শুক্রবার ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


আচমকা গায়ে একটা অল্প ধাক্কা। কানে এল।

— ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি কাকা?

চাকরি দেখলাম আমার সামনে জোড়া সিটের সেই কম বয়সী স্বামী-স্ত্রীর স্বামীটি আমাকে উদ্দেশ্য করে বলছে।

— হাওড়া ঢুকছে। এখন ঘুমোলে কারশেডে চলে যাবেন তো।

জানলা দিয়ে দেখলাম ট্রেন গুটিগুটি পায়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে।

—থ্যাঙ্ক ইউ ।

আগে সবাই সবাইকে দাদা বলতো। এখন কাকু বলে। হঠাৎ এই পরিবর্তনটা কখন কীভাবে সেটা জানতে গভীর রিসার্চ করতে হবে। প্লাটফর্ম ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম ট্যাক্সি নেব কিনা। রাতের বেলায় হাওড়া স্টেশনে এখনও ট্যাক্সি পেতে মাঝে মধ্যে ঝামেলা হয়। ট্যাক্সি লাইনে আসে না। ইতি-উতি ছিপ ফেলে থাকে। পছন্দমতো প্যাসেঞ্জার পেলে নেবে। রাতের বেলা এটা বায়ারস বা সেলারস নয় পুরোপুরি ড্রাইভারস মার্কেট। ঠিক করলাম বাসে ফিরবো। এখন সব বাসই ফাঁকা। আজকাল বেহালা যাবার অসংখ্য যানবাহন। আমি মাঝেমধ্যেই বাসে চড়ি তাই আমার কাছে বাসের নম্বরগুলো সড়গড়। এস ১২ডি, ৭এ, সি৩৭ চৌরাস্তা মিনি। অসংখ্য প্রাইভেট বাস বাদই দিলাম।

এ সব ভাবতে ভাবতে আমি সাবওয়ের রাস্তা ধরেছি। হঠাৎ মনে হল আরে আমার আশপাশে তো কোনও লোকজন নেই। সাবওয়েটা অসম্ভব খালি লাগছে। আলো আঁধারির মধ্যে হাঁটছি আর ভাবছি কেউ না কেউ তো আসবেই আমার পেছন থেকে অথবা আমার উল্টো দিক থেকে। পিছন ঘুরে দেখলাম কেউ নেই। সামনে থেকেও কেউ আসছে না। আবার সেই অদ্ভুত পোড়া গন্ধটা নাকে এলো। মনকে বোঝালাম আমি যেসব ভাবছি তা নয়। ফাঁকা সাবওয়েতে নেশাখোরেরা নানা রকমের নেশা করে। গাঁজা চরস হেরোইন হতে পারে এ সব তারই গন্ধ।

এটা আমার মনের ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন।

এটা তাঁর কাছেই শেখা।

— স্যার যখন আপনার মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি তৈরি হবে। আপনার একটা প্যারানরমাল সেন্সেশন হবে। সাম এইরি ঘোস্টলি ফিলিং তখন অ্যাবসলিউটলি উলটো কিছু ভাববেন এনিথিং যেটা আপনার মনকে মোমেন্টারিলি ডাইভার্ট করে দেবে।
দিদিমণিকে ধন্যবাদ আমি তাঁর কথা ভাবতে ভাবতেই ভয়কে জয় করে শিরশিরানি পেরিয়ে এলাম।

আমি এখন বেহালা চৌরাস্তার মিনিবাসের জানলার ধারে। জনমানবহীন বিবাদহীন বিবাদীবাগ পেরিয়ে যাচ্ছি।

আবার মনের মধ্যে চলে আসছে তাদের কথা। আমি ক্রমাগত যাদের দেখছি যাদের অনুভূতি বুঝতে পারছি। এর পুরোটাই আমার মনের ভুল নাকি সত্যি কিছু ঘটছে আমি বুঝতে পারছি না। আমার ডাক্তার আমাকে বলেছেন যে এগুলো যখন খুব বাড়বে তখন যেন আমি সঙ্গে সঙ্গে ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। এত রাতে আর ফোন করার কোনও মানে হয় না। বাড়িতে হয়তো এখন স্বামী বাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত আছেন। অবশ্য আমি ঠিক করে জানিও না আমার মনের ডাক্তার বিবাহিতা না অবিবাহিতা। জেনে আমার কোন লাভও নেই। আমাকে এই মানসিক অসুবিধের জায়গাটা থেকে সুস্থ হতে হবে। তার জন্যই আমার ওঁর কাছে যাওয়া।

বাসস্টপে নেমে একটা সাইকেল রিক্সা করে নিয়েছিলাম। ব্যাগটা হাতে না থাকলে হেঁটেই আসতাম। বাড়িতে ঢুকে স্নান সেরে খেতে বসলাম। নানা ঘটনা ঘটে গেল আজ। একদিন ভোর বেলায় বেরিয়ে সেই দিন রাত পরের দিনটা কাটিয়ে রাত্রিবেলায় আয়েশ করে বসে মায়ের হাতে রান্না খাচ্ছি। এদিন মনটা রান্নাকরা পদের দিকেই রেখেছিলাম। ছোট ছোট ট্যাংরা মাছের ঝাল করেছে মা। তিনবেলা হোটেলের থোড়-বড়ি-খাড়া খাড়া-বড়ি-থোড় খাওয়া দাওয়ার পর মায়ের হাতের ঝাল ঝাল ট্যাংরা মাছ খেতে যেন অমৃত লাগছে।

— ট্যাংরা এলো কোত্থেকে আমি তো আনিনি?

— চার তলায় নবীন মুখার্জির শালা সুমন্ত। ওকে বলেছিলুম

—এটা ঠিক নয় মা। কোন দিন কবে কী বলে দেবে এমনিতেই আমার পাম্প চালানো গেট বন্ধের ডিউটি গুলো সুমন্ত করে দেয়।
আরও পড়ুন:

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৯: মোহাবিষ্ট মায়াবী কণ্ঠস্বর, চেনা বলার ঢং, তবে কি মোহিনী?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১: জয়রামবাটির আদরের ছোট্ট সারু

—আরে বাবা আমি বলিনি। সেই এসে বলল দাদাকে দেখলাম ব্যাগ নিয়ে ভোরবেলা বের হতে। কোথাও গেলেন বুঝি? আমি বললুম দুর্গাপুরে ওর বইয়ের কি একটা অনুষ্ঠান আছে। তো সে বলল আমি বাজার যাচ্ছি আপনার কি কিছু এনে দিতে হবে। তাই…। তুই বারণ করলে আর বলবো না।

—না দেখো । বিনিময়ে আমি তো সেরকম কিছু

—বই দিবি।

— আরে নিজের লেখা বই ওভাবে দেওয়া যায় নাকি! নবীনবাবুর শ্বশুরমশাই মানে সুমন্তর বাবারই তো পাবলিকেশনের ব্যবসা ছিল। চাইলে বই দেওয়া যায়। জোর করে নিজের বই দেওয়া মানে আমি বই লিখেছি। তোমরা পড়ো গোছের ব্যাপারটা হয়ে যায় না?

মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে রাত হল। বারান্দার লাগোয়া ঘরটা আমার। পাশেরটা মায়ের।

—তুমি শুয়ে পড়ো মা!

—এখন আবার লেখালিকি হবে না কি?

—না না, একটু বারান্দায় পায়চারি করে শুয়ে পড়ব।

—আলোটা জ্বালিয়ে নে।

—দরকার হবে না।

ছোট্ট বারান্দা আমাদের। একটা কোণে ঘরমোছা ন্যাতা বালতি আর ঝাড়ু রাখা থাকে। তার পাশে একটা বেতের চেয়ার। বাবা ব্যবহার করতেন। নিজস্ব রং হারিয়ে তাতে একবার সাদা রং করা হয়েছিল। আমার তত্ত্বাবধানে সেই সাদা রং সময়ের কালো ছোপ পড়ায় একটু গাঢ় বাদামি রং করা হল। বারবার রং বদল করার ফলে তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেল। মানে বেতের আসবাবের আত্মবিশ্বাসে আঘাত হানে ঘূণপোকা। ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খায় বাইরের সামান্য একটু প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই দুমড়ে-মুচড়ে যায়। এরপর ঘরের ভেতর আদরে লালিত হয়নি। বাইরের বারান্দায় অবিরাম রোদ ঝড় বৃষ্টির সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে বাবার আমলের বেতের সেই চেয়ারটা এখন বেশ শক্তপোক্ত।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৭: মদ না খেলে ফ্যাটি লিভার হয় না?

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৭: সমস্যা যখন ‘সম্মতি’ নেওয়া বা দেওয়ার

বারান্দায় বসে ভাবছিলাম যা যা ঘটে গেল গতকাল থেকে। আমাদের বারান্দায় পুরোনো আমলের ইঁটের আলসে। আধুনিক গ্রিল বারান্দা নয়। আয়েস করে পাটা কোমর সমান দেওয়ালে তুলতে বেতের চেয়ারটা একটু পেছনে সরাতে গিয়ে কিছু একটা পড়ল যেন। নরম কিছু। ফিরে দেখি সেই সোনালি কোঁচকানো চুলের পুতুলটা। সেইরকম জ্বলজ্বলে সবুজ চোখে আমাকে দেখছে। এবার পুতুলটা দেখে আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল। মা বলে চিৎকার করতে গেলাম। শেষ মুহূর্তে থেমে গেলাম। মা হয়তো এতক্ষণে শুয়ে পড়েছে। আমি মাকে বারবার বলে গিয়েছিলাম বাড়ির ময়লা ফেলার প্যাকেটে এটাকে ফেলে দিতে। কার না কার পুতুল!! হয়তো কেউ যাদু টোনা ব্ল্যাক ম্যাজিক করার জন্য পাঠিয়েছে। আমার মা এসব বিশ্বাস করে না। তবু বলল ঠিক আছে, আমি ফেলে দেবো। মা হয়তো ফেলে দিয়েছিল। আমাদের কাজের মেয়েটা হয়তো গুছিয়ে তুলে রেখেছে।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৫: হিচককের লন্ডন, হিচককের সিরিয়াল কিলার

কয়েক মুহূর্ত ভাবলাম। হঠাৎ মাথার মধ্যে কি রোখ চেপে গেল পুতুলটার ঘেঁটি ধরে টান মেরে ছুঁড়ে দিলাম রাস্তার দিকে।

তারপর যা ঘটলো তার জন্য আমি একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না। সেদিন যে মহিলা আমার কাছে বারোর পাঁচ কে ডি সাহা রোডের ঠিকানা জানতে চেয়েছিল ঠিক তার মতোই কেউ একজন যেন অন্ধকার ফুঁড়ে আচমকা বেরিয়ে এসে সেই পুতুলটা ধরে ফেলল বা বলা যায় ছুঁড়ে দেওয়া পুতুলটাই যেন হাওয়ায় ভেসে তার কাছে চলে গেল। দূরের আবছা এলিডি আলোয় দেখলাম নিচের রাস্তা থেকে সেই মহিলা আমার দিকে তাকাল। অত দূর থেকে মুখটা আবছা অন্ধকার কিন্তু চোখ দুটো আশ্চর্য উজ্জ্বল সবুজ রঙের। ঠিক সেই ফেলে দেওয়া সোনালি কোঁচকানো চুলের পুতুলটার মতো।—চলবে।

হাওড়া স্টেশনের সাবওয়ে।

* বসুন্ধরা এবং… দ্বিতীয় খণ্ড (Basundhara Ebong-Novel Part-2) : জিৎ সত্রাগ্নি (Jeet Satragni) বাংলা শিল্প-সংস্কৃতি জগতে এক পরিচিত নাম। দূরদর্শন সংবাদপাঠক, ভাষ্যকার, কাহিনিকার, টেলিভিশন ধারাবাহিক, টেলিছবি ও ফিচার ফিল্মের চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার। উপন্যাস লেখার আগে জিৎ রেডিয়ো নাটক এবং মঞ্চনাটক লিখেছেন। প্রকাশিত হয়েছে ‘জিৎ সত্রাগ্নি’র নাট্য সংকলন’, উপন্যাস ‘পূর্বা আসছে’ ও ‘বসুন্ধরা এবং…(১ম খণ্ড)’।

আপনার রায়

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধি করা জরুরি?

Skip to content