মধুপুর ধাম
● মধুপুর ধাম এখন বৈষ্ণবদের মিলনক্ষেত্র। সকাল হতে না হতে আসাম থেকে আগত বাসে কত ধরণের পুণ্যার্থীর ভিড় যে হয় বলার নয়। দুই বাংলার ভক্ত সমাগমও কম নয়। সেইসঙ্গে কোচবিহারের বহু ঐতিহাসিক গবেষক পুরাতত্ত্ববিদ অনেকেই এই মন্দিরের প্রাকৃতিক পরিবেশ, গাছপালা সজ্জিত স্থান ও পবিত্রতা অনুভব করে, দর্শনার্থী হিসেবেও অনেকে যান।
এই মধুপুর ধাম মন্দিরটি সম্পর্কে শোনা যায় মহারাজা প্রাণ নারায়ণ রাজবেশ ত্যাগ করে সাধারণ ভক্তের মতো প্রায়ই আসতেন এই নামে। তিনি ধামের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বহু জমি দান করে যান। পূর্বাঞ্চলের এই বৈষ্ণবগুরু শঙ্করদেব আচার সর্বস্ব তন্দ্রা চরের পাঠচক্রে জড়িয়ে যাওয়া হিন্দুধর্মকে নতুন জীবন দান করেছিলেন এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ভাগবত কথা সম্প্রসারিত করে এক ধর্মীয় ভাবের বন্যা এনেছিলেন।
ধর্মীয় উপদেশকে সাধারণ মানুষের বোধগম্য করার জন্য এবং লোক শিক্ষার জন্য তিনি সাধারণ মানুষের কথ্য ভাষায় রচনা করেন পুঁথি আর অনুবাদ করেন পুরাণের। তিনি ‘নাট’ প্রচলন করেন। অনেকে মনে করেন তাঁর প্রচলিত ‘নাটই’ বাংলা নাটকের আদিরূপ। সহজ বাংলা গদ্যসাহিত্য শঙ্করদেবের হাত দিয়েই রচিত হয়েছিল।
মহারাজা নরনারায়ণের রাজত্বকালে শঙ্করদেব অসম ত্যাগ করে কামতা রাজ্যে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। মহারাজ নর নারায়ণ তাঁকে আশ্রয় দেন। তাঁর নিবাস মধুপুর কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার কেন্দ্র। এখানেই তিনি দেহ রক্ষা করেন। এই মধুপুর ধামের প্রধান উৎসব দোল, রাস এবং শঙ্করদেবের আবির্ভাব তিথি।
বাণেশ্বর শিবমন্দির
● কোচবিহার রাজবংশ শিবভক্ত। রাজাই প্রতিষ্ঠা করেন এই শিবমন্দির। আকৃতিতে সাগর দীঘির পারের শিবমন্দিরের আদলেই তৈরি। কোচবিহার থেকে এই জাগ্রত বানেশ্বর শিবমন্দির ও তার চাতাল এবং চাতালের সঙ্গে লাগানো দিঘি অত্যন্ত শান্তির ও পর্যটকের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
কোচবিহার শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তরে কোচবিহার আলিপুরদুয়ার পাকা রাস্তার উপর এবং রেলপথে বাণেশ্বর রেলস্টেশনের পাশেই উত্তরবঙ্গ ও অসমের অগনিত ভক্তের তীর্থক্ষেত্র বাণেশ্বর শিবমন্দির। একদল ঐতিহাসিকের মতে, এই মন্দির বাণ রাজার নির্মিত। আবার অন্য অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে এর প্রতিষ্ঠাতা রাজা জল্পেশ। খেন বংশীয় রাজা নীলাম্বর প্রতিষ্ঠিত মন্দির বলেও অনেকে মনে করেন। আবার অন্যমত বলে, এটি মহারাজ প্রাণ নারায়ণের স্থাপিত। এই অঞ্চলের কিংবদন্তী, পৌরাণিক যুগে এই অঞ্চলে ছিল এক রাজ্য আর তার রাজা ছিলেন বাণ বা বাণাসূর। তাঁর গভীর ভক্তিতে তুষ্ট শিব শর্ত সাপেক্ষে শিবলোক থেকে যাত্রা করলেন বাণাসুরের সঙ্গে। রাজা বাণ কোনও কারণে মধ্যপথে থেমে শর্ত ভেঙে দিলে শিব অদৃশ্য হয়ে যান। পরে শিব কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে বংক্তি নদীর তীরে নিজ নামে শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন।
শিবের নামে যেমন হয় বাণেশ্বর, গের্দাসাণ্ডা গ্রামের নাম ও বাণেশ্বর হয়ে যায়। এখানেই রাজা শর্ত ভেঙে থেমেছিলেন। এ মন্দিরটি পশ্চিমমুখী এবং চারকোণ ঘরের মতো। কার্নিশ সামান্য বাঁকানো। মন্দিরের শীর্ষে আমলক, পদ্ম, কলস এবং ত্রিশূল। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে বিগ্রহ- সহ মন্দিরের মেঝে ও দেওয়ালের পূর্বদিক সামান্য হেলে গিয়েছে। মন্দিরের উচ্চতা ৩৫ ফুট, দৈর্ঘ প্রস্থ ৩১ ফুট এবং দেওয়ালের ঘনত্ব ৮ফুট। সামনে তিন ফুট বিস্তারের চত্বর। মন্দিরের প্রায় ২০ ফুট গভীরে শিবলিঙ্গ ও গৌরীপট্ট প্রতিষ্ঠিত।
মন্দিরের উত্তরে দেওয়ালের গায়ে বসান পাথরের একটি ছোট বিষ্ণুপট্ট ও পিতলের চন্ডী মূর্তি। বিষ্ণুপট্টতে প্রচলিত লক্ষ্মী সরস্বতী ছাড়াও অভিনব ভাবে গঙ্গা ও যমুনার মূর্তি অঙ্কিত আছে। দক্ষিণে উঁচু বেদীতে একটি ষাঁড় স্থাপিত। চালার উত্তরে টিনের চার চালা মন্দিরের ভিতরে শিব ও অর্ধনারীশ্বরের পিতলের মূর্তি পূজিত হয়। শিবটির আয়তন ৫ইঞ্চি বাই ৪ ইঞ্চি। এঁকে এক ত্রিরথ সিংহাসনের উপর পদ্মাসনে উপবিষ্ট দেখা যায়। তাঁর ডান হাত ভূমি স্পর্শ মুদ্রায় ও বাঁ হাত ধ্যান মুদ্রায় শোভিত বলে মনে হয় এটি বুদ্ধ মূর্তি। অর্ধ নারীশ্বরের মাপ ১১ ইঞ্চি বাই ১০.০৫ ইঞ্চি। শিব ও দুর্গার এই মিলিত রূপের মধ্যে দুর্গার দুটি হাতের একটি হাতে কর্তরী মুদ্রা এবং অন্যটিতে কর্কট মুদ্রা দেখা যায়। দোলপূর্ণিমা ও মদনোৎসবের সময় অর্ধনারীশ্বরকে কোচবিহার শহরের মদনমোহন মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। এইভাবে চলাচল করেন বলে এই মূর্তিকে ‘উৎসব মূর্তি’ বা ‘চলন্ত বাণেশ্বর মূর্তি’ বলে। অষ্টধাতুর এক ফুট ৬ ইঞ্চি উঁচু একটি মূর্তিকে বাণাসুরের মূর্তি বলে উল্লেখ করা হয়।
মন্দিরের দক্ষিণে মোহন দীঘি। ছোটবড় নানান মাপের এবং আকারের অসংখ্য কচ্ছপ দীঘিতে বাস করে। এদের সবার নামই মোহন। পুণ্যার্থীরা এদের জন্য খাদ্যবস্তু ছড়িয়ে দেন। যদিও এখানে নিত্য শিব পূজা হয়, তবু শিবরাত্রির উৎসবই প্রধান আকর্ষণ। বহু নাগা সন্ন্যাসী, অঘোরনাথ পন্থা সাধক এবং বৈষ্ণব ভক্ত এই উৎসবে যোগ দেন। শিবরাত্রির মেলার প্রধান বৈশিষ্ট্য মানতের পশুবলি। কোনও কোনও মানতের পশু ছেড়ে দেওয়া হয়। কতগুলি হাঁড়িকাঠে বলি হয়। আবার কতগুলি খুব নিষ্ঠুর ভাবে ফাঁস দিয়ে বা আছড়ে মারা হয়। অনার্য তান্ত্রিক প্রথা মত পায়রা বলিও এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে সময়ের সঙ্গে পদ্ধতিতে বহু বদল ঘটেছে।
ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধ নাথ শিবমন্দির
● কোচবিহার-দিনহাটার পাকা রাস্তার ডানদিকে কোচবিহার শহর থেকে ৪ মাইল দূরে অবস্থিত সিদ্ধ নাথ শিবমন্দির। পোড়ামাটির ফলকযুক্ত পঞ্চরত্ন বিশিষ্ট এই মন্দিরের মতো কোন মন্দির নেই এই জেলায়। বাঁকানো চালের উপর চারকোণে চারটি রত্ন। কিন্তু মাঝখানের বৃহত্তর রত্নটি অনুপস্থিত। উচ্চতায় এ মন্দির ৩০ ফুট এবং দৈর্ঘ প্রস্থে ২১ ফুট ৪ ইঞ্চি। মন্দিরের বাইরে দেওয়ালের খাঁজকাটা খোপে ৫৫টি পোড়ামাটির ফলক। ফলকে দশাবতার, পৌরাণিক দেবদেবীর মূর্তি ছাড়াও বন্দুকধারী পল্টন ও হাতে দূরবীন ব্যক্তির অলঙ্করণ দেখা যায়। ভিতরে দেয়ালের গায়ে মসজিদের মতো ‘মিহরাব’-এর উপস্থিতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। মন্দিরের স্থাপত্য রীতিতে মুসলমানী প্রভাব যথেষ্ট। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন মহারাজ উপেন্দ্র নারয়ণ এই মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই অনুমান অনুসারে এ মন্দির ১৮০ বা আরও বহু বছরের পুরোনো। মনে হয় মুসলমান আক্রমণে প্রথম মন্দিরটি ধ্বংস হয় এবং মসজিদে পরিবর্তিত হয়।—চলবে।
ঋণ স্বীকার:
●কোচবিহার পরিক্রমা
●উত্তর প্রসঙ্গ