শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ডাক্তার বয়সে আমার থেকে ছোট। রোগাটে গড়ন। ঢাউস ফ্রেমের চশমা পরে। আমার তো মনে হয় ফ্রেমটা ওঁকে মানায় না। সত্যজিত রায়ের ‘নায়ক’ ছবিতে শর্মিলা ঠাকুর যে চশমাটা পরেছিলেন সেরকম হলে বেশি মানাত। কিন্তু ভরসা করে কখনও বলতে পারিনি, কারণ এখন দিনকাল মোটেই ভালো না। কার কোন কথা অফেনসিভ মনে হবে, তারপর কেলেঙ্কারির একশেষ।

মনের লকারে রাখা সিদ্ধান্তটা ‘হ্যাঁ’ ছিল। কিন্তু তবুও “যেতে পারি কিন্তু যাব কেন?” এই ধনুক ভাঙ্গা পণে নিজেকে আটকে রাখছিলাম। শেষমেশ রাখা গেল না। আমার প্রকাশক দেবরাজবাবুই ফোন টোন করে ব্যবস্থা করে দিলেন। বললেন —

—বয়স অল্প হলে কী হয় দারুণ পসার। খুব নাম করে ফেলেছে। টিভিতে এক্সপার্ট হিসেবে মাঝে মাঝেই দেখা যায়।

আমি চুপ করে আছি দেখে দেবরাজবাবু আমাকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন—

—আমি বলছি আপনি যান। ফার্স্ট ভিজিটের পর আমাকে বলবেন।

প্রথমদিন এবং তার পরেও তিনি যখন আমার সঙ্গে কথা বলেন তখন পেন্সিল দিয়ে রগের কাছে চুলটা মাঝে মাঝে তোলেন আবার ছেড়ে দেন। হেলমেট ছাঁট চুল। হেলমেট এর মতই মাথা কান ঘাড় সব গোল করে চুলের হেলমেট ঢেকে রেখেছে। এই স্পেশাল ছাঁটটার কী একটা নাম আছে! হ্যাঁ মনে পড়ছে শর্ট ব্লন্ড। আমাদের আগের জেনারেশনের ছোটবেলায় একেই বোধহয় “দশ আনা, ছ’ আনা ছাঁট” বলা হতো। তবে নামকরণের ইতিহাস জানা নেই। আমার ডাক্তারনী স্যুট-বুটপরা মেমসাহেবটি।
এখানে একটা ব্যাপার আলোচনা করা দরকার। ডাক্তার সব সময় ডাক্তারবাবু। আধুনিককালে কখনও কখনও তিনি ‘স্যার’। কিন্তু মহিলা ডাক্তারকে কী বলা হবে। এককালে তিনি ছিলেন ‘দিদি’। পুরনো খুব সাকসেসফুল মহিলা ডাক্তাররা অনেকেই অবিবাহিতা ছিলেন। চোখে মোটা চশমা। কালোপাড় সাদা শাড়ি। শোভাদি, পূর্ণিমাদি, আরতিদি। একেবারে ঘরগেরস্ত মা-মাসি-পিসিদের আটপৌরে চেহারা। চশমার ফ্রেম বদলাল। শাড়ির ধরন বদলালো। ডিজাইনার ব্যাগ থেকে জুতো গাড়ি সব বদলালো। পরবর্তীতে তিনি ম্যাডাম। কিন্তু স্যার বা ম্যাডাম যাই বলি সেটা যে ডাক্তারের কথাই বলা হচ্ছে সেটা তো বোঝানো যায় না। তাই আমার ডাক্তার ম্যাডামকে আমি ডাক্তারনী বললাম ।

আর চিকিৎসার ধরনেও বদল হল। সেকালের সেই গোলচশমা মুসকো গোঁফজোড়া কালো গলাবন্ধ কোট। পেটমোটা চামড়ার ব্যাগ থেকে স্টেথো বের করা, চামচে জোরে জিভ চেপে আ আ করে আলজিভ দেখা। এপাশ-ওপাশ ফিরিয়ে “জোরে শ্বাস” বলে বলে বুকের ফোঁসফোঁস শোনা তলপেট চেপে ধরে পিলে মাপা চোখবুজে নাড়ী ধরা ডাক্তারবাবুদের সময় আর নেই। সাদা কাটা-কাগজের দাগে সাঁটা লাল সিরাপের মকরধ্বজ চিকিৎসাও আজ নেই। তাই আজকের চিকিৎসায় লম্বা প্রেসক্রিপশন হ্যানা টেস্ট, ত্যানা টেস্ট এসব না হলে আর দস্তুর মতো চিকিৎসা হল কই? এই সবের সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারবাবু বা বিবির পোশাকআশাক ব্যক্তিত্বের প্রকাশ হাবভাব। ঝকঝকে ক্লিনিক তকতকে আধুনিক যন্ত্রপাতি। সাজানো পোস্টার জানা-অজানা ডিপ্লোমা কনফারেন্স এর ঝুলিয়ে রাখা সার্টিফিকেট আধুনিক এসি আধুনিক আলো কম্পিউটারে রাখা আপনার ঠিকুজি কুষ্টি সবকিছু সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-১০: আচমকা নাকে এলো সেই অদ্ভুত পোড়া গন্ধটা

রিভিউ: ওয়েব সিরিজ ‘স্কুপ’, ওটিটি হল বিনোদনের আইপিএল

এই আকালের যুগে ইঞ্জিনিয়ারদের যেমন চাকরির টানাটানি ডাক্তারদেরও ক্ষেত্রেও তেমন রোগীর আকাল। আজকাল মানুষ ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। তাই এখন ওষুধের দোকানে টুথব্রাশ টুথপেস্ট মশা মারার স্প্রে শ্যাম্পু সাবান সব পাওয়া যায়। জেনারেল ফিজিসিয়ান ডাক্তাররা এখন আর একটা ক্লিনিকে বসার ভরসা পান না। ইংরেজি টিচার পালবাবু বা অংকের টিচার মাইতি বাবুর এ কোচিং ও কোচিং ক্লাসে ঘুরে ঘুরে ঘড়ি ধরে টিউশন করানোর মতোই এ পাড়া ও পাড়ার ওষুধের দোকানে বসেন। তবে স্পেশালিস্ট হিসেবে নাম করে গেলে একটা দুটো প্রাইভেট হসপিটাল ঘুরে নিজের ক্লিনিকে বসে পড়েন। কিন্তু ফুটবলে লাথি তো সকলে মারে মেসি নেইমার আর কটা হয়?

আমার ডাক্তারকে আমি সবকিছুই বলেছি। শুধু একটা কথা বলিনি। বলার ইচ্ছে করেনি। আফিফার কথা।আমার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে আমি আমার যৌবনের ব্যর্থ প্রেমের কাহিনি শোনাবো কেন? হোক না সে ডাক্তার! নয় মনের চিকিৎসাই করছে।

আফিফার কথা মনে হতেই মনে পড়ে গেল দুর্গাপুরের হোটেলে মাঝরাতে সেই অনাম্নী অঙ্গনার ফোনের কথা। সে কি করে জানল আফিফার কথা? নাকি এসব আমিই ভাবছি। আমার মধ্যে কোন অলটার ইগো ভাবছে? আমি কি তবে পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগে ভুগছি? আমার ভেতরে স্প্লিট পার্সোনালিটি কাজ করছে?

আমার ডাক্তারের সাবধানবাণী মনে করলাম।

—কেন এসব হচ্ছে সেটা নিয়ে একদম আপনি ভাববেন না স্যার। এতে আপনার ক্ষতি হবে। রুট ক্যজ বার করাটা আমার দায়িত্ব।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

সেদিন শনিবার। আমি শেষ পেশেন্ট। দূর্গাপুরে ওয়াশরুমের মধ্যে অজানা কারও উপস্থিতি সাদা মার্বেলের উপর মেয়েলি পায়ের জল ছাপ ব্যাংকোয়েটে বোরখা পরা একটি মেয়ের কথা মাঝরাতে ফোন সবকিছু বললাম। তারপর ট্রেনের মধ্যে থেকে দেখা ট্রেনের গা ঘেঁষে রেললাইনের ঠিক পাশে দাঁড়ানো কিশোরী মেয়ে কামরায় আলো নিভে যাওয়া আমার দিকে এগিয়ে আসা অবয়ব। চামড়া পোড়া গন্ধ কাঠের দরজার বাইরে কাটা কব্জি আঙুলের ভিড় হাওড়া স্টেশনে আমার নিজের বাড়ির বারান্দায় সেই পুতুলটা খুঁজে পাওয়া সেটাকে ছুঁড়ে ফেলা এবং সেই অশরীরী এসে পুতুলটা ধরে ফেলা। আফিফার উল্লেখ ছাড়া আমি সব কিছু বলেছি।

ডাক্তার একটু গম্ভীর মুখে তার চেয়ার ছেড়ে পর্দা দেওয়া ভেতরের ঘরে গেলেন। আমি একা বসে আছি হঠাৎ সেই পর্দার ভেতর থেকে সেদিন রাতে টেলিফোনে শোনা মিশ মোহিনীর গলায় কেউ বললেন

—আফিফা এপিসোডটা বাদ দিলেন কেন?

আমার মনে হল ভিতর থেকে ডাক্তারি কথা বলছেন আমার মনের ভুলে আমার মনে হচ্ছে গলাটা মোহিনীর মতো। এটা আমার ইলিউশন।

—সবটুকু বললেন শুধু আফিফা অংশটা বাদ দিয়ে। কেন?
আরও পড়ুন:

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৮: ‘সম্মতি’ আদায়ের চাবিকাঠি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৮: সাইনাস নাকি কখনওই সারে না?

—আমি বলতে চাইনি তাই। আফ্রিকার কোন অস্তিত্ব আমার জীবনে নেই। সে এখন বিবাহিতা। আমার কাছে আসিফা ক্লোজড চ্যাপ্টার।

—আফিফা কেমন আছে আপনার জানতে ইচ্ছে করে না।

আমার অদ্ভুত লাগছে ডাক্তার এ ভাবে পর্দার আড়াল থেকে ওই ঘরের ভেতর থেকে কথা বলছেন কেন?

—না। সে তো এই দেশেই থাকেনা। দুবাইতে থাকে অনেক দূরে।

—আফিফা দুবাইতে কেমন আছে আপনি জানেন?

—না আমি জানতে চাই না।

—আফিফা আর নেই।

—মানে?

—আফিফা মাসখানেক আগে সুইসাইড করেছে ।

—মিথ্যে কথা আর কলকাতায় বসে আপনি এসব জানলেন কী করে।

খিলখিল করে মোহিনী যেমন হাসে সেভাবেই হাসির শব্দ এলো।

—আমি যে কলকাতায় বসে আছি এটা আপনাকে কে বলল?

এবার আমার সন্দেহ হল ছুটে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে দেখলাম। আমার ডাক্তার প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেতে। তার চোখ দুটো কপালে গোঁ গোঁ করে একটা শব্দ হচ্ছে। সারা ঘরে ফিস ফিস করছে অনেকগুলো অবয়ব আর তীব্র চামড়া পোড়া গন্ধ।—চলবে।
* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

Skip to content