শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


সুনীতিদেবী।

রাজপরিবারের বিবাহ বা যে কোনও উৎসব মানে বিরাট আয়োজন, এলাহি কর্মোদ্যোগ। চারদিক সাজ সাজ রব। প্রজা অর্থাৎ সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও আনন্দের আতিশয্যে। আমরা ইতিমধ্যেই জানি কোচবিহার রাজ্য আর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চুক্তির কথা। শাসন কাজ পরিচালনা থেকে শুরু করে রাজপরিবারের ভিতরের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও ক্রিয়াকলাপে ইংরেজদের সে সময়ে অসীম প্রভাব প্রত্যক্ষ করা যায়।

আসলে ইংরেজরা খুব ভালো করেই জানতেন যে, এই রাজ্যে তথাকথিত পরোক্ষ আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে এবং সেই আধিপত্যকে সুদূর প্রসারি করতে হলে এই বহুধা বিভক্ত হিন্দু ধর্মীয় সমাজের শেকল কেটে রাজাকে বের করে নিয়ে আসতে হবে আধুনিকতার আলোয়। আধুনিক শিক্ষা, বিশেষ করে ইউরোপীয় ভাবধারায় শিক্ষা হবে তাঁর। আর তাঁর মহিষীকে হতে হবে এমন একজন ব্যক্তিত্ত্ব যিনি শুধু সমমনস্কই নন, বিদুষী, প্রজ্ঞাবতী এবং বহুক্ষেত্রে রাজনীতি নির্ধারণে পারঙ্গম। তদানীন্তন হিন্দু সমাজে এমন মেয়ে পাওয়া অসম্ভব। সেই সময়ে বা তার আগে রাজবাড়ির রমণীদের বেশকিছু সাহিত্য নিদর্শনের খোঁজ থাকলেও তা সমাজ রাষ্ট্রে তত কার্যকরী ছিল না। তার উপর নৃপেন্দ্র নারায়ণের আগে সব রাজারই বহু বিবাহ।
নৃপেন্দ্র নারায়ণ তখন সাবালক নন। ইংরেজ কমিশনারের নজরদারিতে রাজমাতা নিশিময়ী দেবী চালান ভাবী রাজার পক্ষে। যিনি রাজ্য পরিচালনা করে রাজা হবেন তাঁকে অবশ্যই রাজ্য চালাবার যোগ্য হতে হবে। ‘বার্ধক্যের বারাণসী’র কথা আমরা শুনেছি, কিন্তু ইংরেজের অভিধান এখানে অন্য কথা বলেছে। নাবালক রাজাকে জীবনের শুরুতেই কাশীবাসী হতে হয়েছে।

ভারতের মিত্র রাজারা যাতে শত্রু হয়ে গড়ে না ওঠে তার জন্য শিক্ষাব্যবস্থার দরকার, বণিকবাদী ইংরেজ তার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বেনারসের ‘ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশন’-এ বালক নৃপেন্দ্র নারায়ণের শিক্ষার শুরু হল। সেখান থেকে পাটনার সরকারি কলেজ।
ইংরেজের মাথাব্যথা ভাবী রাজার মতি গতি নিয়ে। উঠতি বয়স। এই বয়সটাই ভয়ের। বহু মধু সন্ধানী মৌমাছির মতো মো সাহেবদের পাল্লায় পড়ে ভাবী রাজার মাথা যাতে বিগড়ে না যায় সে ব্যাপারে ইংরেজদের কড়া দৃষ্টি।
আরও পড়ুন:

কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৩: কোচবিহার ও রাজ পরিবার— নানা ধর্ম ও মানুষের মিশ্রণ

সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৭: সুন্দরবনের লুপ্ত রাষ্ট্র গঙ্গারিডি

কর্নেল হটন, যিনি নৃপেন্দ্র নারায়ণের সর্বক্ষনের শিক্ষা ও অন্যান্য আচরণের পরিচর্যায় নিযুক্ত ব্যক্তিত্ব, তিনি লিখছেন বাবু কাশীকান্ত মুখোপাধ্যায়কে, “To watch over his conduct and the management of the household, to see the strangers and unauthorised persons have no access to them and generally to discharge such duties with regard to him as a good parent is bound to do.”

বাবু কাশীকান্ত ছিলেন পাটনায় শিক্ষা কালীন বালক নৃপেন্দ্র নারায়ণের তত্ত্বাবধায়ক ও অভিভাবক।

ভারতের পার্বত্য এবং পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির কোল ঘেঁষে সমতলের করদ মিত্র কোচবিহার রাজ্য যতই ছোট হোক, রাজনীতি এবং রণ নীতির দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কোচবিহার তাই চিরদিনই ইংরেজের নজর কেড়েছে।

নৃপেন্দ্র নারায়ণ।

নাবালক রাজপুত্রকে বিলেত পাঠানোর ব্যবস্থা চলতে লাগল। রাজপরিবার তো চমকে উঠল। রাজমাতা থেকে অন্তঃপুরচারিনীরা একেবারে সমস্বরে প্রতিবাদ জানালেন। কালাপানি পার হয়ে বিলেত? জাতি ধর্ম বরবাদ তো হবেই উপরন্তু বিলেত ফেরৎ রাজা কোচবিহারের গরিব প্রজাদের আগের মতো ভালোবাসবেন না, রাজকুমারের বিলাত যাওয়া কোনওমতেই সম্ভব নয়।…

কূটনীতির চালে ইংরেজদের হারাবে কে! বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিচার্ড ছুটে এলেন কোচবিহার রাজবাড়িতে। বসলেন অন্তঃপুর বাহিনী রাজমহিষীদের সঙ্গে। ইংরেজদের ধারালো যুক্তিও এঁদের প্রবল আপত্তিতে যখন যায় যায়, স্যার রিচার্ডের দৌতকার্য সফল হল অবশেষে, কূটনৈতিক চালে। রাজমাতা রাজি হলেন একটি মাত্র শর্তে। যদি বিলেত যেতেই হয়, আগে বিয়ে পরে বিলেত। স্যার রিচার্ড স্বস্তি পেলেন। রূপকথার রাজ্য হলে রাজপুত্রই পক্ষ্মীরাজ ছুটিয়ে রাজকন্যার সন্ধানে যেতেন, এখানে গল্প অন্যরকম।

মহামান্য ব্রিটিশ সরকার দূত পাঠালেন। কোচবিহারের নায়েব আহিলকার (Magistrate) বাবু যাদবচন্দ্র চক্রবর্তীর ওপর গুরু দায়িত্ব পড়ল। রাজপুত্রের উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধান। কলকাতার বিদগ্ধ মহলে, অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে শ্রী যাদব চক্রবর্তীর খ্যাতি ও সুনাম ছিলই। তিনি গোপনে গোপনে কলকাতা চষে বেড়াতে লাগলেন, অবশেষে পেয়েও গেলেন বুঝি!
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৯: গাধা পিটিয়ে ঘোড়া

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২২: পঞ্চমের সুরে কিশোর-আশার গাওয়া ‘জীবন কে হার মোড় পে’ গানটির কথা মনে পড়ে?

কেশবচন্দ্র সেনের অন্যতম অনুগামী প্রসন্ন বাবু মারফৎ যাদবচন্দ্র সুনীতি দেবীর কথা শোনেন। এমন মেয়েকেই খুঁজছিলেন তিনি। বংশ কৌলিন্য, আভিজাত্য, শিক্ষা, রুচি… সমস্ত শর্ত সুনীতি দেবীই পূরণ করতে পারেন। সবচেয়ে বড় কথা সুনীতিদেবী আধুনিকা। কিন্তু বাদ সাধলেন স্বয়ং কনের পিতা। কেশব সেন কিছুতেই কোচবিহারের রাজ পরিবারে কন্যা সম্প্রদানে রাজি নন। কারণ, কোনও রাজাই এক পত্নী নিয়ে সারাজীবন কাটিয়েছেন এ তথ্য কেশবচন্দ্রের অজানা। অন্য বাধা কোচবিহারের রাজ পরিবার ধর্মে হিন্দু। ব্রাহ্মধর্মের অবিসম্বাদি নেতৃত্ব যাঁর, তিনি কি করে পৌত্তলিকতাবাদের সঙ্গে আপোষ করবেন! কেশবচন্দ্র সেন একবারে জানিয়ে দিলেন তিনি কিছুতেই সম্মতি দেবেন না। নাছোড়বান্দা যাদববাবু ও। ওদিকে ব্রিটিশ সরকারও। সুনীতি দেবীর কোনও বিকল্প হবে না, যে করেই হোক কেশবচন্দ্র সেনকে রাজি করাতেই হবে।

রাজ্যের কল্যাণ, প্রজার কল্যাণ, মহৎ আদর্শ বোধ ইত্যাদি বলেও কেশবচন্দ্র সেনকে টলানো গেল না। মত দিলেন না তিনি। অবশেষে অভাবিত ঘটনা ঘটল, যা রাজ ইতিহাসে নজির বিহীন। স্বয়ং পাত্র অর্থাৎ মহারাজ নৃপেন্দ্রনারায়ণ স্বয়ং চিঠি লিখলেন মহাত্মা কেশবচন্দ্র সেনকে।
My dear Sir,

I have been asked to let you know what my honest opinion is on the subject of Polygamy.

In reply I beg to inform you that it has always been my opinion that no man should take more than one wife and I can assure you that I hold that opinion still.

I give below a statement of my religious views and opinions. I believe in ONE GOD and I am in heart THEIST.

Yours truely

NRIPENDRA NARAYAN BHUP
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৯: যে তোরে পাগল বলে তারে তুই বলিস নে কিছু

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৪: শুভ পরিণয়বেলা

বলাবাহুল্য, এই চিঠি লিখতে নাবালক মহারাজা কে উৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু এই চিঠি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেশবচন্দ্র সেন কিছুতেই ব্রিটিশ সরকার বা উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী কারও কোনও কথা বা প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রাখতে পারেননি। ফলে স্বয়ং মহারাজকেই উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। এ চিঠির ঘটনা একদিকে কেশব সেনের দৃঢ় ব্যক্তিত্ত্ব অন্যদিকে নাবালক মহারাজার অকপট সারল্য ঘোষণা করে।

এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করার। মহারাজা শুধু বহু বিবাহের বিরুদ্ধেই নিজের মতামত ব্যক্ত করেননি, প্রকারান্তরে বলেই দিয়েছেন তিনি ঈশ্বরে বিশ্বাসী কিন্তু সে ঈশ্বর একেশ্বরবাদের। পৌত্তলিকতাবাদ রাজা সমর্থন করেন না। নাবালক রাজা ব্রাহ্মধর্মের নিজের জন বলে নিজের পরিচয় দিতে মোটেই কুন্ঠিত নন।

মহারাজের এই ছোট্ট চিঠি আর স্পষ্ট কথা কেশব সেনের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সাহায্য করেছিল কিনা সে সম্পর্কে প্রামান্য কিছু জানা নেই, কিন্তু যেটা জানা গিয়েছে, কেশবচন্দ্র সেন এই ভাবে সপ্তরথী বেষ্টিত অভিমন্যুর মতো তখন পথের নিশানা খুঁজে বেড়াচ্ছেন পরমেশ্বর করুণাময়ের কাছে। পথ নির্দেশ চাইছেন, বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন মহাত্মা। অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকার ও অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।

কোচবিহার রাজ্যের দেওয়ান বাবু কালিকা দাস দত্ত ‘তার’ করলেন বাবু যাদব চক্রবর্তীকে,

‘Deputy Commissioner says can’t wait too long even if matter not published. Must have private assurance of Keshb Babu’s consent without delay. Remember preparations. 27.1.78’

কেশবচন্দ্র সেন।

এদিকে বৃটিশ ভারতে হিন্দু বিবাহ যে আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ হত (Act III of1872) তাতে বিবাহ যোগ্য বর ও কনের বয়স যথাক্রমে ১৮ ও ১৪ নির্দিষ্ট করা আছে। অথচ নৃপেন্দ্র নারায়ণ ও সুনীতিদেবী তখন ও এই বয়সে পৌঁছতে পারেননি।

তাহলে! এত চেষ্টা এত মন্ত্রণা সব হেরে যাবে আইনের ওই ছোট্ট অথচ স্পষ্ট নির্দেশে? এর সমাধানের রাস্তা বের করতে দেরি হল না।

মি. ডালটন চিঠি লিখছেন কেশব সেনকে,

“I know it will seem difficult to you to arrange a wedding on the 6th March and also that the idea of marrying your daughter before she has completed her fourteenth year is repugnant to you. But consider the circumstances and that in fact the marriage in the ordinary acceptance of the term but a Solemn BETROTHAL, the Rajah proceeding to Europe immediately after the ceremony”…

বয়সের এই ব্যাপারটি চেপে দেওয়ার জন্যই কি ‘BETROTHAL’ এর আবরণ? ‘Betroth’ কথাটির অর্থ বিবাহে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আর ‘Solemn’ কথার অর্থ’ ‘Accompanied with a ceremony’. এই উৎসব তো বিবাহেরই প্রস্তুতি। পরে কীভাবে বয়সের সমস্যা কেটে গিয়েছিল সেটা সুনীতি দেবীর কলম থেকেই জেনে নেওয়া যাবে।

ঋণ স্বীকার:
কোচবিহার পরিক্রমা, সম্পাদক, কৃষ্ণেন্দু দে, নীরজ বিশ্বাস ও দিগ্বিজয় দে সরকার।
কোচবিহার কথা ইতিহাস ও সংস্কৃতি

* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

Skip to content