শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির। ছবি: সংগৃহীত।

 

দেবদেউল কথা

মুসলমান আক্রমণে প্রথম মন্দির ধ্বংস হয় এবং মসজিদে পরিবর্তিত হয়। পরে আবার মসজিদটিকে মন্দিরে রূপান্তরিত হয়। কালক্রমে মন্দিরটি বসে গিয়েছে বলে মনে হয়। ভিতরের দেওয়ালে শহরের বিন্যাস করে আটকোণ ভিত্তির সৃষ্টি করে তার উপর সরাসরি গম্বুজ স্থাপন করা হয়েছে। গম্বুজের ভেতরে কেন্দ্রস্থল আবৃত করে একটি পদ্মের অলঙ্করণ ছিল তা স্পষ্ট বোঝা যায়। মন্দিরে প্রধান বিগ্রহ সিদ্ধনাথ শিবলিঙ্গ ছাড়াও একটি নারায়ণ শিলা এখানে পূজিত হন। শিবরাত্রির সময় এখানে এক মেলা হয়। বর্তমানে এই মন্দিরের রক্ষণাবেক্ষণের দায় দায়িত্ব ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ গ্রহণ করেছেন। এই মন্দির থেকে প্রায় সিকি মাইল দূরে শাহ পীরের দরগাহ। মহারাজা হরেন্দ্র নারায়ণ পীরের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ ৭৭ বিঘা পরপাল জমি দান করেন।

 

গোসানিমারি কামতেশ্বরী মন্দির

গোসানিমারি বা ভিতর কামতা মৌজার কামতেশ্বরী মন্দির কোচবিহারে বিখ্যাত ও ঐতিহ্যপূর্ণ দেবালয়। দিনহাটা রেলস্টেশন থেকে পশ্চিমে, প্রায় পাঁচ মাইল দূরে ভিতর কামতা মৌজায় অবস্থিত এই মন্দির। খৃষ্টিয় ১৫০০ শতকে সৌমরপীঠ কামরূপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কামতা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে। জনশ্রুতি খেন বংশীয় রাজা নীলধ্বজ ‘দেবী কামদা’ বা ‘কামতার’ উপাসক ছিলেন। উপাস্য দেবীর নাম অনুসারেই রাজ্যের নাম হয় কামতা এবং রাজধানীর নাম হয় কামতাপুর। নীলধ্বজই এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। চক্রধ্বজ ও নীলাম্বরকেও অনেকে এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন। জনশ্রুতি অনুসারে এই মন্দিরের প্রধান উপাস্য দেবী মহামায়া চন্ডীর একটি ‘কবচ কুণ্ডল’।

আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, পর্ব-১৪: মধুপুর ধাম, বাণেশ্বর মন্দির ও ধলুয়াবাড়ি সিদ্ধ নাথ শিবমন্দির

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২১: ওঠো ওঠো রে! বিফলে প্রভাত বহে যায় যে!

এই ‘কবচকুণ্ডল’টি দেবী তাঁর ভক্ত ভগদত্ত কে দান করেছিলেন। ভগদত্ত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবদের পক্ষে যোগদান করে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে শ্রীকৃষ্ণের কৌশলে পরাজিত ও নিহত হন। এক বাজপাখি কবচকুণ্ডল সহ খণ্ডিত অংশ বহন করে উড়ে যাওয়ার সময় কামতা রাজ্যে কবচ কুণ্ডল পতিত হয়। স্ফটিক কুড়ার পাশে শিমুল গাছের নীচে বহুদিন এই কবচকুণ্ডল প্রোথিত ছিল। মহারাজা এই সংবাদ জ্ঞাত হয়ে অক্ষয় কবচটি উদ্ধার করেন এবং মন্দির নির্মাণ করে সেখানে এই কবচের নিত্য পূজার ব্যবস্থা করেন। পুরোনো মন্দিরটি ১৬৬১ খ্রিস্টাব্দে মীর জুমলার আক্রমণে ধ্বংস হয়। ১৬৬৫ খৃষ্টাব্দে মহারাজা প্রাণ নারায়ণ এই মন্দিরের পুন:সংস্কার করেন।
এই মন্দির এখন ভবানী মন্দির নামেও উল্লেখ করা হয়। মন্দিরে প্রবেশের দুটি দ্বার। প্রধান প্রবেশ দ্বার পশ্চিমদিকে এবং অন্যটি দক্ষিণ দিকে। প্রধান দ্বারের উপর নহবতখানা। মন্দির প্রাঙ্গণের দক্ষিণ পূর্ব কোণে শিবলিঙ্গ ও পালযুগের একটি সুন্দর বিষ্ণুমূর্তি। দক্ষিণ পশ্চিম কোণে আর একটি শিবলিঙ্গ আছে। মূল মন্দির ও হোম ঘর বাংলা চার চালা রীতির চারকোণা ঘরের বাঁকানো কার্নিশের উপর গোলার্ধকার গম্বুজ স্থাপন করে গঠিত। ভিতরের দেওয়ালে চারদিকে খিলান ও তার পাশে লহরা। গর্ভগৃহে দুটি সিংহাসনে শিবলিঙ্গ, ব্রহ্মা, শালগ্রাম শিলা, অষ্টধাতুর গোপাল মূর্তি ও ব্রোঞ্জের সূর্যমূর্তি প্রতিষ্ঠিত। দু’ হাতে তার পদ্ম পাশে চন্ডী, পিঙ্গল, ঊষা, প্রত্যুষা ও অরুণকে দেখা যায়। সম্ভবত মূর্তিদুটি সেন যুগের। মন্দিরের উচ্চতা প্রায় ৪৫ ফুট, দৈর্ঘে প্রস্থে ২৮ ফুট ৯ইঞ্চি। এই মন্দিরের প্রধান উৎসব হল বৈশাখ মাস জুড়ে দেবী পূজা ও হোম। বহুসংখ্যক পাঁঠা কবুতর বলি হয় এখানে। মাঘ মাসে দেবী স্নান ও বিশেষ পূজা হয়। নিত্যপূজা হয় দশোপচারে। বিশেষ পূজা হয় ষোড়শপচারে।
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

পরিযায়ী মন, পর্ব-১১: ঘরের কাছে জলমহল—চাঁদনি জলটুঙ্গি

প্রধান প্রধান এই দেবদেবীর মন্দির ছাড়াও বিভিন্ন মহকুমায় ছড়িয়ে আছে অসংখ্য দেবদেবীর মন্দির। যেমন তুফানগঞ্জে চারটি গ্রামে আছে ঘূর্নেশ্বরী দেবীর মন্দির এবং বাজারের কাছে উঁচু ঢিবির উপর আছে গিরিধারী লাল গোপী বল্লভ মন্দির। নাককাটি গ্রামে আছে ষন্ডেশ্বর বা যোগেশ্বর মন্দির। বারোকোদালীতে রামেশ্বর ও ভুচু গামারি তে আছে বলরাম ঠাকুরের মন্দির। বালেশ্বরের সিদ্ধেশ্বরী গ্রামে সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের মত মন্দির কোচবিহারে প্রায় দেখা যায় না। মন্দিরটি আট কোণা এবং গম্বুজ শোভিত। এই মন্দিরের পশ্চিমে আছে এক কামরাঙা গাছ। স্থানীয় ভক্তদের কাছে এই গাছটি কামাখ্যা দেবী জ্ঞানে পূজিত হয়। এছাড়াও ছোট ছোট আর ও অনেক মন্দির ছড়িয়ে আছে এই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে।
কোচবিহার শহরের এক উল্লেখযোগ্য মন্দির হল ব্রাহ্ম মন্দির। এই মন্দিরটি ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে মহারাজ নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত হয়। গোসানীমারির মন্দির নিয়ে নানা কথা প্রচলিত। আমাদের সঙ্গে যেসব রাজবংশীয় ছাত্রীরা পড়ত, রায়, নারায়ণ ইত্যাদি পদবী যাদের, তারা গোসানীমারির মন্দিরে যেতনা। স্থির বিশ্বাসে তাদের বলতে শুনেছি রাজবংশীয় কেউ ওই মন্দিরের ভিতরে প্রবেশ করলে পাথর হয়ে যেতে হয়।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৯: সুন্দরবনের জঙ্গল-জননী বিশালাক্ষী

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১৬: শ্রীমায়ের সাধনা

শোনা যায় বিশিষ্ট রাজপুরোহিত দেবীর পূজা কালে দরজা বন্ধ রেখে পূজা করতেন। শোনা যায় তৎকালীন মহারাজ প্রায় বলপূর্বক ওই মন্দিরের দরজা খুলে ভিতরে ঢোকেন। তারপরই দেবী মহামায়ার অভিশাপ গ্রস্ত হন। সেই থেকে রাজবংশ স্থির বিশ্বাসে আজ ও অনেকেই গোসানিমারির মন্দিরে প্রবেশ করেনা। এর সত্য মিথ্যা সম্পর্কিত প্রশ্ন উঠলেও এই ব্যাপারটি তারা বিশ্বাস করেছে বহুদিন। এখনও কারও কারও কথায় প্রসঙ্গটি উঠে আসে। —চলবে।

ঋণ স্বীকার:
কোচবিহার পরিক্রমা
উত্তর প্রসঙ্গ
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

Skip to content