট্যাক্সিতে তুলে নিলাম।

—খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড় করান।

ট্যাক্সি চালক বুদ্ধিমান। তাই সেই স্পটে না দাঁড়িয়ে ২০০ মিটার মতো এগিয়ে গিয়ে রাস্তার ধারে ট্যাক্সি দাঁড় করালেন।

বৃদ্ধার পরনে সাদা ময়লাটে শাড়ি। ঘোমটায় মুখ ঢাকা। কোলের ওপর পুটলিটা জড়িয়ে বসে আছেন।

—ঠাকুমা কোথাও চোট লেগেছে।

—না বাবা। শাড়িতে পাটা জড়িয়ে পড়ে গেছিলুম।

—থাকেন কোথায়?

—সন্তোষপুর।

—গড়িয়া সন্তোষপুর

—না বাবা, বজবজ লাইন।

—এখন যাবেন কি করে?

—ট্রেনে।

—কোথা থেকে উঠবেন ।

—টালিগঞ্জ।

—কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে অনেকটা উঠতে হবে আপনার তো একটু হলেও পায়ের চোট লেগেছে।
আরও পড়ুন:

মুখের রুচি চলে গিয়েছে? আয়ুর্বেদ উপায়ে অরুচি দূর করবেন কী ভাবে?

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫২: আঁধার ঘনালো বুঝি সীতার ভুবনে…

বৃদ্ধা চুপ করে রইলেন। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বললাম।

—লেক গার্ডেন স্টেশনে পৌঁছে দেওয়া যাবে।

—সেখানেও তো এখন ওভারব্রিজ – উঠতে হবে অনেকটা নামতে হবে।

—এক কাজ করুন আপনি টালিগঞ্জ সার্কুলার রোড দিয়ে চলুন কালীঘাট না মাঝেরহাট স্টেশনে নামিয়ে দেবো।

—তারাতলা পুরো জ্যাম হবে।

—হলে হবে। ওনার চোট বেশি নয় আমরা বেঁচে গিয়েছি।

মাঝেরহাট স্টেশনের বাইরে ট্যাক্সি থেকে বৃদ্ধাকে নামিয়ে দিয়ে এলাম স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে। ট্রেন আসবে। বেঞ্চ একটু জায়গা ছিল সেখানে বসিয়ে দিলাম।

—বেঁচে থাকো বাবা। দেরি করো না। ঘরে যাও। জরুরি খবর আসবে।
এই প্রথম মুখটা দেখলাম। বয়সের আঁকিবুকি ভাঁজে মুখের চামড়া কুঁচকে রয়েছে। ওকে অতটা দূরে পৌঁছে দেওয়াতে উনি খুশি হয়েছেন এটা মুখ দেখে বুঝতে পারছি ঘোমটা তখনও ছিল আর স্টেশনেও আলো এখন আগের থেকে কম। সব জায়গায় বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের চেষ্টা চলছে। সেই আলোআঁধারিতে খুব স্পষ্ট না হলেও চোখ দুটো যেন আমায় বিদ্ধ করল। বিদেশিদের মতো ঘন নীল চোখের তারা। একটু ঘোলাটে। চশমাহীন। বিদেশের সিনেমাতে যেরকম বয়স্ক মানুষকে হঠাৎ দেখা যায় ঠিক তেমন। বজবজ লোকালে সন্তোষপুর যাওয়ার কোন বৃদ্ধার চোখ এরকম নীল হতে পারে আমি ভাবতেও পারি না। কথার মাঝেই ট্রেন এসেছে। বৃদ্ধাকে ট্রেনে তুলে দিয়েছি। স্টেশনের বাইরে এসে ট্যাক্সিতে বসেছি। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই চিন্তা। কী জরুরি খবর অপেক্ষা করছে। কোথা থেকে আসবে জরুরি খবর। এই বৃদ্ধা জানলেন কী করে—চলবে।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content