মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


সুনীতি দেবী।

নাবালক রাজা এক কথার মানুষ। সাফ জানিয়ে দিলেন, সুনীতিকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করা তার পক্ষে কোনওদিনই সম্ভব নয়। জানালেন, বিয়ে যদি না হয় তবে সূর্যের আলো ফোটার আগেই ঘোড়ায় চেপে দু’চোখ যেদিকে যায় সেদিকে চলে যাবেন। এই বলে ঘুমোতে গেলেন রাজা। ঘুমের দেখা কি পাওয়া গিয়েছিল সে রাতে! আমরা নিশ্চিত কল্পনা করতে পারি, না। ঘুম ছিল না তাঁর। তেমনি সমস্ত কোচবিহার না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে রাত।

বাদ্য বাজনা ধীরে ধীরে থেমে গেল। মঙ্গল শঙ্খ স্তব্ধ হল। উৎসবের সাজে সজ্জিত আলোয় ঝলমল কোচবিহার শহরের বুকে অন্ধকার আর রাতের স্তব্ধতা নামে ধীরে। সকলেই ধরে নিলেন, এ বিয়ে আর হবে না। অন্ধকারের বুক চিরে অসংখ্য গুজব ছড়িয়ে কোচবিহার শহর ছেয়ে গিয়েছিল সে সময়। এ ভাবেই কখন পেরিয়ে গিয়েছে মাঝরাত। বিয়ের শেষলগ্ন প্রায় শেষ। কিন্তু ওই যে কথায় আছে ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’! কে খন্ডাবে, আর জন্ম, মৃত্যু, বিয়ের কথা বলেন তো ওই নির্ধারণ কর্তা একজনই।

যখন সকলে নৃপেন্দ্রনাথ, সুনীতি দেবীর বিয়ে ভেঙে গিয়েছে ভাবছেন, তখন আড়ালে দাঁড়ানো ‘এক ঈশ্বর’ অলক্ষ্যে যেন হেসে উঠেছিলেন। এরই মধ্যে বিপর্যয়ের খবর কলকাতায় পৌঁছে গিয়েছিল। বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর কোচবিহারের প্রতিনিধি মি. ডাল্টনকে ‘তার’ করে জরুরি নির্দেশ দিলেন—”let the marriage be performed according to the rites as settled in Calcutta”
মি. ডাল্টন খুব দ্রুতই মাঝরাতেই চলে এলেন মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেনের ঘরে। তখন কেশবচন্দ্র ধ্যান মগ্ন। ঈশ্বরের নির্দেশ অপেক্ষায়। হতাশায় ম্লান হয়ে যাওয়া মুখে মি. ডাল্টন কেশবচন্দ্রকে বললেন— “Mr. Sen, the wedding must and shall take place to night. The service shall be exactly as you wish. I’ll be there to see that it is not inter fered with come quickly. We have not a moment to lose. There is another auspicious hour at 3 am. set it be then.”

মি. ডাল্টন একরকম জোর করেই যেন মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেনকে ধরে নিয়ে গেলেন। মুহূর্তেই সব মেঘ উবে গেল। হাউই আর আতশবাজির আলোয় আর শব্দে ঘুমন্ত কোচবিহার জেগে উঠল। ততক্ষণে সানাই আবার তান ধরেছে। বাজছে বিয়ের বাদ্য। মঙ্গল শঙ্খ ও আকাশের বুক চিরে পরম মুহূর্তটির খবর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিল। সুনীতি দেবী লিখলেন—
“I went through the ceremony with perfect confidence. The service was performed by the Rev. Gour Govinda Roy. Who was one of the staunchest missionaries of our Church and all the Maharajah’s Hindu Priests were also present.”
আরও পড়ুন:

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৫: রাজবাড়ি এবং অভিনব বিবাহপর্ব

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

সুনীতি দেবী এবং নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ পর্ব অবশেষে অনেক দ্বিধা, সংশয়, বহু মতান্তরের পর লক্ষ কথা ব্যয় করে সম্পন্ন হল। বোধহয় ভারতে স্মরণাতীত কালে এমন বিতর্কিত এবং আলোড়ন সৃষ্টি করা বিবাহের দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ব্রাহ্মধর্মের অনুগামীরা ভারত জুড়ে ব্রাহ্মধর্মের অবিসংবাদী নেতা মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা করেন। অন্যদিকে ব্রাহ্মধর্ম ও হিন্দুধর্মের মধ্যে একরকম ঠান্ডা যুদ্ধ চলতে থাকে। এমনকি, কোচবিহারের হিন্দু প্রজারা ও এই বিবাহ খুব ভালো মনে অনেকেই গ্রহণ করতে পারেনি। একটা চাপা বিক্ষোভ বা অসন্তোষের আঁচ সেই সময়ের ইংরেজ কর্তৃপক্ষ টের পেয়েছিলেন।

কোচবিহারের মহারাজা মনে প্রাণে ব্রাহ্ম এবং হিন্দুধর্মের রীতিনীতি না মেনে ব্রাহ্মধর্ম মতেই সুনীতি দেবীকে বিবাহ করেছেন—এ কথা প্রচার হয়ে গেলে প্রজা বিক্ষোভ দেখা দিতে পারে এমন সম্ভাবনার ইঙ্গিত ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ও কোচবিহারের উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চিঠি পত্র আদান প্রদানের মধ্যে দেখা গিয়েছে।

নৃপেন্দ্রনারায়ণ।

সমাজ রাজনীতি এবং ধর্ম শুধুমাত্র একটি বিবাহকে কেন্দ্র করে এইরকম তীব্র ভাবে আলোড়িত হয় এমন দৃষ্টান্ত সত্যিই বিরল। ব্রাহ্মধর্মের অনুগামীদের এক বড় অংশ কেশবচন্দ্র সেনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রবর্তন করেন। কেশবচন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই শ্রাব্য অশ্রাব্য বিষোদগার চলতে থাকে অবলীলায়। অথচ সমস্ত অভিযোগই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। কেশবচন্দ্র সেন আদৌ হিন্দু মতে, তাঁর কন্যার বিবাহ দেননি। বিশুদ্ধ ব্রাহ্ম মতে সুনীতি দেবীর বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে এবং ব্রাহ্ম ধর্মের একনিষ্ঠ আচার্য গৌরগোবিন্দ রায় স্বয়ং এই বিবাহ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

কিন্তু অনেকের মনেই সহজে একটি প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেশবচন্দ্র সেন রহস্যজনক ভাবে এত নীরব কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে সমস্যার গভীরে যেতে হবে। করদ মিত্র রাজ্য কোচবিহার। ইংরেজদের কাছে রাজনৈতিক দিক থেকে এ রাজ্যের গুরুত্ব অসীম। হিমালয়ের পার্বত্য রাজ্যগুলিকে অধিকারে রাখতে কোচবিহারকে হাতে রাখা দরকার ছিল। প্রজা বিক্ষোভ বা অশান্তির যে কোনও সম্ভাবনা ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে যথেষ্ট উদ্বেগের। আধুনিক, মার্জিত, সংস্কৃতিবান পরিবারের সঙ্গে কোচবিহারের রাজ পরিবার আত্মীয়তা স্থাপন কারও ইংরেজ মনেপ্রাণে তা চেয়েছে কিন্তু প্রজা বিক্ষোভ কখনওই নয়।
আরও পড়ুন:

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-২: ভারতের স্থাপত্যশৈলীতে ভিতরকুঠি টেরাকোটা শিব মন্দিরের অবদান অপরিসীম

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৯: সুন্দরবনের লুপ্ত নদী আদিগঙ্গা

প্রধানত রাজনৈতিক কারণেই ইংরেজ কর্তৃপক্ষ কেশব চন্দ্র সেনের কাছ থেকে আগেই প্রতিশ্রুতি আদায় করে রেখেছিলেন, যে কোনও অবস্থাতেই তিনি প্রকাশ্যে এই বিবাহের মধ্যে কতটা হিন্দুয়ানী বা ব্রাহ্মধর্ম আছে তা নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।

১৮৭৮ সালে ‘মিস কব’-এর কাছে লেখা কেশবচন্দ্র সেনের চিঠির কিছু অংশ এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, … “My antagonists have impeached my character, showered upon me abusive epithets of all kinds, and represented me before the public as one who, for fame and wealth and worldly advantages, has unhesitatingly sold his conscience and his daughter!….. If my conscience aquits me, none can convict me… as a private man I should not probably have acted as I have done. I was acting all along as a public man…. The British Government sought me and my daughter a Christian government that knew me thoroughly to be a Brahmo leader, proposed the alliance and the weightly interest of a State were pressed upon me with a view to induce me to accept the proposal and make the needful concession…. I was assured that the Rajah had no faith in Hinduism, but a public renunciation of the Hindu faith was objected to on political grounds…
আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-২: কাজের আশায়, তারকা অশোককুমারের গাড়িতে নয়, লোকাল ট্রেনে-বাসে ঘুরে বেড়াতেন কিশোর

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩২: আটার চেয়ে ময়দা ঢের গুণ ভালো?

এরপর কেশবচন্দ্রের নীরবতার অর্থ খুঁজে বের করতে কষ্ট হয় না। বৃহত্তর স্বার্থের জন্য দিনের পর দিন যিনি অসহ্য অপমানের অসহ জ্বালা সহ্য করতে পারেন তিনি নীলকন্ঠ যদি নাও হন, মহাত্মা তো বটেই।

অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, এই বিবাহের উল্লেখ সরকারী নথিপত্রে’হিন্দু মতের বিবাহ’ লেখা আছে কেন? এ ব্যাপার তো অদ্ভুত বটেই। নথিপত্রের হিন্দু মতের বিবাহ কেমন করে ব্রাহ্মমতের হয়!

উত্তরে বলতে হয়, এছাড়া দ্বিতীয় কোন রাস্তা ছিল না। এখনও নেই। সরকারী আইনে ব্রাহ্ম বিবাহ বলে কোনও কথা নেই। যেমন একজন শিখের বিবাহ শিখ ধর্মমতে হলেও আইনের পরিভাষায়’ হিন্দু বিবাহ’ আওতায় পড়বে। বৈচিত্র পূর্ণ ভারতে আকালিরা শুধু নয়, অনেকেই দাবি তুলেছে, ভবিষ্যতেও তুলবে হিন্দু বিবাহ আইনের আওতা থেকে বেরিয়ে আসার। মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেন ও ব্রাহ্ম বিবাহ আইন চালু করার জন্য ইংরেজ সরকারকে বার বার অনুরোধ করেছেন।

কেশবচন্দ্র সেন।

এমনকি, ব্রাহ্ম বিবাহ আইনের খসড়া দলিল সরকারের কাছেও পেশ করেছিলেন, কিন্তু অবস্থা সেদিন ও যেমন ছিল, আজ ও তেমনি। তবে ইদানীং হিন্দু বিবাহের রীতিতে বহু পরিবর্তন এসেছে। আধুনিকীকরণের চেষ্টাও চলেছে। যেটা প্রয়োজনীয় পরিবর্তন। এইসব কারণ এই ব্রাহ্ম মতে সুনীতি দেবী, নৃপেন্দ্রনারায়ণের বিবাহ হলেও কাগজপত্রে তা হিন্দু বিবাহ। ফাঁক রেখে তো মহৎ কাজ হয় না! কিন্তু এক্ষেত্রে এ প্রবাদ অর্থহীন প্রমানিত। ইংরেজের কূটনীতির মজাও লক্ষ্য করার মতো।

এই ঐতিহাসিক বিবাহ শুধু দুজন মানুষ, দুটি পরিবারের সম্পর্ক নিয়ে বাঁধা পড়া নয়, এ এক ঐশ্বরিক বন্ধনের সুযোগ, ব্যক্তি ছেড়ে ব্যষ্টির উন্নতির জন্য, কুসংস্কারাচ্ছন্ন, প্রায়ান্ধকার ধর্মীয় আচারের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে নাভিশ্বাস ওঠা একটি রাজ্যকে উদ্ধার করার সংকল্পে ব্রতী হওয়া। এই সংকল্পের জের তাঁর ব্যক্তি জীবনে ভয়ঙ্কর ঝড় নিয়ে এসেছিল, সেইসঙ্গে বঙ্গের ধর্মীয় রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রে এক অস্থিরতার কাঁপন তুলেছিল।
এটা যে ঘটবেই, জানা ছিল। তবে সমাজ কোনওদিন ও কোনও পরিবর্তনকেই সহজে মেনে নেয়নি। তাই এক্ষেত্রে ব্রাহ্ম সমাজের টালমাটাল অবস্থা ও সংকটে অস্তিত্বের প্রশ্ন বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ব্রাহ্মসমাজের এক অংশের মূল ব্যক্তিবর্গের পক্ষে পরি্স্থিতি মেনে নেওয়া সহজ ছিলনা আর তা হয়ওনি।

দ্বিধা দ্বন্দ্ব পরিবৃত এক অসম্মানিত পিতৃ হৃদয় গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এই পরিণয়ের সুদূর প্রসারী প্রভাব। শুধু কন্যা রাজ ঘরণী হবে সেটাই বড় কথা নয়, কেশবচন্দ্রের চিত্তে পরিব্যাপ্ত ছিল এক বহুধা বিভক্ত অশক্ত কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় সমাজব্যবস্থার মূলে কুঠারাঘাত করে একটি রাজ্যের উত্তরণ সাধন।

ঋণ স্বীকার:
কোচবিহার পরিক্রমা:সম্পাদনা, কৃষ্ণেন্দু দে, নীরজ বিশ্বাস ও দিগ্বিজয় দে সরকার।
কোচবিহার কথা ইতিহাস ও সংস্কৃতি
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content