রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


কুশ। সংগৃহীত।

পুরোহিততন্ত্র মতে, কুশ হিন্দুদের যে কোনও পবিত্র কার্য সিদ্ধ করার এক অপরিহার্য উপাদান। আমরা প্রায় সকলেই লক্ষ্য করেছি যে কোন পুজো-পার্বন, বিবাহ বাসর, তর্পণ, উপনয়ন, পিতৃ-পুরুষকে জলদান এবং শ্রাদ্ধ বাসরে পুরোহিতেরা কুশের তৈরি আংটি ও কুশের আসন অবশ্যই ব্যবহার করে থাকেন। কারণটা হল, হিন্দু ধর্মমতে কুশকে ভগবান নারায়ণের হিসাবে কল্পনা করা হয় এবং পুরোহিতেরা কুশের আংটি দিয়ে জল ছিটিয়ে সমগ্র স্থান ও পূজার উপকরণকে শুদ্ধিকরণ করেন। ভাদ্র মাসে দর্ভাষ্টমী তিথিতে ব্রাহ্মণেরা কুশকে পুজো করেন দেবতা জ্ঞানে।

রামায়ণের অন্তিম পর্বে দেবী সীতা যখন ঋষি বাল্মিকীর আশ্রমে আশ্রয় নিয়েছিলেন সেই সময় নাকি কুশের উৎপত্তি হয়। একদিন সীতা দেবী বনে কাঠ কুড়াতে যাওয়ায় আগে মুনিবরকে বলে যান তাঁর শিশু পুত্র লবকে যেন তিনি লক্ষ্য দেন। কিন্তু খানিকটা সময় পরেই মুনি বাল্মিকী লবকে খুঁজে না পেয়ে চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং সীতা ফিরে আসার পূর্বেই তিঁনি অবিকল লবের ন্যায় দেখতে একটি কুশের মূর্তি তৈরি করে তাঁতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।

খানিকটা সময়ের পর সীতা ফিরে এলেন এবং তার পর পরই লবও বনের মধ্যে থেকে ফিরে এলেন তখন হতবম্ব সীতা একই রকম দেখতে লব ও কুষকে দেখে বাল্মিকীকে প্রশ্ন করলেন। উত্তরে বাল্মিকী সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন এবং তারপর থেকেই কুশ দিয়ে তৈরি ওই বালকের নাম হয় কুশ। এইভাবেই লব কুশ একে অপরের হরিহরআত্মা হয়ে বড় হতে থাকে।
রামায়ণের লব-কুশের এই গল্প অনেকেরই জানা কিন্তু জানেন বৈষ্ণবমতে কুশকে নারায়ণের কেশরাশি সঙ্গে তুলনা করা হয়। বিষ্ণু পুরাণ মতে ভগবান নারায়ণ কুর্ম অবতারে অর্থাৎ কচ্ছপ রুপে আবির্ভূত হওয়ার পরেই নাকি কুশের মর্তে জন্ম হয়। অমৃত লাভের আশায় দেবতা এবং অসুরদের একত্রিত প্রয়াসে মন্দার পর্বত ও বাসকি নাগের সাহায্যে সমুদ্র মন্থন শুরু হয় কিন্তু পর্বত গুণনের সময় সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে।

সেই পরিস্থিতিকে স্থিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য বিষ্ণু, কচ্ছপ অবতার ধারণ করে এবং নিজের পিঠের ওপর সেই পর্বতকে ধারণ করে সমুদ্র মন্থন সুসম্পন্ন করেন। সেই সময় কচ্ছপের গা থেকে কিছু কেশরাশি ঢেউয়ের সঙ্গে মেশে এবং পরবর্তীকালে তীরে এসে পৌঁছায় এবং সেই কেশ থেকেই জন্ম হয় কুশ নামক উদ্ভিদের। এই কারণেই বিষ্ণুর উপাসকরা তাঁদের কেশদানের সময় কেশরাশিকে কুশ স্পর্শ করে কেটে ফেলেন। অনেকেই দুঃস্বপ্ন বা খারাপ কোন শক্তির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বিছানার তলায় রাত্রে ঘুমাবার সময় কুশ রাখেন।

এই কুশ নিয়ে আরও একটি লোককথা প্রচলিত আছে। সমুদ্র মন্থনের পর দেবতাদের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর উদ্বৃত্ত খানিকটা অমৃতের সন্ধান পান বিষ্ণুর বাহন গরুড়ের সৎভাই কদরু। কদরু তখন অমৃত লাভের চেষ্টায় উদ্যত হন কিন্তু তা গরুর পাখি লক্ষ্য করেন এবং গরুর সেই অমৃত পাত্র কেড়ে নেন। নেওয়াযর সময় খানিকটা অংশ ঘাসের ডগায় পরে এবং তা পাওয়ার আশায় সাপ সেই ঘাসের ডগা চাটতে থাকেন। অমৃত যে ঘাসে পড়ে সে অমরত্ব পায়, কিন্তু ওই ঘাসের ডগা সাপের জিহ্বাকে কেটে দুফলা করে দেয় এবং সেই সময় থেকেই নাকি সাপের দ্বিধা বিভক্ত হয়েছে। এই সকল কারণেই হয়তো আজও হিন্দুদের সংস্কার ও সংস্কৃতিতে সমানভাবে মিলেমিশে রয়েছে কুশের আধিপত্য।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, পর্ব-২৮: কেতকী গাছের এই সব স্বাস্থ্যগুণের কথা জানতেন?

সুন্দরী শালি নদী চলে এঁকেবেঁকে…

বর্তমান পুরোহিত তন্ত্র অনুযায়ী, কুশের সংখ্যার তারতম্যের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন লৌকিক আচার অনুষ্ঠানের ভিন্ন ভিন্ন নামকরণ করা হয়েছে। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক রেষারেষি এবং মিডিয়ার কল্যাণ আমাদের সকলেরই প্রায় পরিচয় ঘটেছে “কুশপুত্তলিকা দাহ” ঘটনাটির সাথে। আসলে এটি একটি হিন্দু লৌকিক আচার অনুষ্ঠান বলা যেতে পারে। কোনও ব্যক্তি যদি হারিয়ে যায় বা অজানা জায়গায় তাঁর মৃত্যু হয়ে থাকে এবং তারপরে ১২ বছর পর্যন্ত তাঁর কোনও খোঁজ খবর না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির অনুরূপ একটি কুশের দেহ নির্মাণ করে তাঁকে দাহ করা হয়।তারপর সেই ব্যক্তিকে মৃত অনুমান করে তাঁর শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলীদের কাছেও কুশ অতি পবিত্র উদ্ভিদ কারণ শাক্যমুনি কুশের আসন এর উপর বসেই তার সাধনা শুরু করেন।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-১০: রাজ ও স্প্যানিশ

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-১১: কার মন ভোলাতে এলে তুমি আজ…

 

এক নজরে

 

গাছের পরিচিতি

বিজ্ঞানসম্মত নাম: এরাগ্রসটিস সাইনুসুরয়ডিস (Eragrostis cynosuroides).
সংস্কৃত নাম: দর্ভাম্
বাংলা নাম: কুশ
অন্যান্য নাম: কাশ, সর, দর্ভ ইত্যাদি
গোত্র: গ্রামিনি/পোয়েসি (Eragrostis cynosuroides)
 

গাছের প্রকৃতি

কুশ হল একটি ঘাস জাতীয় গাছ। এই গাছটি গুপ্তবীজী একবীজপত্রী এবং বিরুৎজাতীয় উদ্ভিদ।
 

গাছের বিস্তৃতি

ঘাস জাতীয় এই গাছটি ট্রপিকাল এবং সাব ট্রপিক্যাল অঞ্চলের সর্বত্রই দেখতে পাওয়া যায়। গাছটির আদি উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকা হলেও এটি এশিয়ার অনেক অংশেই লক্ষ্য করা যায়।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৮: সুন্দরবনে বিচিত্র অবয়বের দেবতা জ্বরাসুর

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪২: অ্যান্টিবায়োটিক খেলেই গন্ডগোল?

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

হিন্দুদের যে কোনও শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানে যেমন কুশের পাতা ব্যবহার করা হয় তেমনিই আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে কোষের মূল ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
 

অর্শ জনিত রক্তপাত বন্ধ করতে

যারা দীর্ঘদিন ধরে অশেষ সমস্যায় ভুগছেন এবং অর্শজনিত ক্ষতের কারণে যাদের কাঁচা রক্ত পড়ে ,তারা কুশমূল থেত করে সেই রস ব্যবহার করতে পারেন। সুশ্রুত সংহিতায় কুশমূলের ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।
 

ঘর্মজনিত দুর্গন্ধ দূরীকরণে

গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে অনেকেরই প্রচুর পরিমাণে ঘাম নিঃসরণ হতে থাকে এবং সেখান থেকেই গায়ে একধরনের দুর্গন্ধ হয়। এই সমস্যা দূর করতে তাঁরা স্নান এর পরে কুশমূল বেঁটে চন্দনের মত ঘাড়ে, বগলে এবং দেহের অন্যান্য অংশে লাগিয়ে তারপরে পোশাক পড়বেন। সেক্ষেত্রে এই দুর্গন্ধ জনিত সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে।
 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে

যাঁরা কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যায় ভুগছেন এবং সামান্য কাজ করার পরেই তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়েন, তারা চার-পাঁচ দিন একটি টোটকা ব্যবহার করতে পারেন। ১০ গ্রাম মতো কুশমূল ২০০ মিলিলিটার জলে সিদ্ধ করে তা এককাপ ফুঁটিয়ে এনে দিনে দু’বার খেলে এই সমস্যা অনেকটাই কমে যাবে।
 

ফোঁড়া ও ক্ষত নিরাময়ে

ক্ষত বা ফোঁড়ার ক্ষেত্রে কূশমূল খুবই উপকারী। কুশমূল সিদ্ধ করে সেই জলটা দিয়ে দিনে দু’ তিনবার ক্ষতস্থান বা ফোঁড়া ধুতে হবে, তারপর কুশমূল বেটে সেই স্থানে মলমের মতো লাগিয়ে রাখলে তা দিন তিনেকের মধ্যে সেরে যাবে।
 

চর্মরোগ সারিয়ে তুলতে

যে কোনও ধরনের অ্যাজমা এবং চর্ম রোগের ক্ষেত্রে কুশমূল বেটে লাগিয়ে রাখলে তা খুব দ্রুত কাজ করে।

 

মেনোরাজিয়া রোগের ক্ষেত্রে

অনেক স্ত্রীলোকের ক্ষেত্রে এই রোগ পরিলক্ষিত হয়। এই রোগে নির্মূল করার ক্ষেত্রে কুশমূলের ব্যবহারের কথা বলা আছে চরকসংহিতায়।
 

তেজস্ক্রিয়তা শোষণ করতে

বর্তমান বিশ্বের গ্লোবালাইজেশনের ফলে মানব জীবনের এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে কসমিক রেডিয়েশন। আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে কুশে প্রচুর পরিমাণে কসমিক রেডিয়েশন শোষণ করার ক্ষমতা রয়েছে। প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা হয়তো এই কারণেই তাদের পানীয় জল ও খাবারের পাত্রে কুশ রাখতেন।
 

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে

কুশ গাছের মূলের নির্যাস অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে শরীর থেকে নানান ক্ষতিকর দূষিত পদার্থকে নিষ্কাশিত করে।

এছাড়াও, বর্তমান বিজ্ঞানের আশীর্বাদে কুশগাছের মূল থেকে অ্যাজমা, জন্ডিস, মূত্র জনিত সমস্যার ওষুধ তৈরি হচ্ছে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content