শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


কেশব আশ্রম। ছবি: সংগৃহীত।

নৃপেন্দ্রনারায়ণ এবং গজেন্দ্র নারায়ণের প্রপিতামহ ছিলেন হরেন্দ্র নারায়ণ। কোচবিহারে নববিধান ব্রাহ্ম সমাজের প্রথম সম্পাদক ছিলেন গজেন্দ্র। সাবিত্রী দেবীর লেখা আত্মকথা থেকে জানা যায় যে, কোচবিহারে সে সময় ব্রাহ্মপল্লী, ব্রাহ্ম বোর্ডিং, গ্রন্থাগার, কেশব আশ্রম প্রভৃতি স্থাপন করা হয়েছিল। কেশবচন্দ্র সেনের জন্মদিন উপলক্ষে ১৯ নভেম্বর কল্পতরু হত। সাজানো হত আলোক মালায়। ছোটদের মধ্যে খেলনা বিতরণ করা হত।

এছাড়া প্রার্থনা, সংকীর্তন-সহ সমাগতদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা তো ছিলই। বেশ কয়েকবার এই উৎসবে ‘ব্রহ্মানন্দ ভোজ’ হয়। তখন বহু গরীব দুঃখী মানুষকে পাত পেড়ে ভাত ডাল তরকারি দই, মিষ্টি খাওয়ান হত। অনেককে আবার দই-চিঁড়ে প্রচুর পরিমানে খাওয়ান হত। নগর সংকীর্তন চলত। স্থায়ী ভাবে কোচবিহারে ব্রহ্ম মন্দির হওয়ার আগে সাগর দীঘির ধারে সেই সময়ের জেঙ্কিন্স স্কুল গৃহে রবিবার উপাসনা চলত।
সাবিত্রী লজে একটি নীতি বিদ্যালয় ছিল। সেখানে অনেক ছেলে মেয়ে একত্রিত হত। সেখানে উত্তম সব শ্লোক রচনা এবং সদুপদেশ দেওয়ার সুব্যবস্থা ছিল। শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত সব মহিলাদেরই একত্রিত হওয়ার মিলন স্থানের বড় অভাব ছিল সেই সময়। সাবিত্রী লজ তাঁদের এই অভাব মিটিয়ে দিয়েছিল। মেয়েদের হাতের কাজ শেখানোর ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া জামা, কামিজ তৈরি করতে শেখানো, রান্না করা খাবার ও জেলি তৈরির পদ্ধতি শেখানো হত। সাবিত্রী দেবীকে তাঁর কাকাবাবু একবার বলেছিলেন, ‘মা, তুমি এই স্ত্রীলোকদিগের যে এত উন্নতি করিতেছ, ইহাই আসল কাজ হইতেছে।’

এরকম শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে দিয়েই সামাজিক, ধার্মিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি হতে থাকে। কর্ম শিক্ষা এবং মেয়েদের সাবলম্বী করে তোলার কাজ চলতে থাকে। স্থানীয় ছেলে মেয়েদের নিয়ে বহু অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়। কোচবিহারের ল্যান্সডাউন হলে নানা অনুষ্ঠানও হয়েছে এ সময় থেকেই। এখানে একটি ‘আনন্দবাজারের’ আয়োজন করা হয় মেয়েদের নিয়ে। সেখানে মেয়েদের হাতের তৈরি জিনিস মেয়েরাই কেনাবেচা করত।
আরও পড়ুন:

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৭: প্রকৃত শাসক মহারাজ, একটি রাজ্যের আলোয় উত্তরণ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা

এগুলো ছাড়াও উপাসনার সাহায্যকারী আসন, গৈরিক, একতারা, খোল, করতাল, পতাকা, ধূপ, ধুনুচি, ধূপদানী ইত্যাদি মহিলা ও বালক-বালিকাদের উপযোগী নানারকম জিনিস প্রদর্শনী ও বিক্রির জন্য থাকত। এই ‘আনন্দবাজার বিষয়ক’ একটি সেই সময়ের বিজ্ঞপ্তি কোচবিহার গেজেটে ১৪ এপ্রিল ১৯১৯ সালে প্রকাশ করা হয়। সংবাদটি এরকম:
 

আনন্দমেলা

“১৩২৬ সালের ৬ই, ৭ই এবং ৮ই বৈশাখ (১৯১৯ সালের ১৯-এ, ২০-এ ও ২১-এ এপ্রিল) শনিবার, রবিবার ও সোমবারে কোচবিহার স্থান ল্যান্সডাউন হলে বাৎসরিক আনন্দবাজার হইবে। ৬ই ও ৮ই বৈশাখ শুধু মহিলাদের জন্য এবং ৭ই বৈশাখ সর্বসাধারণের জন্য হইবে। মধ্যাহ্নে ১২টা হইতে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকিবে। পূর্ণবয়স্কদিগের প্রবেশমূল্য এক আনা (বর্তমান ৬ পয়সা) ও বালক-বালিকাদের দুই পয়সা (বর্তমান ৩ পয়সা)। কোচবিহারবাসী যে কোনও ব্যক্তি ইচ্ছা করিলে নিম্ন ঠিকানায় দ্রব্যাদি বিক্রয়ার্থে প্রেরণ করিতে পারিবেন। প্রতি দ্রব্যে মূল্য এবং প্রেরণকারীর নাম ও ঠিকানা স্পষ্ট অক্ষরে লিখিত থাকিবে নচেৎ বাকি দ্রব্য এবং বিক্রিত দ্রব্যের মূল্য ফেরৎ পাঠাইবার জন্য কেহ দায়ী হইবেন না। দ্রব্যাদি ২৭শে চৈত্রের (১০ই এপ্রিল) পর গৃহীত হইবে না।”

সুনীতি অ্যাকাডেমি। ছবি: সংগৃহীত।

একটু বিস্মিত হতে হয় না কি! কোচবিহারের নারীরা উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগরণের আলোয় কীভাবে আলোকিত হয়েছিলেন, সময়ের আগেই! রাজকর্মচারী, বহিরাগত কর্মচারীর পরিবারের মেয়েরা যেমন এতে অংশ নিতেন তেমনি সাধারণ প্রজারাও ধীরে ধীরে এতে অংশ নিতে শুরু করে। স্থানীয় মহিলা বা মেয়েরা অনেকেই রাজপরিবারের প্রতি শ্রদ্ধা সম্ভ্রমে এবং ভক্তিভরে দূরত্ব বজায় রেখেও চলেছে।

সুনীতিদেবী রাজমাতা হিসেবে বেশ কিছু সময় কোচবিহার থেকে রাজ্য পরিচালনায় সাহায্য করেছিলেন। তিনি কোচবিহারে একাধিক প্রজা হিতকর কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত ছিলেন। শিক্ষা, সমাজনীতি, রাজনীতি, নারীশিক্ষা সর্বত্র রাজ পরিবার, রাজা, মহারানি সকলের অবদান যেমন, তেমনই সাহিত্যক্ষেত্রে এঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। সুনীতিদেবী নিজে বিদুষী ও সুলেখিকা ছিলেন। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে আধুনিক (মহিলা) কবির দু’একটি পংক্তি উল্লেখ করতে ইচ্ছে হল…

“আমাদের কোনও ভৌগোলিক সীমানা নেই
কোন নদী নেই
কোন মানুষ নেই
নিজস্ব কিছু ছিল না কোনওদিন”


***

“নদী জলে খুব সাঁতারের পর
দু’ হাতের ভাঁজে ফুলে ওঠা চোখে
নদীকে ভেবেছি আমার-আমারই তো
সে ও কখনও ছিল না নিজস্ব
স্রোতের মুখ ঘুরে গেছে অজস্র
সবুজ উপত্যকার দিকে…(অমীমাংসিত)”
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

এই যে নিঃসঙ্গতা, নারীর কিছুই নিজস্ব না এই বোধ থেকে বহু আগেই উত্তরণের পথ দেখিয়েছিলেন রাজ অন্তঃপুরের নারী। দুর্বিষহ একাকীত্ব, সপত্নী যন্ত্রণা সবকিছু থেকে সরে এসে মহারাজা নরনারায়ণের (১৫৫৪-১৫৮৮) মহিষী ভানুমতী অহম নৌ বহরের যুদ্ধে নিজে তীর ধনুক নিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন, রাজার সঙ্গে রাজ কাজে অংশ নিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দূরদর্শিতা, প্রজা হিতের পরিকল্পনা, শিক্ষানুরাগী কথাও ইতিহাসে আছে। পুত্রদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষা দেবেন বলে সংস্কৃত পণ্ডিত পুরুষোত্তম বিদ্যাবাগীশকে নিয়ে ‘প্রয়োগ রত্নাবলী’ ব্যাকরণ রচনা করিয়েছিলেন। আজ ও পণ্ডিত মহলে এ বই আদৃত। গ্রন্থটির রচনাকাল ১৫৬৮ সালে। এ তথ্য আছে গন্ধর্ব নারায়ণের বংশাবলীতে।

“নৃপতির প্রিয়তমা ভানু পাটেশ্বরী।
ভট্টাচার্য আগে কথা কহিলা সাদরি।।
পাণিনির বর্ণক্রম গ্রন্থনে লিখিবা।
মহেশের কৃত কলাপের ক্রম দিবা।।”
আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২৬: অবশেষে চার হাত এক হল, পঞ্চম-আশা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে শুরু করলেন দ্বিতীয় ইনিংস

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১১: সুন্দরবনের ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণ রায়

এরপর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ১৮৫৮ সালে ‘বেহারোদন্ত’ নামে কবিতার ছন্দে একটি আত্মজীবনীমূলক ইতিহাস রচনা হতে দেখি, রচনাকার বৃন্দেশ্বরী দেবী। মহারাজ শিবেন্দ্র নারায়ণের পত্নী তিনি।

গ্রন্থটিতে নারীদের মানসিকতা, অলঙ্কার প্রিয়তা, অলঙ্কার ও রূপচর্চার দ্রব্য ও তার পদ্ধতি কেমন তার নিখুঁত বর্ণনাও আছে। এ বইটি বাংলা সাহিত্যচর্চায় আত্মজীবনী মূলক রচনায় একটি বিশেষ স্থান নিয়েছে। এদিক থেকে তাঁকে প্রথম মহিলা কবি ও আত্মজীবনীকার ও বলা যেতেই পারে।

শিবেন্দ্র নারায়ণের অন্য মহিষী কামেশ্বরী দেবীর নির্দেশে নরেন্দ্র নারায়ণের রাজত্ব কালে “মহারাজ বংশাবলী” নামে একটি ইতিহাস লেখা হয়। প্রথমে এটি পুঁথি আকারে থাকলেও পরে মুদ্রিত হয়। গদ্যে লেখা এ ইতি কথায় সে সময়ের বহু গুরুত্বপূর্ন তথ্য আছে।
এই ধারাবাহিকতায় এর পরই যাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে কোচবিহারের সাহিত্য ইতিহাসেই শুধু নয়, বাংলা সাহিত্যে স্থান করে নেওয়ার যোগ্য তিনি আমাদের মহারানি সুনীতিদেবী, যিনি সমস্ত আধুনিকতার পালে হাওয়া লাগিয়েছিলেন। তাঁর জন্মের দেড়শো বছর আমরা অতিক্রম করেছি ঠিকই, মানুষের হৃদয়ে আজো উজ্জ্বল সে নাম। দেশের প্রথম মহিলা হিসেবে ব্রিটিশ প্রদত্ত “ক্রাউন অফ ইন্ডিয়া” উপাধিতে ভূষিত তিনি।

রাজ-ভবন। ছবি: সংগৃহীত।

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত এক সংস্কার মুক্ত পরিবেশে বড় হয়েছিলেন সুনীতি দেবী। ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন। কোচবিহারে নারী শিক্ষার প্রতিষ্ঠা ও প্রসারে সুনীতি দেবীর ভূমিকা অপরিসীম। নতুন ভাবনায় তৈরি করেন “সুনীতি অ্যাকাডেমি”, যা আজ ও শত সহস্র শিক্ষার প্রদীপ জ্বেলে নারীদের আজো পথ দেখায়। এ প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের বিনামূল্যে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা করেন তিনি। সে সময় স্থাপিত কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইন্সটিটিউশনও সুনীতিদেবীর দানে সমৃদ্ধ ছিল। তিনি ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য। তাঁর অন্তরের সাহিত্য সূচনায় ঠাকুরবাড়ির অবদান অনস্বীকার্য। তিনি বাংলায় দশটি, ইংরেজিতে প্রায় আটটি গ্রন্থ রচনা করেন। কোচবিহারের রাজাদের শৌর্যবীর্যের পাশে সুনীতি দেবীর নাম সমান ভাবে স্মরনীয়। ইংরেজিতে প্রথম ভারতীয় মহিলা জীবনীগ্রন্থ লেখক মহারানি সুনীতিদেবী। বইয়ের নাম’ The Autobiography of the Indian Princess’ (১৯২১)। বাংলা সাহিত্যচর্চায় নারীদের অবদান বিষয়ে আলোচনায় সুনীতি দেবীর সাহিত্য চিন্তার গৌরবময় অধ্যায় টিকে মনে রাখতে হবে।

পরে ১৮৮২ সালে দিনহাটায় নারীশিক্ষা প্রসারে নৃপেন্দ্রনারায়ণের প্রথম পুত্র রাজকুমার রাজ রাজেন্দ্র নারায়ণের নামে রাজকুমার বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। সেখানে বিরাজকান্ত সিংহ ছিলেন প্রধান শিক্ষক ও তাঁর স্ত্রী হিরণবালা দেবী সহ-শিক্ষিকা ছিলেন। জেলায় তিনিই প্রথম মহিলা যিনি দীর্ঘদিন সরকারী চাকরী করেছেন। গজেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী সাবিত্রী দেবীর নাম পৃথক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার দাবি রাখে। পরের পরবে তাঁর উল্লেখ করব।

ঋণ স্বীকার:
উত্তরপ্রসঙ্গ, সম্পাদনা দেবব্রত চাকী (কোচবিহার জেলা সংখ্যা)
কোচবিহার কথা, ড. নৃপেন্দ্রনাথ পাল
রাজনগরের নারী, সেকাল-একাল: মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস
কবিতা: অমীমাংসিত, কবি: মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস, কাব্যগ্রন্থ, “সবুজ দোতারার ভালবাসা” (সিগনেট, আনন্দ)
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

Skip to content