শুক্রবার ৪ অক্টোবর, ২০২৪


দীর্ঘ সময়ে এক ভাবে বসে থাকলে বা শুয়ে থাকলে ঘাড়ে পিঠে অসহ্য ব্যথা হয়ে যায় এই রোগে। ছবি: সংগৃহীত

তার নাম থেকেই রোগটাকে কিছুটা বোঝা যায়। গ্রিক ভাষায় অ্যাঙ্কাইলস শব্দের অর্থ বেঁকে যাওয়া। আবার অ্যাঙ্কাইলোসিস বলতে বোঝায় শক্ত হয়ে যাওয়া। আর স্পন্ডিলস হল মেরুদণ্ড। অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস (এএস) হল প্রদাহজনিত রোগ, যার ফলে শিরদাঁড়া কখনও শক্ত হয়ে যায়, আবার কখনও বেঁকে যায়। অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস, অস্টিয়ো স্পন্ডাইলো আর্থারাইটিস নামেও পরিচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ০.৭ থেকে ১ শতাংশ মানুষ অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিসের সমস্যায় ভোগেন। এদের মধ্যে আবার ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই এইচএলএবি-২৭ পজিটিভ পাওয়া যায়।
 

রোগের লক্ষণ

পিঠে ব্যথা। পিঠের নীচের দিকে এবং নিতম্ব শক্ত হয়ে যাওয়া। বিশেষ করে সকালে এই সমস্যা বেশি হয়।

ঘাড় ব্যথা এবং ক্লান্তি দেখা দিতে পারে।

ব্যায়াম করলে, গরম জলে স্নান বা গরম সেঁক নিলে ব্যথা কমে গেলেও বিশ্রাম নিলে সেই ব্যথা আবার বাড়তে পারে।

মাঝেমধ্যে পিঠে, কাঁধে বা কোমরে ব্যথা।

সারা রাত কোমরে ব্যথা হতে পারে, সকালে উঠেও কোমর ধরে থাকে অনেক সময়।

ব্যথা কমানোর ওষুধ খেলে প্রথম দিকে পুপকার পাওয়া যায়। কিন্তু পরে ওষুধের প্রভাব কমতে থাকে। বেশি দিন ব্যথা কমানোর ওষুধ খাওয়ার জন্য গ্যাস-অম্বল হয়, কিডনির সমস্যা দেখা দেয়।

৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে আবার চোখেরও সমস্যা হতে দেখা যায়। চোখ লাল হয়ে যায়, কিংবা দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে ইউভিয়াইটিস বা আইরাইটিস বলা হয়।

পেটেরও গন্ডগোল দেখা যায়। রোগী কোলাইটিস বা ইনফ্ল্যামেটারি বাওয়েল ডিজিজে কেউ কেউ ভোগেন।

সোরিয়াসিস-ও হতেই পারে। মূলত শীতকালে দেহের বিভিন্ন অংশে যেমন মাথা, কানের পিছন, কনুই ইত্যাদিতে লাল চাকা চাকা দাগ দেখা দেয়।

 

কাদের ঝুঁকি বেশি

অ্যানকিলোজিং স্পন্ডিলাইটিসপুরুষদের এই রোগ হয় ২০ থেকে ৪৫ বছরের দেখা যায়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ১৬ বছরের নীচে কিশোরদের মধ্যেও এই রোগ হতে পারে। কোনও আঘাত ছাড়াই হাঁটু, গোড়ালি বা শরীরের এক বা একাধিক গাঁট ফুলে যায়। ব্যথাও হয়। এই সমস্যাকে জুভেনাইল অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস বলা হয়। মেয়েদের এই রোগ হলেও, ছেলেদের তুলনায় কম।
 

কেন হয়

অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের হওয়ার কোনও নির্দিষ্ট কারণ নেই। এর মূলে জেনেটিক কারণকেই বেশি দায়ী করা হয়। বিশেষ করে, যাঁদের HLA-B27 নামক জিন আছে, তাঁদের অ্যাঙ্কাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশি।

আরও পড়ুন:

পুরুষদের যৌনক্ষমতা কমছে, সঙ্গমে জোয়ার আনতে কী করবেন?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৭: সুন্দরবনের শিশুরক্ষক পাঁচুঠাকুর

 

জটিলতা

গুরুতর অ্যানকিলোজিং স্পন্ডিলাইটিসে, দেহে নতুন হাড় তৈরি হতে পারে। এই নতুন হাড় ধীরে ধীরে কশেরুকার মধ্যে ব্যবধান পূরণ করে। অবশেষে কশেরুকার অংশগুলিকে ফিউজ করে দেয়। এতে মেরুদণ্ডের সেই অংশ শক্ত এবং নমনীয় হয়ে যায়। ফলে পাঁজরের খাঁচাকে শক্ত করে দিতে পারে এবং ফুসফুসের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ করে।

চোখের প্রদাহ হতে পারে। একে ইউভাইটিস বলা হয়। ইউভাইটিস হলে চোখে ব্যথা হয়। আলোর প্রতি সংবেদনশীলতা এবং দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হতে পারে।

কম্প্রেশন ফ্র্যাকচার। অ্যানকিলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের প্রাথমিক পর্যায়ে কারও কারও হাড় দুর্বল হয়ে যায়। দুর্বল কশেরুকা চূর্ণবিচূর্ণ হতে পারে। ভার্টেব্রাল ফ্র্যাকচারগুলি মেরুদণ্ডের কর্ড এবং মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে যাওয়া স্নায়ুগুলিতে চাপ দেয়। সমস্যা বাড়ে।

অ্যানকিলোজিং স্পন্ডিলাইটিস শরীরের সবচেয়ে বড় ধমনী মহাধমনীতে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। স্ফীত মহাধমনীটি এমনভাবে বড় হতে পারে, যেটি হৃৎপিণ্ডের অর্টিক ভালভের আকৃতিকে বিকৃত করতে পারে। এতে হৃৎপিণ্ডের কার্যকারিতাকে ব্যাহত হতে পারে। এই রোগের হৃদরোগের ঝুঁকিও বাড়ায়।

আরও পড়ুন:

পাখি সব করে রব, পর্ব-৫: জঙ্গল অভিযানের পরে অবশেষে দেখা মিলল মন ভুলিয়ে দেওয়া সেই রেইন কোয়েলের

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৪: সারদা মায়ের বিশ্বাসে জাগ্রতা হল দেবী সিংহবাহিনী

 

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

অ্যানকিলোজিং স্পন্ডিলাইটিস বা এএস নির্ণয় করতে এইচএলএবি-২৭ জিনের পরীক্ষা করা হয়। একে বলা হয়, পিসিআর বা জিন টেস্ট। এইচএলএবি-২৭ পজিটিভ হলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। আগে এক্স রে করে দেখা হত। সেক্ষেত্রে স্যাক্রো-ইলিয়াক জয়েন্টে পরিবর্তন দেখা দিলে ধরে নেওয়া হত অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস রোগ হয়েছে। তবে এটি একেবারে প্রাথমিক স্তরে থাকে বঝা যায়। অনেক ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় করতে এমআরআই করার প্রয়োজন হয়। পিসিআর ছাড়াও হিমোগ্লোবিন পরীক্ষা করে দেখা হয়। কারণ অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিসে ভগা রোগীদের অনেক সময়ে রক্তাল্পতার সমস্যা থাকে। ইএসআর-সিআরপি টেস্টও করা হয়। সাধারণত এই রোগীদের ইএসআর-সিআরপি বেশি থাকতে পারে। টেস্ট করে দেখা হয় ইউরিয়া-ক্রিয়েটিনিন-ও।

আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৯: সাসারামের ঝর্ণাধারা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

 

রোগ নিরাময় কী ভাবে হবে?

অ্যাঙ্কাইলোসিং স্পন্ডিলাইটিস রোগের প্রকোপ কমাতে লাইফস্টাইল পরিবর্তন করতে হবে।

নিয়মিত শারীরচর্চা করতে হবে। প্রাণায়াম, ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজ, স্ট্রেচিং, হাঁটাহাঁটি, সাঁতার বা সাইক্লিং করতে হবে। যাঁদের বয়স কম তাঁরা ভলিবল বা বাস্কেটবলও খেলতে পারেন। তবে ‘কন্ট্যাক্ট স্পোর্টস’ এরিয়ে চলতে হবে।

বাড়িতে ফিজিয়োথেরাপি থেরাপি করা যায়।

এই রোগে অনেক সময়ে অবসাদ দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে তাঁদের মানসিক ভাবে তরতাজা রাখতে সাহায্য করে।

ঈষদুষ্ণ জলে স্নান করতে হবে।

গরম খাবার খেতে হবে। দুধ সহ্য না হলে ঘরে পাতা দই কিংবা ছানা খাওয়া যায়। সামুদ্রিক মাছ খাওয়া যেতে পারে। সেই খেয়াল রাখতে হবে যাতে ভিটামিন-ডি এর না ঘাটতি হয়।

ধূমপানের অভ্যেস থাকলে তা ত্যাগ করা দরকার।

অনেককে কম্পিউটারের সামনে দীর্ঘক্ষণ কাজ করতে হয়। এতে কোমর, ঘাড়, পিঠে ব্যথা বাড়তে পারে। সমস্যার সমাধানে এক ঘণ্টা অন্তর উঠে কিছুক্ষণ হাঁটতে হবে। অনেকের চোখের সমস্যা দেখা দেয়। এর জন্য মিনিট কুড়ি মিনিট অন্তর কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে, আবার একই সময় ২০ ফুট দূরের কোনও কিছুর দিকে তাকাতে হবে। ২০ সেকেন্ড চোখ পিটপিটও করতে হবে।
 

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা

অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিসের নিরাময়ে হোমিওপ্যাথিকম খুবই কার্যকর। হোমিওপ্যাথি ওষধ লক্ষণ সাদৃশ্যের উপর নির্ভর করে রোগীর উপর প্রয়োগ করা হয়। তাই এক একটি ওষধ এক এক জন রোগীর উপর ভালো কাজ করে। তবে কিছু ওষধ এই রোগে খুব কার্যকর, যা রোগের লক্ষণ কমাতে ও দ্রুত রোগ মুক্ত হতে সাহায্য করে। যেমন:
মেডোরিনাম
পালসাটিলা
রাস টকস
ব্রায়োনিয়া
ক্যালকেরিয়া কার্ব
গুয়েকাম
থুজা ইত্যাদি

তবে হোমিওপ্যাথি ওষুধের কত পটেন্সি, কী পরিমাণে খেতে হবে তার জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করলে অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিলাইটিস-এর সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

* হোমিওপ্যাথি (Homeopathy–Health Tips): ডাঃ দেবজ্যোতি সাহা (Debajyoti Saha), বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক, মেডিকেল আফিসার, রিজিওন্যাল ইন্সিটিউট অফ ফারমাসিতুকেল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আগরতলা।

Skip to content