ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।
পশ্চিমবাংলার মেয়ে-বউরা অঘ্রাণ মাসে ইতু পুজোর ব্রত যেমন রাখেন তেমনি এখনও পূর্ববঙ্গের পাবনা জেলায় এক ধরনের পুজো হয় যার নাম ভিটে কুমুরির পুজো। প্রধানত বাচ্চারা ও কিশোর কিশোরীরা বাড়ির উঠোনের একধারে তুলসী মঞ্চে কাছাকাছি একটি জায়গায় মাটি দিয়ে ভিটে তৈরি করে এবং সেই ভিটের ওপর শিমুল ফুল দিয়ে সাজিয়ে ধুপ প্রদীপ জ্বেলে আঞ্চলিক গান ছড়ার মধ্যে দিয়ে এই পুজো করে। এই পুজো চলতে থাকে বসন্তকালের সন্ধ্যা জুড়ে। সারাবছর যেহেতু এই গাছে ফুল থাকে না তাই এই ফুল বিশেষ কোনও পুজোতে না লাগলেও আঞ্চলিক লোকাচারে এই ফুলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
অতীতে গ্রাম গঞ্জে বিভিন্ন অসুখের হাত থেকে রক্ষা পেতে যেমন নানান লৌকিক আচারে দেবদেবীর পুজো করা হতো। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, মায়ের দয়া অর্থাৎ বসন্ত রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মা শীতলার পুজো আবার কলেরার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মা রক্ষাকালী মা তার পুজো বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আজও হয়ে চলেছে। তেমনি শিমুল গাছকে ঘিরেও এই পুজো আয়োজিত হতো গ্রাম-গঞ্জের বাচ্চাদের ত্বকজনিত সমস্যা অর্থাৎ খোশ-পাঁচড়ার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। এবার আসা যাক শিমুল গাছের পৌরাণিক কাহিনিতে। মহাভারতের একটি সুন্দর গল্প জড়িয়ে আছে এই শিমুল গাছকে কেন্দ্র করে। দ্রৌপদী তখন পঞ্চপান্ডবের সঙ্গে অজ্ঞাতবাসে। সারাদিন পাণ্ডুবেরা বনে জঙ্গলে ঘুরে আহারে সংস্থান করে যখন অপরাহ্নে বন মধ্যে স্থিত ফেরেন তখন দ্রৌপদী প্রত্যেক সেবা করেন।
ক্লান্ত দ্রৌপদী ভীষণভাবে রেগে গিয়ে ওই শিমুল কাণ্ডকে অভিশাপ দেন যে আজকের পর থেকে তার সারা গায়ে কাঁটা তৈরি হবে এবং সেই কারণেই তাকে কেউ ছোঁবে না। এই কারণেই সেই সময়কাল থেকে আজও শিমুল গাছের সারা দেহ অসংখ্য কণ্টকযুক্ত। মহাভারতে এমনও বলা হয়েছে যে শিমুল গাছের কাঁটাযুক্ত কাণ্ড দিয়ে নরকে গমনকারী পাপীকে মর্মান্তিক শাস্তি দেওয়া হয়। শিমুল গাছকে সেই কারণেই ‘যমদূর্ম’ বলা হয়। এই কারণেই রাজস্থান রাজ্যের উদয়পুর অঞ্চলের অধিবাসীরা এই গাছকে দুর্ভাগ্যের প্রতীক হিসাবে মনে করেন। তাদের স্থির বিশ্বাস যে যদি কেউ এই গাছের স্বপ্ন রাত্রে দেখেন তাহলে সে শীঘ্রই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এই কুসংস্কারে কারণে তারা শিমুল তুলল বানানো কোন শয্যা (বালিশ, তোষক, লেপ ইত্যাদি) ব্যবহার করেন না এবং শিমুল কাঠ কেউ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করেন না। উদয়পুর নিবাসীর মনে এমন ধারণাও আছে যে শিমুল তুলোর তোষকে শয়ন করলে ‘প্যারালাইসিস’ হতে পারে।
হাত বাড়ালেই বনৌষধি, পর্ব-৩০: কুল কাহিনি
দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-২: একলা চলো রে…
এখনও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সেই হরিভক্ত প্রহ্লাদকে বাঁচিয়ে দেওয়া রীতি মেনে হোলিকা রুপি শিমুল গাছকে পুড়িয়ে ফেলার রীতি প্রচলিত আছে। পরিসংখ্যান মতে জানা যায়, প্রতিবছর শুধুমাত্র উদয়পুর জেলাতেই প্রায় আড়াই হাজারের মতো শিমুল গাছকে হোলিকা দহনে ধ্বংস করা হয়। কুসংস্করের আট বন্ধনে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ধীরে ধীরে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত হতে পারবে ততই আমাদের সামাজিক মঙ্গল হবে। সমাজের কল্যাণে এ বার আসা যাক শিমুল গাছের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণে।
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৫: সুর হারানো হারানো সুর
এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-২: ইতিহাসে অসম
এক নজরে
কী কী উপাদানে ভরপুর?
গাছের বিস্তৃতি
গাছের প্রকৃতি
ফলের প্রসঙ্গে এইটুকু বলে রাখি যে, দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যের কৃষি বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে প্রচুর সংখ্যায় শিমুল গাছ আছে এবং এই গাছের নিচে পড়ে থাকা শুকনো ডিম্বাশয়গুলি সংগ্রহ করে ১০০ টাকা কেজি দরে বাজারে বিক্রি করা হয়। এই শুকনো ডিম্বাশয় দাক্ষিণাত্যের বিভিন্ন অঞ্চলে বিরিয়ানি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৪: শ্যামপুকুরে ঠাকুর
চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার
আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রমতে
আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রমতে, সুশ্রুত ও চরকসংহিতা অনুসারে শাল্মলী বৃক্ষের গুড়ি থেকে যে রস নির্গত হয় তাকে ‘মোচরস’ বলা হয়। এই রস এবং কাণ্ডের ছাল, কচি মূল, ফুল, বীজ এখনও গ্রাম গঞ্জের বিভিন্ন অসুখ প্রতিরোধে ব্যবহৃত হয়। এই মোচরস চূর্ণ করে সঠিক মারতায় দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে সর্দি কাশি ও স্লেশ্মাজনিত বুকে ব্যথা নির্মূল হয়। আবার মোট রস চূর্ণ মাত্রা মতো দুধের সঙ্গে খেলে রক্ত আমাশয় অনেকটাই সরে ওঠে।
স্ত্রীরোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে
ত্বকের সমস্যার নিরাময়ে
হজমের সমস্যা দূর করতে
গনেরিয়া রোগ উপশমে
হারজনিত ব্যথা উপশমে
ক্ষত নিরাময়ে
প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়াতে
রক্তে শর্করা ও লিপিডের মাত্রা কমাতে
শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে
এছাড়াও বিভিন্ন পশু পাখির খাদ্য হিসাবে শিমুল ফুল ব্যবহার হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই। ঠিক এই কারণবশতই বিভিন্ন আশ্রম সংলগ্ন শিমুল গাছগুলোতে চড়ুই, ময়না, বুলবুলি, ময়ূর, কাঠবেড়ালি, লাঙ্গুর এবং হনুমানের আনাগোনা পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন ধরনের পাখিরা ফুলের বৃত্তি এবং দলমণ্ডলের ভিতরে জমে থাকা মিষ্টি রস খাওয়ার সময় পরাগ সংযোগ ঘটাতে সাহায্য করে।