শনিবার ৬ জুলাই, ২০২৪


মদনমোহন বাড়ি। ছবি: সংগৃহীত।

 

দেব-দেউল কথা

কামতা-বেহার রাজ্যের মহারাজারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেবদেবীর আরাধনা করেছেন। তাঁদের বিশ্বাস, স্বপ্নকে কেন্দ্র করে কোথাও গড়ে উঠেছে মসজিদ, কোথাও গড়ে উঠেছে দরগা, মাসান পাট, গির্জা, ব্রাহ্ম মন্দির, জৈন মন্দির ইত্যাদি। কামতা রাজ্যের অধিপতি কান্তেশ্বরের উপাস্য দেবী কামদা বা গোসানী দেবী। বেহার অধিপতি বিশ্বসিংহ ছিলেন শিবের উপাসক অর্থাৎ শৈব। এরপর রাজপরিবারের উপাস্য দেবী হলেন ‘দেবী ভবানী’। পরবর্তীকালে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হলেন মহারাজ প্রাণ নারায়ণ। রাজ পরিবারের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে নতুন ধর্ম, উপাস্য দেবতা হলেন ‘বিষ্ণু’ লক্ষ্মী নারায়ণ। শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব এই তিন স্তর পেরিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মহারাজারা প্রভাবিত হলেন ব্রাহ্মধর্মের প্রভাবে।

রাজ্যের প্রজারা অবশ্য শক্তি, শিব এবং বিষ্ণু এই তিন দেবদেবীকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় চেতনা প্রবহমান রাখে। প্রজাদের আর এক অংশ ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ রইল। ধর্মীয় চেতনার এই বিবর্তনের ছাপে উল্লেখযোগ্য একটি বিষয় হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, যা কিনা রাস মেলার রাস চক্র তৈরি, দেবীবাড়ির বিশিষ্ট দেবীর কোচবিহারের রাজার রীতি অনুযায়ী পুজো, এসবে স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। আধুনিকতার বুননে সম্প্রীতির স্পষ্ট ইঙ্গিত আজো চলেছে নতুনভাবে নবধারায়। কোচবিহারের দেব দেউলের মধ্যে প্রথমেই যার কথা আলোচনায় আসবে সেটি কোচবিহার শহরের বিখ্যাত মদনমোহন মন্দির।

বিষ্ণুর অবতার মূর্তি। মদনমোহন মন্দিরের ভবানীর মন্দিরের বারান্দায়। ছবি: লেখিকা।

 

মদনমোহন মন্দির

কোচবিহারের রাজাদের কুলদেবতা মদনমোহন। একসময় এই মন্দির ছিল রাজবাড়ির সীমানায়। ১৮৮৯ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণ বৈরাগি দীঘির উত্তর পাড়ে সাত বিঘা তেরো কাঠা জমির উপর এই মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই মন্দিরের জন্য মোট ব্যয় হয় ১৯,৫১০ টাকা। ঠাকুরের অলঙ্কার, মন্দিরের অন্যান্য ভোগের জিনিস এবং রাজস্ব থেকেও অর্থ সংগ্রহ করা হত। ১৮৯০ সেলের ২১ মার্চ মন্দিরে অষ্টধাতু নির্মিত বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কোচবিহারের অধিকাংশ মন্দিরের মত এটাও বাংলা চার চালার অনুকরণে চারকোণ ঘরের বাঁকানো কার্নিশের উপর গম্বুজ বসিয়ে বানানো। তবে পাশাপাশি চারটি ঘর থাকায় দালান মন্দিরের প্রভাব ও কিছু প্রতিফলিত।

আরও পড়ুন:

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১০: সাবিত্রীদেবীর দৃষ্টিতে টুকরো সময়

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

মদনমোহনের ঘরের উপরেই প্রধান গম্বুজটি স্থাপিত। তার উপর পদ্ম, কলস, আমলক প্রভৃতি পর পর সাজান আছে। মন্দিরের সামনে সমতল ছাদের বারান্দা। ১২১০ ফুট বেষ্টনী দৈর্ঘ্যের আয়তাকার পাঁচিল ঘেরা মন্দিরের প্রবেশ দ্বার দক্ষিণমুখী। প্রবেশ দ্বারের শীর্ষে নহবতখানা। ডানদিকে বাঁদিকে সংকীর্ণ অফিস ঘর। সবচেয়ে বড় কথা রাধা বিহীন মদনমোহন ঠাকুর এখানে বিশিষ্ট। মদন মোহন ঠাকুরের ঘরের দুই পাশের ঘরে তারা (পূর্ব দিকে) এবং শ্বেত পাথরে বানানো মহাকালের উপর দাঁড়ানো কালীমূর্তি (পশ্চিম দিকে) প্রতিষ্ঠিত।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৭: নাক বন্ধ হলেই নাকের ড্রপ? এতে শরীরে কোনও ক্ষতি হচ্ছে না তো?

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

মূল মদনমোহন মন্দিরের পূর্বদিকে ইটের তৈরি চার চালার উপর গম্বুজ, পদ্ম, কলস, আমলক শোভিত দেবী ভবানীর মন্দির। এই মন্দিরের উচ্চতা ভিত্তি-সহ ২৮ ফুট প্রায়। রূপোর সিংহাসন প্রতিষ্ঠা দেবী ভবানী মূর্তিটি মাটির তৈরি এবং লাল রঙের। এই মূর্তির সঙ্গে কোচবিহারের দুর্গার সাদৃশ্য আছে। লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ—এই দুই ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। তবে বাঁয়ে ও ডাইনে জয়া ও বিজয়া ভবানীর পাশে শোভিতা। দশভূজা দেবী ভবানীর বাঁদিকে সিংহ এবং দক্ষিণে বাঘের উপর স্থাপিত। এ প্রসঙ্গে এই উল্লেখনীয় ব্যাপার যে, মহারাজারা কোচবিহারের প্রতিটি মহকুমা শহরে একটি করে মদনমোহন ঠাকুরবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন।

মদনমোহন মন্দিরের সামনে। ছবি: লেখিকা।

মদনমোহন বাড়ি কোচবিহারের মানুষের প্রাণের সম্পদ এবং প্রাণের ঠাকুর। কোচবিহারবাসীর যেকোনও পুণ্য পবিত্র কাজে প্রথম প্রণম্য স্থান এই মদনমোহন বাড়ি। তাকে ঘিরেই শৈশব থেকে প্রাজ্ঞ হয়ে ওঠা। রাস মেলার মূল পূজা নিয়ে পনের দিন ধরে প্রায় মাসখানেক যে মেলা, পৃথিবীর অন্যতম সেটিও এই মন্দির ঘিরেই। মনে আছে আমার বিবাহের আয়োজন হয়েছিল নিবন্ধীকরণে। কিন্তু মদনমোহন বাড়ির নহবতখানা আমার বাড়ির বিয়ের তোরণে বসেছিল। বাবা বিশেষ অনুমতি নিয়ে এই নতুন ব্যবস্থা প্রথম করেন ১৯৮৮ সালের ৪ ডিসেম্বর।
আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১১: মাতৃরূপে প্রথম পুজোগ্রহণ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

শৈশব বেলার মদনমোহন বাড়ির ভবানী মন্দিরের কথা মনে পড়ে। যেখানে সিড়ি পেরিয়ে বারান্দা বা দর দালানে পা রাখলেই পুরো গোল বারান্দা জুড়ে সাতপাক ঘোরার স্মৃতি মনে পড়ে। বড়রা পুজোয় ব্যস্ত, আর আমি ও ছোটরা ভবানী দেবীকে কেন্দ্র করে ঘুরেই চলেছি। এই চরকি পাক আজ ও ঘুরছি। ওই স্মৃতিতে এখনও সেই শিশুকালেই দাঁড়িয়ে আছি।

বিশেষত রাস পূর্ণিমার দিনের রাস চক্র ঘুরিয়ে কোচবিহারে আলো ঝলমল রাস মেলার উদ্বোধনের কথা মনে পড়ে। তারপর থেকে দিন পনেরো-কুড়ি রাতের শহর জোড়া যে আবহ সে পৃথিবীর অন্যতম ‘সব পেয়েছির আসর’। আমার বহু লেখায় এই আসরের কথা লিখেছি। বিশেষত, ভবানী মন্দিরে সামনের বারান্দায় পিতলের তৈরি বিষ্ণুর অবতার মূর্তি সব লাল শালুকের মোড়া ঐতিহ্যবাহী। এদের ওই বিশেষ কয়দিন প্রদর্শনের জন্য বের করা হয়। মূর্তিগুলোর সামনে দাঁড়ালে মোহাবিষ্ট হতে হয়। রাস চক্র ঘুরিয়ে প্রণাম মাধুর্য লেগে থাকে আজীবন। রাস চক্রের বাঁশ ও কাগজের নানা সূক্ষ্ম কাজ সর্বত্র শিল্পীর হাতের ছোঁয়া।

রাজবাড়ির পিছনে উদ‍্যান মাঠে ছাত্রীরা। ছবি: লেখিকা।

বর্তমানের আলতাফ মিঞার পরিবারের যুক্ত থাকা। তাঁর পূর্বপুরুষ এবং তিনিও একজন মহান শিল্পী। আর সবচেয়ে বড় পরিচয় এই মদনমোহন ঠাকুর বাড়ি সর্বধর্ম সমন্বয়ের এক পবিত্র ক্ষেত্র। যত দিন যাচ্ছে উঠে আসছে রাজনগরের বিশাল ব্যাপ্তি। মেলার বিভিন্ন চত্বরে দেশ বিদেশের পণ্যদ্রব্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি, রকমারি আসবাব, অলঙ্কার, ঠাকুর ঘরের নৈমিত্তিক দ্রব্য, রান্নাঘরের যা কিছুর অভাব গৃহিনীরা জমিয়ে রাখেন কবে রাসমেলা আসবে… সেই কার্তিক মাস সেই মদনমোহন বিগ্রহের বারান্দায় ফুলের অলঙ্কারে সজ্জিত মোহন রূপ, এতে মেতে ওঠে কোচবিহার। পুরো শহর পরিনত হয় হরবোলায়। এমন কীর্তি রেখে গেছেন ওই মহানুভব রাজারাই। —চলবে।

ঋণ স্বীকার:
কোচবিহার দর্পণ, উত্তর প্রসঙ্গ, মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস।
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

Skip to content