সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


আমি নাকি জ্ঞান হারিয়ে ছিলাম। ডাক্তাররা আমার জ্ঞান ফেরার পর বারবার জানতে চাইছেন, আমার ছোটবেলায় কিশোর বা যুবকবয়সে কখনও ক্যাটালেপসি মানে ফিটের ব্যামো ছিল কিনা। জ্ঞান হারিয়ে মাংসপেশি শক্ত হয়ে মুখ শরীর হাত-পা বেঁকেযায় এই রোগে। হঠাৎ আসে হঠাৎই চলে যায়। আজকাল বড় একটা শুনি না। ছোটবেলায় খুব শুনতাম। আমার এক বন্ধুর দিদির খুব ফিটের ব্যামো হতো। হঠাৎ হঠাৎ দুমদাম দাঁতে দাঁতে লেগে উল্টে পড়ে যেত। মুখেচোখে জল দিয়ে জুতো শোঁকালে জ্ঞান ফিরত।

সেই দিদির বিয়ে হয়ে যাবার পর আর এ সমস্যা ছিল না। অবিবাহিতা মেয়েদের বিয়ে না হওয়ার চিন্তায় বা বিবাহিতদের সন্তান ধারণের অক্ষমতার কারণে প্রবল মানসিক চাপ পড়তো তার থেকেই হয়তো ক্যাটালেপসি হতো। না এটা কোনও ডাক্তার বলেননি। এটা একেবারেই আমার নিজস্ব ধারণা। লালমোহনবাবুকে সাহারায় শিহরণ কিশোর উপন্যাসের পরের এডিশনে উটের কুঁজে জল থাকার ব্যাপারটা ফেলুদা ঠিক করে নিতে বলেছিলেন। তেমন কোনও ফেলুদা বললে আমিও বদলে নেব।

যাইহোক আমার মনের ডাক্তার এসেছিলেন হাসপাতালে। তাকে দেখলাম অক্ষত একই রকম ফিটফাট। তিনি আমায় বললেন, তার একটা খুব জরুরি ফোন এসেছিল বাড়ি থেকে। তাঁর আপ্রণের পকেটে সাইলেন্ট ফোনটার ভাইব্রেশন শুনে তিনি ভিতরের ঘরে গিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন। চট করে ফোনটা ছাড়তে পারেননি একটু লম্বা কথোপকথন চলছিল।
আচমকা বাইরের ঘর থেকে যেখানে আমি বসেছিলাম একটা চিৎকার শুনে ডাক্তার ছুটে এসে দেখেন আমি চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছি এবং খুব ঘামছি। খুব ভয় পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। মুখ থেকে একটা গোঁ শব্দ বের হচ্ছে। বাড়িতে মানে মাকে খবর দিয়ে তিনিই মাকে আশ্বস্ত করেছেন যে চিন্তার কোন কারণ নেই। সেরে যাবে। মা বা আমি যেন তাঁর ওপর ভরসা না হারাই।

সত্যিই ক্রমশ আমার ভরসা বিশ্বাস পাকা হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে আমার সমস্যাটা আমি কাটিয়ে উঠতে পারব। বাড়িতে ফিরতেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরে খানিকক্ষণ হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।

— আরে আরে কি মুশকিল কান্নাকাটি করার মত কিছু হয়নি মা। ক্লিনিকে একটু মাথাটা কোথায় ঘুরেগিয়েছিল ডাক্তার ভয় টয় পেয়ে অ্যাম্বুল্যান্স দেখে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিয়েছিল। কয়েকটা টেস্ট-ফেস্ট করেছে সব ঠিক আছে।

— আমায় মিছে কথা বলছিস না তো?

— তুমি ছাড়া আমার আছে কে মা? তোমায় মিছে কথা বললেই আমার লাভ কী? সুগার লেভেলটা একটু বেড়ে গিয়েছিল বোধ হয় তাই মাথাটা ঘুরে গিয়েছিল। বামুন মা রাতে ছিল?

— হুঁ! পইপই করে বলি একটু তেতো খা। বাজার থেকে তো কোনওদিন নিমপাতা নিয়ে আসবি না। মুখ ব্যাজার করে করলা ভাজা দু-চারটে মুখে ফেলিস ব্যাস। চায়ে একটু চিনি দিতেই হবে। পছন্দমতো তরকারি হলে ভাতটা একবারের জায়গায় দু’ বার। মা হয়ে তো আর বাধা দিতে পারি না। মাংস হলে একটা আলু তো চাই-ই চাই। প্রথমে যখন সুগার-টুগার বেড়েছিল একটু ধরাকাট ছিল। এখন তো সবই হরির নামে গিয়েছে।

আদালতে জজসাহেব যখন কৃত অপরাধ আইনের ধারা আর বিচারের সাজা শোনান অপরাধী তখন কাঠগড়ায় হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে শোনা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১১: ডাক্তার প্রায় অজ্ঞান অবস্থায়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

চারদিন পরে আবার মনের ডাক্তারের কাছে গেলাম। আমার রক্তে শর্করা কোলেস্টেরল ইত্যাদির দাপাদাপি ও আমাকে প্রস্থে কমাবার জন্য যে ডাক্তার চিকিৎসা করছেন তাঁর ওষুধ পত্র চলছে খাওয়া-দাওয়ার বাধানিষেধ যতটুকু মানা যায় আর কী। কিন্তু সাঁতারটা একরকম স্থগিত রয়েছে। এই হয় আমাদের জীবনে আমরা নানা রকমের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি কয়েক মাইল হাঁটবো সাঁতার কাটবো জিমে যাব ব্যাডমিন্টন খেলব। সব জায়গায় ভর্তিটা নিয়ম করে হই কিন্তু বাকি কাজটা আর করা হয়ে ওঠে না।

সেদিন যাবার পর ডাক্তারবাবুকে সরি আমার ডাক্তারনীকে বেশ একটু গম্ভীর দেখালো। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে উনি বললেন—

— দেখুন যারা ক্রিয়েটিভ লোক। লেখেন। তাদের কারো কারো মধ্যে স্প্লিট পার্সোনালিটি কাজ করে। পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডারের মতো সিরিয়াস হয়তো নয় কিন্তু একটা অন্য চরিত্র মনের মধ্যে বাসা বাঁধে। আমার বিশ্বাস আপনার সেরকম কিছু একটা হচ্ছে।

— আমি একবার আপনাকে বলবার চেষ্টা করেছিলাম।

— হ্যাঁ আমি বলেছিলাম যে আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না ওগুলো আমরা ভাববো।

— এর কি চিকিৎসা আছে।

— নিশ্চয়ই আছে। পুরো ব্যাপারটাই তো মানসিক দুর্বলতা। সেটাকে আইডেন্টিফাই করতে হবে সেখান থেকে নিজেকে প্রটেক্ট করতে হবে ব্যাস। এবার আপনি আমাকে স্টেপ বাই স্টেপ বলুন যে সেদিন একচুয়ালি কি ঘটেছিল আপনি কি দেখেছিলেন।
আরও পড়ুন:

রিভিউ: ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’—মনোজ বাজপেয়ী একাই একশো

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৬: মজল আঁখি মজেছে মন, ইমোজি তোদের ডাকল যখন

আমি দাড়ি কমা ফুলস্টপ মেনে সেদিনের ঘটনা তার কাছে খুলে বললাম। বললাম যখন তিনি আমাকে দেখেছেন আমি মাটিতে পড়ে ভয়ে করছি তখন আমি পর্দা সরিয়ে ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখছি তিনি মাটিতে পড়ে রয়েছেন। ওঁর ওই রকম অবস্থা দেখে আমি ভয় পেয়েছি।

আমার ভয় পাওয়ার তখনও বাকি ছিল। আমি দেখলাম আমার ডাক্তার ম্যাডামের মুখটা অদ্ভুত ভাবে বদলে গেল। আজকাল ভিএফএক্স করে যেমন মুখ বদলে দেওয়া যায় ব্যাপারটা ঠিক সেভাবেই ঘটল আমার চোখের। ডাক্তারের হেলমেটকাট চুল বদলে গিয়ে কপাল থেকে চুলটা উল্টে গেল। মুখের মধ্যে কপালটা যেন অনেকটা বড় হয়ে গেল। চোখ দুটো গোল গোল নীলচে। নাক আর ঠোঁটটা ছোট হয়ে গেল। এই অদ্ভুত চেহারা নিয়ে তিনি আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন—

— কোন ক্ষতি আমরা করবো না। তবে জোর করে আমাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা কোর না। আমরা কখনও কখনও কাউকে মিডিয়াম হিসেবে বেছে নিই। তুমি আমাদের সেরকম পছন্দের একজন মিডিয়াম।

একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে আসছিল। ওপ্রান্ত থেকে সম্মতি এল—

— হ্যাঁ, প্রশ্নটা করে ফেলো।

— সেদিন আমি যেটা দেখেছিলাম ওই ঘরটার ভেতরে ডাক্তার ম্যাডাম মেঝেতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন। সেটা সত্যি নাকি আমার ডাক্তার ম্যাডাম যেটা বললেন, আমি পড়ে গিয়ে ভয় পেয়ে গোঁগোঁ করছিলাম সেটা সত্যি।
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৯: পৌরুষ, পুরুষ নির্মাণ, পুনর্নির্মাণ ও কিছু সমস্যা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৯: ডায়াবেটিসে কি আলু একদম বন্ধ?

— তুমি যা দেখেছিলে সেটা হবে। যদি এ ভাবে জোর করে আমাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করো। সেটা মনে মনে দেখে তুমি ভয় পেয়ে পড়ে গিয়েছিলে তোমার ডাক্তার তোমায় হাসপাতালে পাঠায়।

— এখন কে কথা বলছেন? আমার ডাক্তার না কি?

— আমি একা নই। আমরা অনেকে রয়েছি আমরা চলে গেলে ডাক্তার সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তবে তোমার আসার কথাটা ওর মনে থাকবে না। তুমি এখুনি বাড়ি যাও। মা’র ফোনে তোমার একটা ফোন আসবে। যাও।

— কার ফোন।

— গেলেই জানতে পারবে।

—একটা কথা ক’দিন ধরে কেন আমি চামড়া পোড়া মাংস পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।

— ওই ফোনেই তার উত্তর পাবে।—চলবে।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content