শনিবার ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪


অ্যাসিডিটি, হজমের গোলমাল, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়েরিয়া, ডায়াবেটিস, অ্যানিমিয়া, ম্যালেরিয়া, ক্যানসার, গলায় ঘা এবং আলসারের মতো অজস্র রোগের মহৌষধ হল বেল। সারা ভারতে যা এক পবিত্র উদ্ভিদ হিসেবেও মনে করা হয়।

ভারততত্ত্ববিদ ডক্টর শংকর সেনগুপ্তের মতে, বেলপাতার তিনটি পত্রক আসলে সৃষ্টি-স্থিতি-লয় এর প্রতীক। মনে করা হয়, এটি ভগবান শিবের ত্রিনেত্রের সমতুল্য।

‘শঙ্খপুরাণ’-এ উল্লেখ আছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা, জগৎ নির্মাণের শুরুতে যাদের সৃষ্টি করেন তাদের মধ্যে একটি হল বিল্ববৃক্ষ। একজন মানুষ এই গাছের তলায় বসে ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা শুরু করেন। ব্রহ্মা, তাঁর নাম দেন বিল্ব। আবার কাশীর মহন্ত রামশঙ্কর ‘স্কন্দপুরাণ’-এ উল্লেখ করে বেল গাছের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করে বলেন—
‘একদিন পার্বতী যখন বিশ্রাম করছেন তখন তার কপাল থেকে কয়েক বিন্দু ঘাম ঝরে পড়ে মন্দরা পর্বতে, যার থেকে বিল্ব বৃক্ষের উৎপত্তি হয়। এই বেল গাছের মূলে অধিষ্ঠান করেন গিরিজা। গুঁড়িতে মাহেশ্বরী। পত্রে মাতা পার্বতী। পুষ্পে কাত্যায়নী এবং পুরো বৃক্ষেই অধিষ্ঠান করেন নানা শক্তি।

আসলে এটি এমনই একটি বৃক্ষ, যার পাতা-কাঠ-ফল মানুষের বিভিন্ন উপকারে লাগে। হিন্দু ধর্মে দেবাদিদেব মহাদেব শিবের পুজোয় বেল অপরিহার্য। তবে আমাদের বাংলাতে দুর্গাপুজোর সঙ্গে বেলগাছ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। দেবীর জাগরণ হয় বিল্বশাখার স্পর্শে এবং দুর্গার জাগরণের পর এই শাখাতেই তার আবাস হয়। আবার দুর্গাপুজোর নবপত্রিকা স্থাপনকালে নয়টি উদ্ভিদকে যখন লতা দিয়ে বাঁধা হয়, তখন কলা বউয়ের স্তনের প্রতীক হিসাবে দুটি বেল থাকে।

প্রসঙ্গত, যে কথা না বললেই নয় তা হল, ‘বৃহদ্ধর্মপুরাণ’ মতে পদ্ম ফুলের অভাবে মা লক্ষ্মী নিজহস্তে একটি স্তন দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আরাধ্য দেবতা মহাদেবের অর্ঘ্যে প্রদান করলেন। ভোলানাথ তখন দেবী লক্ষ্মীর ভক্তি দেখে আশ্চর্য হয়ে স্বমূর্তি ধারণ করে দেবীকে বরদান করেন। তাই প্রাচীন ঋষিগণের মতে, বিল্ববৃক্ষকে সেবা করলে আয়ু-আরোগ্য লাভ হয় এবং শ্রীবৃদ্ধি পায়।
 

গাছের প্রকৃতি ও ধরন

বিজ্ঞানসম্মত নাম: এগল মারমেলস (Aegle marmelos)
বাংলা নাম: বেল
সংস্কৃত নাম: বিল্ব
গোত্র: রুটেশি
প্রকৃতি: বেল গুপ্তবীজি দ্বিবীজপত্রী বহু শাখান্বিত উঁচু কাষ্ঠল বৃক্ষজাতীয় উদ্ভিদ।
পাতা: যৌগিক পত্র, ত্রিফলক আকৃতির।
 

এতে সে সব প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে

মারমেলোসিন, অ্যালোইমপ্যারাটোরিন, মারমেলিডি, ট্যানিক অ্যাসিড, মারমিন, আমবেলিফেরন, আইসোইমপ্যারাটোরিন, স্কিমিন, মারমেসিন, মারমেসিনিন, বিটাসিটোস্টেরল, ফ্যাটি অ্যাসিড ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য রাসায়নিক পদার্থ বিজ্ঞানীগণ নিষ্কাশন ও শনাক্ত করেছেন।
 

গাছের বিস্তৃতি

বেলগাছ সাধারণত গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলে হয়ে থাকে। বাংলায় এই গাছ হামেশাই দেখতে পাওয়া যায়। ভারতবর্ষের মধ্যে পাঞ্জাবে বেলগাছ চার হাজার ফুট উচ্চতায়ও বেড়ে ওঠে। গরমকালে পাঞ্জাবে তাপমাত্রা প্রায় ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে বলে ওখানে এই গাছ দেখা যায়। তবে বেলগাছ দোঁয়াশ মাটিতেই ভালো হয়।

আরও পড়ুন:

পাতে নিম পাতা রাখছেন না? কী ক্ষতি হচ্ছে জানেন?

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ, আমবাতের সমস্যায় ভুগছেন? ভালো থাকবেন এই ঘরোয়া উপায়গুলি মেনে চললে

উচ্চ রক্তচাপ কিন্তু ডেকে আনে স্ট্রোক-হার্ট অ্যাটাক, অসুখ নিয়ন্ত্রণে রাখতে কী কী করবেন?

 

উপকারিতা

 

ডায়েরিয়া

ডায়েরিয়া ও ডিসেন্টি প্রতিরোধে কাঁচা ও আধ পাকা বেল বা বেলচূর্ণ একিউট ও ক্রনিক ডায়েরিয়া এবং ডিসেন্টি উভয় ক্ষেত্রেই দারুণ ভালো কাজ করে। কাঁচা বেল অ্যাস্টিনজেন্ট হিসাবে কাজ করে ভালো ফল দেয়। তবে ডায়েরিয়ার সঙ্গে জ্বর না থাকলেই বেল ওষুধ হিসেবে প্রযোজ্য।
 

কলেরা

কাঁচা বেলে থাকা উচ্চমাত্রার ট্যানিন, যা কলেরা প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
 

স্তনদুগ্ধ বাড়ানো

শুকনো আদা চূর্ণ ও গুড় সহযোগে মিষ্টি বেলের শাঁস খেতে পারলে দুগ্ধবতী মায়েরা উপকার পাবেন।
 

ডায়াবেটিস

হাই ফাইবার এবং ভিটামিন বি-সহ সমৃদ্ধ বেল, ডায়াবেটিস রোগীদের রক্ত-শর্করা, ইউরিয়া এবং কোলেস্টেরল লেভেল কমায়। প্রতিদিন এক চা-চামচ বেলপাতার রস নিয়মিত খেলে ডায়াবেটিসে ভালো ফল পাওয়া যায়। এটি প্যানক্রিয়াসকে উত্তেজিত করে ইনসুলিন উৎপাদন ও তার সক্রিয়তা বাড়াতে সাহায্য করে।
 

অ্যালার্জি ও চুলকানি

বেলপাতার রস নুন ও জোয়ান-সহ খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

কোষ্ঠকাঠিন্য

পাকা বেলের শাঁস বা বেলপানা প্রতিদিন অন্তত একবার দু’ থেকে তিন মাসের জন্য খেতে পারলে বেলের ‘স্ট্রং লাক্সাটিভ’ এর জন্য অন্ত্রের মাংসপেশীর সংকোচন ভালো হয় এবং মল পরিষ্কার হয়। যে কোনও অ্যাকিউট ও ক্রনিক কোষ্ঠকাঠিন্যের ক্ষেত্রে পাকা বেল দারুণ উপকারী।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

স্বাদে-আহ্লাদে: বিকেল হলেই জমিয়ে প্রেম বা আড্ডা, সঙ্গে যদি থাকে ভেজিটেবিল চপ

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

 

পাইলস

অর্শের সমস্যা থাকলে নিয়মিত পাকা বেলের শরবত খেলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
 

ক্যানসার

পাকা বেলের শরবত থেকে প্রচুর ওয়াটার সলিবল অ্যান্টিঅক্সিডেন্টস, অ্যান্টি মিউটাজেনস এবং ফেনলিক কম্পাউন্ডস পাওয়া যায় যা, ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
 

মুখের আলসার

বেলের শাঁসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে জিভের উপর রেখে আস্তে আস্তে খান, উপকার পাবেন।
 

অ্যাসিডিটি

খাওয়াতে একটু উনিশ বিশ হলেই আমরা পেটের অসুখে ভুগি। বিশেষ করে বাঙালিকে তো ‘পেটরোগা’ বলেই সবাই পরিহাস করে। অ্যাসিডিটির সমস্যায় পাকা বেলের শরবত খান দিন পনেরো। পাকা বেলের মণ্ডের সঙ্গে জল বা দইয়ের ঘোল, আখের গুড় এবং পাতিলেবুর রস মিশিয়ে তৈরি হয় সকলের প্রিয় বেলপানা।
 

হজমের গোলমাল

বদহজম, পেটে গ্যাস, পেটব্যথা ইত্যাদি হজম সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে শুকনো বেলচূর্ণ বা পাকা বেলের শাঁস বা শরবত বেশ উপকারী।
 

ত্বকের যত্ন

সূর্যরশ্মিকে ঠেকিয়ে চামড়ার স্বাভাবিক রং বজায় রাখতেও কেউ বেলের শাঁস কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। শ্বেতি রোগের চিকিৎসায় বেলের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
 

আর্টিকোরিয়া

বেলপাতার রসের সঙ্গে মধু ও জিরের গুঁড়ো মিশিয়ে দিনে দুবার খেতে পারলে ত্বকে র্যা শ ও চুলকানিতে উপকার মিলবে।
 

হাইপার লিপিডেমিয়া

রক্তের কোলেস্টরেল ও ট্রাই গ্লিসারাইড মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাকা অথবা কাঁচা বেল বেশ কার্যকরী।
 

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল প্রপার্টি

বেলপাতা, ফলমূল, ছাল ইত্যাদি সব কিছুই ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া এবং ইনফেকশন প্রতিরোধ ও প্রতিকার করে।

আরও পড়ুন:

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-২: রামকথার পটভূমি এবং মহাভারতে কথকের কথাসূত্র

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-১১: গৃহকর্মে নিপুণা বনাম নিজের কাজে সিদ্ধা নারী

ইংলিশ টিংলিশ : আরও নতুন নতুন শব্দ নিয়ে মজার খেলা— একই শব্দ, আলাদা মানে HOMOPHONES / 2

 

অন্যান্য ক্ষেত্রে বেলের ব্যবহার

জামাকাপড় পরিষ্কার রাখে বেলের শাঁস। বেল দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি ডিটারজেন্ট এই কাজটি করে।
ভিনিগার বানানোর সময় বেল কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
জুয়েলারি দ্রব্যের ক্ষেত্রেও আঠার কাজে ব্যবহৃত হয় এটি ।
অঙ্কন শিল্পী তাঁর চিত্রের উপাদান বেলযুক্ত করেন রঙের স্থায়িত্বের জন্য।
বাড়ি প্লাস্টারের সময় জল নিরোধক ব্যবস্থাটিকে পাকাপোক্ত করে তুলতে সিমেন্টের সঙ্গে মেশানো হয় বেলের শাঁস। সিল্ক ফেব্রিকেও বেল ব্যবহৃত হয়, যা কাপড়ে এক অন্যরকম সৌন্দর্য এনে দেয়।
সবশেষে বলতেই হয় যে পরিবেশের উপর বেলের প্রভাব অনস্বীকার্য। এটি একটি উপকারী যৌগ।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’

পঞ্চমে মেলোডি,

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

 

সাবধানতা

বেল খুব উপকারী ফল হলেও কিছুদিন খাওয়ার পর বন্ধ রাখা উচিত। তা না হলে অন্ত্রের স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হতে পারে।
বেলের শরবত বা বেলপানা তৈরির জন্য ৫০ থেকে ৭৫ গ্রাম মাত্রায় বেলের শাঁস ব্যবহার করুন। খুব বেশি ঘন বা পাতলা কোনটাই শরীরের পক্ষে উপকারী নয়।
তাই হয়তো চরকসংহিতায় বলা হয়েছে, পাকা বেল হজম হয় খুব কষ্টে, বহু দোষের আধার, আচার কচি বেল স্নিগ্ধ, উষ্ণীষ অথচ তীক্ষ্ণ ও অগ্নি উদ্দীপক।এর ফলে শরীরের বায়ু এবং কফকে জয় করা যায়।


Skip to content