শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


রাজাভাতখাওয়া। ছবি: সংগৃহীত।

এই যে শহরের রাস্তার প্রশস্ত রাজপথের নিদর্শন, যা কিনা রাজনগরের এক ছোট্ট শিশু জন্ম ইস্তক সে কাহিনি শুনে বেড়ে ওঠে। এই লেখকের বাড়ির সামনে পা বাড়ালে তোর্সা বাঁধ। বহুদূরে ছিল নদী।

শোনা সে কথা। রাজার মাহুত হাতির পিঠে, আর গলায় ঘণ্টার শব্দ তুলতে তুলতে হাতির দল এগিয়ে যেত জলের দিকে, স্নানে। ১৯৯২ পর্যন্ত বি রাজেন্দ্র ছিলেন। আমাদের ছোটবেলা সত্তরের পর পরও দেখেছি হাতির শান্ত ভঙ্গীতে হেঁটে যাওয়া নদীর দিকে। রূপকথার রাজার শহর মনে হতো। নিজেদের মনে হতো সেই স্বপ্নে দেখা বা গল্প কথার কখনও আলো ঝলমল পুরীর রাজকন্যা রাজপুত্রের দল। অথবা ঘুমন্ত পুরীর সে ঘুমিয়ে থাকা রাজকুমারী। বন্ধুরা দূর থেকে চিৎকার করত… ‘হাতি তোর পায়ের নীচে কুলের বিচি…’। কে যেন শুনিয়েছিল এই উচ্চারিত শব্দ ধ্বনি শুনলে হাতি বেজায় রেগে যায় তেড়ে আসে। হাতির দল যত দূরে যেত গলার সমস্বর আওয়াজ তীব্র হতো। হাতি ঘুরে তাকালেই বা কান মাথা ঝটপটালেই দুদ্দাড় লুকিয়ে পড়া। রাজপথে কানের ঝাপটে বাতাস তুলে ওরা হেঁটে যেত নদীর দিকে। স্নান সেরে একই পথে ফিরে যেত রাজবাড়ির দিকে… মন ভরে হাতিশালে হাতি, ঘোড়া শালে ঘোড়ার গল্প সত্যি হতে দেখতাম।

এখন বাংলাদেশের পঞ্চগড় (দিনাজপুর) জেলার ভিতরগড়, বোদা, তেঁতুলিয়া, দেবীগঞ্জ, নীলফামারী (রংপুর) জেলার ধর্মপালের গড়, ময়নামতীর কোট, জমির দুয়ার, তার পূর্ব লক্ষ্মী দুয়ারের পথে কোচবিহারের পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলে মেখলিগঞ্জ, মাথাভাঙা, শীতলকুচি, সিতাই, দিনহাটা অঞ্চল জুড়ে বিরাট প্রাচীন জনপদ পূর্ণনগর সভ্যতার ইঙ্গিত ইতিহাসে আছে। বর্তমান কোচবিহার থেকে ১৪ মাইল দূরে দক্ষিণ-পশ্চিমে গোসানিমারি রাজপাটকে কেন্দ্র করে প্রাচীন কামতাপুর নগরী গড়ে উঠেছে। অনেক ছোট ছোট স্থানের নাম আছে। ‘গোসানী মঙ্গল’ আখ্যানকাব্য থেকেও বেশ কিছু নাম পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে রাজা কান্তেশ্বর তথা খেন রাজাদের নির্মিত ধর্মপাল হাট, জল্পেশ্বর, কোটেশ্বর, আঠারো কোঠা, বোদা, ঘোড়াঘাট, রংপুর প্রভৃতি নাম আছে।
ময়নামতী-গোপীচন্দ্রের গীতের সঙ্গে কোথায় যেন পাল রাজবংশের ইতিহাস জড়িয়ে। রংপুরের অন্তর্গত ‘ধরমপাল গড়’-এর নাম পাওয়া যায়। মোটকথা ইতিহাস ধরে নেড়েচেড়ে দেখতে গেলে রাজা বিশ্ব সিংহের বংশের সূত্রপাতে কোথায় যেন পাল, পাট, কোট, গড় মিলে-মিশে আছে।

কামতাগড়ের পশ্চিমে কোটেশ্বর এখন বাংলাদেশে আর শীতলকুচী গোসাইয়ের হাট অঞ্চলে ‘আঠারো কোঠা’ নিজের নামে আজও গোসানী মঙ্গল মতে ধর্মপাল নগর ও ঘোড়াঘাট দুর্গ রাজা কান্তেশ্বর নির্মিত। কোচ বংশের রাজাদের মধ্যে একমাত্র বিশ্ব সিংহই ‘কান্তেশ্বর’ উপাধি গ্রহণ করেন। মহারাজ নরনারায়ণের সময় এ উপাধি তেমন ব্যবহার করা হয়নি। ‘নগরকুরশা’, ‘দুর্গা নগর’, শুভাগঞ্জ, শিলদুয়ার, বড় মরিচা গ্রাম প্রভৃতিতে নগর সভ্যতার নিদর্শন মেলে। এই ‘বড় মরিচা’ গ্রামেই ‘কোচবিহারের ইতিহাস’ রচয়িতা খাঁ চৌধুরী আমানতউল্লা সাহেব জন্মেছিলেন।

সোয়ারীগঞ্জ, বারবাঙ্গলা, সাগরদিঘি এ সবের সঙ্গে রাজা কান্তেশ্বরের কীর্তির কথা জড়িত। নগর লালবাজারের নাম পাওয়া যায় নগর নিদর্শনে। পরে ১৮৭৩ সালের ১ মে, পরগনা লালবাজারকে দ্বিখণ্ডিত করে পরগনা মাথাভাঙার সঙ্গে সিতাই থানাকে পরগনা দিনহাটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে নবগঠিত পরগনাগুলি ব্রিটিশ জেলার মহকুমার সমপর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে নগর লালবাজার তখন থেকে কেবল একটি স্থানের নাম নিয়ে গ্রাম হয়েই টিকে আছে।

গ্রাম প্রাধান্য নিয়ে এ দিকগুলি যতই রাজার নামে শহর হোক, বংশ ধারার নানা ইতিহাস থাক, যাতায়াত ব্যবস্থা বলতে ছিল শুধুই হাঁটা পথ, ডিঙি নৌকো, নয়তো গরুর গাড়ি। চলাচল উপযোগী বাস হাতে গোনা। কলকাতার সঙ্গে কোচবিহার শহর রেলপথ এবং বিচ্ছিন্ন ভাবে আকাশ পথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতো।
আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৫: সুন্দরবন নামরহস্য

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৮: সাইনাস নাকি কখনওই সারে না?

কোচবিহার রাজার শহর এই নামে পরিচিতি পেলেও আসলে এটি এক আদিম চেহারার পৌর শহর। রাজ আভিজাত্যের রমরমার দৌলতে হয়তো একসময় পৌরশহর বলে পরিচিত হয়েছিল, কিন্তু নাগরিকরা প্রাপ্য সুযোগ সুবিধা পেত না। পুরকর্তাদের তেমন কোনও উদ্যোগও ছিল না। শহুরে আচার-আচরণের বদলে প্রকট ছিল অনেকটাই কূপমন্ডুকতা, গ্রাম্যতা। গৃহবধূরাও তখন পর্দানসীন। তবে নৃপেন্দ্র নারায়ণের সময় থেকেই কোচবিহারে শুধু শিক্ষাক্ষেত্রে নয়, মহিলাদের ঘরের বাইরে এনে বহু কাজে শিক্ষায় যুক্ত করার মানবিক বৃত্তি বাড়িয়ে তোলার কাজে রাজা, মহারানির উদ্যোগ অনস্বীকার্য।

কোচবিহার জেলা গঠনের পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ১৯৪৭-এর ভারত ভাগ এবং উত্তর পূর্বে ১৯৫১ সালের শান্তা হার, রাজশাহী ও পূর্ববঙ্গের অন্যান্য অঞ্চলে সর্বনাশা দাঙ্গার সূত্রে হাজার হাজার মানুষ কোনওরকমে মাথা গুঁজে থাকার জন্য চলে আসেন এই নতুন জেলায়। উদ্বাস্তু জনগণের চাপে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বাংলাদেশের নানা বিপর্যয়ে উদ্বাস্তুর ঢল রাজশহরে চাপ সৃষ্টি করেছিল। পাশাপাশি উৎপাদন বাড়ানোর জন্য নতুন নীতির অভাব, মুনাফাখোরদের জটিলতা বেড়ে যাওয়া, রেশনিং কাজের অব্যবস্থায় খাদ্যাভাবও দেখা দেয়। মধ্যবিত্তদের ক্রয় ক্ষমতা চলে যেতে থাকে। ফলে হাজার হাজার মানুষের ভুখা মিছিলের খবর কোচবিহারের ইতিহাসে দেখেছি এবং তাকে কেন্দ্র করে গোলাবর্ষণের জেরে তরতাজা কতগুলি প্রাণের বিসর্জন আমাদের অহরহ মনে করিয়ে দেয় এখানকার শহরের মধ্যখানে সাগরদীঘির সেই শহিদ স্তম্ভ।

যাইহোক, এরই মধ্যে রাজা ও রাজবংশের প্রজাদের প্রতি কর্তব্য ও পরিচালনার যে ছবি এখন গল্পের মতো আমাদের তৃষ্ণার্ত করে তার সত্য দৃষ্টান্ত ও সাক্ষী আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠ বাবা, জেঠু দাদুদের বয়ানে উঠে এসেছে বার বার।

রাজার কথা রাজ কাহিনি উঠে এলেই তাই রাজবাড়ির বিরাট ইমারত আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে। এই ইমারত তৈরি হয়েছিল অনেক পরে। প্রাসাদটির নামের সঙ্গে ভিক্টর জুবিলি প্যালেসের নাম জড়িয়ে গেলেও এ সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে।

রাজাভাতখাওয়া রেল স্টেশন। ছবি: সংগৃহীত।

১৮৮৭ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের রাজত্বকালে এই যে ধ্রুপদী স্থাপত্য-সহ এ রাজ প্রাসাদ তৈরি হল, এতে ইতালির সেরা শিল্পের নবজাগরণের ছোঁয়া স্পষ্ট। এই পাশ্চাত্য শিল্পে অনেকে ইংল্যান্ডের বাকিংহাম প্যালেসের মিল খুঁজলেও আধুনিক গবেষণার মত কিন্তু তা বলে না। রোমের সেন্ট পিটার্সবার্গে সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন। তবে প্রাসাদের গম্বুজ একেবারেই আলাদা বৈশিষ্ট্যের ধ্রুপদী সাক্ষ্য বহন করে রাতের জ্যোৎস্না আর দিনের সূর্য আলোয় ঝলমল করে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চোখে পড়া, দূর দূরান্তের অধিবাসীরা এই রাজপ্রাসাদের গগনচুম্বী মিনারের আকর্ষণে আজও আসেন বার বার।

ইটের তৈরি এই রাজবাড়ির রং গাঢ় লাল। এখন হলদে বর্ডারের ছোঁয়ায় সৌন্দর্য আরও বেড়েছে। প্রাসাদের একতলায় বিলিয়ার্ড রুম, সভাকক্ষ, অতিথি শালা, ভোজন কক্ষ নিয়ে প্রায় চব্বিশটি ঘর। বারান্দা থেকে দেখা যায় সবুজ ঘাসের একটুকরো লন, যা আজও রক্ষিত। দোতলায় পনেরোটি শয়নকক্ষ। তিনখানা বৈঠক ঘর। চারটি তোশাখানা। এগারোটি স্নানঘর-সহ মোট চল্লিশটি ঘর। দক্ষিণদিকের ঘরগুলিতে রাজা-রানি থাকতেন। দোতলায় ছিল নাচঘর। ঝাড় আলো এখনও দিব্যি সাক্ষ্য বহন করে আছে। এই প্রাসাদের বড় বড় সিঁড়ি অবশ্যই দর্শনীয় এবং উপভোগ্য। এই সিঁড়িগুলি মাইসোরের রাজপ্রাসাদের সিঁড়ির কথা মনে করিয়ে দেয়। যেমন এই সিঁড়ি প্রকাশ্যে আছে, তেমনি একাধিক গুপ্ত লোহার বা পাকা ঘোরানো সিঁড়িও আছে। কোনও কোনও সিঁড়ি কাঠেরও তৈরি। বেশ কিছু সিঁড়ি গম্বুজের মধ্যে দিয়ে উঠে গিয়েছে। আকাশ ছুঁয়েছে।

প্রাসাদের পিছন দিকে ছিল পাঠশালা। বিরাট রান্নাঘর। সামনে বারান্দা লাগোয়া সুন্দর পোর্টিকো। গোটা রাজপ্রাসাদ জুড়ে মেহগনি কাঠের বহু আসবাবপত্র ছিল। এখনও বেশ কিছু নিদর্শন রয়েছে। প্রাসাদ যখন নির্মাণ করা হয় প্রাথমিক ভাবে এটি তিনতলা তৈরি হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন কোচবিহারে বিধ্বংসী ভূমিকম্প হয়। এতে ত্রিতল ভেঙে যায়। প্রাসাদের অপূর্ব অলঙ্করণে বেশকিছু জায়গায় পোড়ামাটির অলঙ্করণ আছে। একে টেরাকোটার কাজও বলা হয় অনেক সময়। অলঙ্করণে সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়নি। পাশ্চাত্য শিল্পীর পরিকল্পনা ও হাতের ছোঁয়া ছিল এই প্রাসাদ সজ্জা, তৈরি ও অলঙ্করণে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৩: কোন কাননের ফুল ‘শ্যামলী’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২০: পঞ্চমের সুর আর কিশোর-আশার অনবদ্য উপস্থাপনা, ‘এক ম্যায় অউর এক তু’ গানটি আজও সুপারহিট

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৬: নারীবিদ্বেষ— অসুখ নাকি রাজনীতি

১৯৮৬-তে প্রাসাদের সংস্কার করতে হয়েছে। পুরাতত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। রাজপরিবারের ব্যবহৃত জিনিস ছাড়াও পদক, অলঙ্কার, বাসনপত্র, ছবি, ফোটোগ্রাফ, চিঠিপত্র সবই সংরক্ষিত রয়েছে। প্রাসাদের প্রবেশপথ থেকে অদ্ভুত বিরাট কারুকার্যখচিত বিশাল দরজা পেরিয়ে যেতে রাজকীয় সময় আর ঐতিহ্য মনকে বিবশ করে। রোমাঞ্চিত হতে হবে।

১৮৭৮ সালে মহারাজা নৃপেন্দ্র নারায়ণের সঙ্গে যে সুনীতি দেবীর পরিণয় বন্ধন হয়, তার স্থান কোথায়? সে সময় বর্তমান রাজবাড়ির অস্তিত্ত্ব তো ছিল না, তাহলে সে সময় রাজা রাজপুত্র, রাজমাতা, রাজাদের ভিড়, লোক-লস্কর এঁরা কোথায় কীভাবে বাস করছিলেন, সেই রাজকীয়তা কেমন ছিল একথা এ ক্ষুদ্র অনুসন্ধান ও কয়েকটি বই পাঠে খোঁজ পাওয়া সম্ভব নয়। তবে ভবিষ্যতে এ বিষয়ের উপর আলোকপাত করে গবেষণা নিশ্চয়ই হবে। প্রাচীনকালে লোক-লস্করদের অভাবে সে ইতিহাস তলিয়ে যেতে বসলেও অনুসন্ধিৎসু লেখক, ইতিহাসকার, হেরিটেজ রক্ষার কাজে যুক্ত ব্যক্তির মুখের বর্ণনায় অনুমান করা যায় গুঞ্জবাড়ি অঞ্চলে ডাঙার আই মন্দির পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল রাজার এলাকা ছড়িয়েছিল।

বর্তমান রাজবাড়ি যেখানে সেখানেও রাজার দালান ছিল। দেবীবাড়ি এলাকায় যে অপূর্ব নিদর্শন যুক্ত দুটি রাজকীয় স্তম্ভ দেখা যায়, মনে হয় ওখানে রাজ এলাকায় প্রবেশের দরজা ছিল। এখন সাগরদিঘির ধারে নৃপেন্দ্র নারায়ণের পূর্ণাবয়ব মূর্তির পিছনে যেখানে জজকোর্ট সেখানেও সম্ভবত রাজবাড়িতে প্রবেশ পথ ছিল। বর্তমানের মূল প্রবেশ পথটিও নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু এমন অদ্ভুত ভাস্কর্য নিদর্শন তখন ছিল না। যাঁরা এখন নানা ভাবে ইতিহাস চর্চায় রয়েছেন তরুণ প্রজন্ম তাঁরাই হয়তো একদিন উপযুক্ত প্রামাণ্য তথ্য-সহ সব হাজির করবেন। ওই পুরোনো রাজ চত্বরেই পুরোনো দালানকোঠা জুড়েই হয়তো নৃপেন্দ্রনারায়ণ ও সুনীতি দেবীর ঐতিহাসিক বিয়ে সম্পাদিত হয়েছিল। এই বিয়ের কাহিনি এক নতুন অধ্যায় তৈরি করবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২৩: গোবিন্দর হেঁয়ালি

অজানার সন্ধানে: এক লিটার পেট্রলে গাড়ি ছুটবে ১০০ কিমি! যুগান্তকারী যন্ত্র আবিষ্কার করেও রহস্যজনক ভাবে উধাও হন বিজ্ঞানী ওগলে

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫০: আমার সোনার হরিণ চাই—সীতার চাওয়া কি সত্যি হবে?

পুরাণ কাহিনি, লোকশ্রুতি, কিংবদন্তি এবং ঐতিহাসিক প্রাধান্যের মধ্যে কামরূপ ও কোচবিহারের কথা বার বার উঠে আসে। ধর্মপালের ভ্রাতৃজায়া মীনাবতীর কাহিনি, নীলধ্বজ কিংবদন্তী, হীরা জিরার কাহিনি যেমন ইতিহাস ছুঁয়ে যায়, তেমনি কামরূপরাজ ভাস্কর বর্মার কাহিনি, মোগল সেনাপতি মানসিংহের বিবাহ কাহিনি (নরনারায়ণের কন্যার সঙ্গে মানসিংহের বিবাহ কথা), ব্রক্ষ্মানন্দ কেশব চন্দ্র সেনের কন্যাদান কাহিনিও কোচবিহারের ইতিহাসকে বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলে।

মহী নারায়ণ বা লক্ষ্মীনারায়ণের জ্ঞাতি বংশধর রূপনারায়ণ (১৭১৪ সাল পর্যন্ত) মহেন্দ্রনারায়ণের মৃত্যুর পর সিংহাসনে বসেন। রূপ নারায়ণের পর উপেন্দ্র নারায়ণ, দেবেন্দ্র নারায়ণ, ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ এবং রাজেন্দ্র নারায়ণ পর্যন্ত কোচবিহার রাজবংশ ইংরেজ আধিপত্যের বাইরে ছিল। বাংলায় কোম্পানির শাসন শুরু হলে ১৭৭৩ সালের ৫ এপ্রিল ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে কোচবিহার করদ রাজ্য হয়। পরবর্তীতে ধরেন্দ্রনারায়ণ হন প্রথম করদ রাজা।

গোসানিমারির রাজপাট। ছবি: সংগৃহীত।

ধরেন্দ্রনারায়ণ ইংরেজ কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করতে বাধ্য হন ভুটিয়াদের কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্য। ধরেন্দ্রনারাযণের পিতা ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ নিজের এক ভাইকে হত্যা করে অন্য ভাইকে দেওয়ান নিযুক্ত করেছিলেন। ভুটিয়ারা এতে রাজার উপর ক্ষুব্ধ হয়। কৌশল করে ধৈর্যেন্দ্রকে বন্দি করে, অন্য ভাই রাজেন্দ্রকে সিংহাসনে বসায়। রাজেন্দ্র অকাল প্রয়াত হন। শুরু হয় কোচবিহারে সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রবল বিরোধ। এই বিরোধের মধ্যেই ভুটিয়াদের অমতেই ধৈর্যেন্দ্রের পুত্র ধরেন্দ্র নারায়ণ (১৭৭২-১৭৭৫) সিংহাসন নেন। ভুটিয়ারা বিরুদ্ধাচরণ শুরু করে।

ধরেন্দ্র আর তাঁর নাজির দেওয়ান ইংরেজ কোম্পানির শরণাপন্ন হন। ইংরেজ কোম্পানির পক্ষে এটাই এক সুযোগ। ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে ক্যাপ্টেন জোনস ভুটিয়াদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। এরপর রাজ পরিবার কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করে। এই ভাবে কোচবিহার রাজ্য হয়ে ওঠে ইংরেজ কোম্পানির অনুগত রাজ্য। ভুটিয়ারাও এ সময় কিছুটা ভয়েই ইংরেজদের সঙ্গে সন্ধি স্বাক্ষর করে। কোম্পানির হস্তক্ষেপে বন্দি মহারাজ ধৈর্যেন্দ্র নারায়ণ কারামুক্ত হন। মুক্তির পর যে স্থানে তিনি প্রথম ভাত খেয়েছিলেন সেই স্থানের নাম হয় ‘রাজা ভাত খাওয়া’। একথা এ লেখায় আগেই উল্লিখিত। মুক্তির পর ধৈর্যেন্দ্র অত্যন্ত ধার্মিক হয়ে পড়েন। আসলে কোম্পানির কাছে আত্মসমর্পণ তাঁর মনঃপুত ছিল না। মতান্তরে আছে তাঁর মস্তিষ্ক বিভ্রাট হয়। যদিও ধরেন্দ্রের অকাল মৃত্যু হলে ধৈর্যেন্দ্রকে আবার সিংহাসনে (১৭৭৫-১৭৮৩) বসতে হয়।—চলবে।

ঋণ স্বীকার:
কোচবিহারের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড: খাঁ চৌধুরী আমানত উল্লা আহমদ
উত্তরপ্রসঙ্গ, সম্পাদনা দেবব্রত চাকী (কোচবিহার জেলা সংখ্যা)
কোচবিহার কথা ইতিহাস ও সংস্কৃতি
* মণিদীপা নন্দী বিশ্বাস। সাহিত্যিক ও কবি। কোচবিহার সুনীতি অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষিকা। www.samayupdates.in -এ লিখছেন ‘কোচবিহারের রাজকাহিনি’। একাধিক উপন্যাকস, ছোটগল্প সংকলন, প্রবন্ধ সংগ্রহ ও কাব্যগ্রন্থ রয়েছে লেখিকার।

Skip to content