মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


তেঁতুলের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণ মস্তিষ্কের কোষকে সচল রাখতে সাহায্য করে। ছবি: সংগৃহীত

কৃমিনাশক, কোষ্ঠকাঠিন্যবাধক, পিত্ত নিয়ন্ত্রক এবং সর্বোপরি পৌষ্টিকতন্ত্রের অব্যর্থ ওষুধ তেঁতুল হল এই সপ্তাহের লেখার বিষয়বস্তু। আমাদের দেশে বর্ষা ঋতু ঢোকার পর পরই সর্দি-কাশি, গলা ব্যথা, জ্বর, ডায়রিয়া, আমাশয় ইত্যাদি নানান ধরনের রোগের পাদুর্ভাব ঘটে। এইসব রোগ-সহ আরও নানান অসুখের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করতে প্রাচীনকাল থেকেই ভারত তথা এশিয়ার প্রায় সব দেশেই তেঁতুলের ব্যবহার হয়ে আসছে।

আমাদের বাঙালিদের ঘরে ঘরে খাওয়া-দাওয়ার শেষ পাতে চাটনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। টোম্যাটোর চাটনি বা কাঁচা আমের টক তো সারা বছর রয়েছে। তবে তেঁতুলের টক কিন্তু বর্ষা ঋতুতে এদেরকে টেক্কা দেয়ার ক্ষমতা রাখে। বর্ষার রানি ইলিশের সঙ্গে তেঁতুলের টক, মৌরোলা-তেঁতুল টক, চিংড়ি- তেঁতুল টক অথবা সব্জির সঙ্গে তেঁতুলের টক যেন ভজন রসিক বাঙালির শেষ পাতের অমৃত।

অন্ধ্রপ্রদেশ ও তামিলনাড়ু-সহ দক্ষিণের নানা রাজ্যের রান্নায় (যেমন: সাম্বার, রাসাম) তেঁতুলের গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। শুধু ভারতের কথাই বা কেন বলব? সিঙ্গাপুর, মায়ানমার, তাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া-সহ এশিয়ার প্রায় অনেক দেশেই তেঁতুল এবং চিনির মাধ্যমে টক-মিষ্টি স্বাদের বিভিন্ন মাছের পদ রান্নার প্রচলন রয়েছে। আর খাবারের কথা যখন উঠলই তখন ফুচকার তেঁতুল জল কি আর ভোলা যায়?
 

পৌরাণিক কাহিনি

এ বার আলোকপাত করা যাক তেঁতুলের পৌরাণিক কাহিনীতে। ভারতীয় লোকোকথায় তেঁতুল গাছকে যেমন মনে করা হয় পার্বতী কন্যা উষা, তেমনই এই গাছের মাহাত্ম্য জড়িয়ে আছে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে। একদিন পার্বতী কন্যা ঊষা এবং পুত্র গণেশ নিজেদের খেলায় এতটাই মগ্ন ছিলেন যে, দেবাদিদেব মহাদেব তাঁদের সামনে আসলেও তাঁরা খেয়াল করেননি। ফলস্বরূপ ক্রধান্বিত দেবাদিদেব মহাদেব পুত্র গণেশকে শাস্তি দেন। ঊষাকেও অভিশাপ দেন যে, তাঁকে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করতে হবে বানাসুরের কন্যা হিসেবে। প্রচণ্ড ভয়ে ভীত ঊষা তখন একটি লবণের পাত্রের মধ্যে লুকিয়ে পড়েন। পরে পার্বতী ঊষাকে উদ্ধার করে আনেন ওই লবণ পাত্র থেকে, কিন্তু মহাদেবের অভিশাপের কারণে তাঁকে জন্মাতেই হয় অসুরকুলে। আসামের তেজপুর নামক অঞ্চলে অসুর রাজ বানাসুর থাকতেন। তাঁর মেয়ে হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন ঊষা। দেবীর আদেশে বানাসুর তাঁর কন্যা ঊষাকে দানস্বরূপ ফিরিয়ে দিলেন দেবী পার্বতীকে। পার্বতী নির্দেশে এবং ঊষার সম্মানে চৈত্র মাসে নুন ছাড়া তেঁতুল খাওয়ার রীতি আজও চলে আসছে।

বৃন্দাবনে পবিত্রস্থান তেঁতুলতলাকে নিয়ে একটি গল্পকথা আছে। একদিন যখন শ্রীরাধা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে মিলনের উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছিলেন তখন হঠাৎই একটা পাকা তেঁতুলের ওপর পা পড়ে পড়ার ফলে শক্ত খোলার তাঁর পা কেটে যায়। তখন রাগান্বিত শ্রীরাধিকা তেতুল গাছকে অভিশাপ দেন যে, কোনদিনও তেতুলের ফল পাকবে না এবং অপক্ক অবস্থাতেই ফল গাছ থেকে ঝরে পড়বে। উত্তর ভারতের মানুষের বিশ্বাস যে তেঁতুল তলায় শ্রীকৃষ্ণের মিলন সম্পন্ন হয়েছিল এবং এই কারণবশতই অঘ্রান মাসে তেঁতুল তলায় আনন্দ উৎসবের ব্যবস্থা করেন উত্তর প্রদেশের লোকজন। তেঁতুল গাছকে কেন্দ্র করে শ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে একটি লোককথা আছে। কৈকেয়ীর ইচ্ছানুসারে রাজা দশরথের আদেশ কে পালন করতে শ্রীরামচন্দ্র পত্নী সীতা ও ভাই লক্ষণকে নিয়ে যখন বনবাসে যান তখন তিনি একটি তেতুল গাছের তলায় কুঁড়ে ঘর বানিয়ে থাকতে শুরু করেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সেই যুগের তেতুল পাতা আকারে অনেক বড় বড় ছিল। সেই সকল তেঁতুল গাছের বড় বড় পাতা শ্রীরামের কুঁড়েঘরকে ছায়া প্রদান করত এবং রোদ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করত। একদিন রামচন্দ্র ভাই লক্ষণকে কথায় কথায় বলেছিলেন যে, “আমাদের পিতা আমাদেরকে বনবাসে পাঠিয়েছিলেন এই ভেবে যে আমরা প্রকৃতির প্রতিকূলতার সঙ্গে কীভাবে লড়াই করে নিজেদের টিকিয়ে রেখেছি। কিন্তু এই সুন্দর মনোরম পরিবেশের বড় বড় গাছের ছায়ায় আমরা দিন অতিবাহিত করি এটা তিনি কল্পনাতেও ভাবতে পারবেন না।”

অল্পতে উত্তেজিত লক্ষণ, দাদার কথা ফুরোনোর আগেই তীরের ফলা দিয়ে তেঁতুল গাছের ছায়া প্রদানকারী বড় পাতাগুলোকে ছিন্নভিন্ন করে দিলেন। এর ফলে তেঁতুল গাছের পাতাগুলো ঝিরিঝিরি (ছোট ছোট) পাতায় পরিণত হল। সেই থেকে আজও তেঁতুল পাতা একই রকম রয়েছে। বোটানির ভাষায় অবশ্যই এই ধরনের পাতাকে পক্ষল যৌগিক পত্র বলা হয়। দক্ষিণ ভারতে অবশ্য তেঁতুলকে নিয়ে মানুষের মনে এক খারাপ বিশ্বাস আছে। দাক্ষিণাত্যের মানুষদের ধারণা রাত্রে এই তেঁতুল গাছে প্রেতাত্মা বসবাস করে, তাই তাঁরা মন্দিদের পাশে তেঁতুল গাছ রোপন করে যাতে প্রেতাত্মার হাত থেকে সেখানকার মানুষ রক্ষা পায়।

আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: একাধিক সমস্যার অব্যর্থ দাওয়াই, বাজিমাত হবে এই ‘অমৃত’ ফলে

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: টেমারিন্ডাস ইন্ডিকা (Tamarindus indica)
● সংস্কৃত নাম: তিনত্রিনি
● বাংলা নাম: তেঁতুল
● গোত্র: লেগুমাইনোসি বা ফ্যাবেসি (Leguminosae/ Fabaceae)
● গাছের প্রকৃতি: তেঁতুল গাছ হল মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। এটি বহুবর্ষজীবী, দ্বিবীজপত্রী, সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই গাছের পাতা পক্ষল যৌগিকপত্র প্রকৃতির হয়। তেঁতুলের পুষ্পবিন্যাস ছোট রেসিম প্রকৃতির হয়ে থাকে। হলুদ ছোট ছোট ফুলগুলি কমলা অথবা লাল রঙের পুষ্পবৃন্তের মধ্যে সজ্জিত থাকে। গাছের ফল লেগুম প্রকৃতির।
● গাছের বিস্তৃতি: তেঁতুল গাছের আদি উৎপত্তিস্থল আফ্রিকা মহাদেশ হলেও বহুবছর আগে থেকেই এই গাছ ভারতবর্ষে চাষ করা হয়। এই গাছের আধিক্য পরিলক্ষিত হয় সুদান, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, ক্যামেরন, জাম্বিয়া, কেনিয়া, তানজানিয়া ইত্যাদি আফ্রিকান দেশগুলোতে।

আরও পড়ুন:

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

তেঁতুলে উপস্থিত থাকে প্রায় ১৮ থেকে ২০ শতাংশ টারটারিক অ্যাসিড, যার কারণে তেঁতুল এত বেশি টক হয়ে থাকে। এছাড়াও সামান্য পরিমাণে মেলিক অ্যাসিড এবং সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে। এগুলি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পলিফেনাল, এপিক্যাটেচিন, প্রসায়ানিডিন এবং নানান ধরনের ফ্ল্যাভোনয়েডস (যেমন: এপিজেনিন, লিউটিওলিন, ট্যাক্সিফোলিন, ইত্যাদি)।

তেঁতুলে উপস্থিত শর্করার পরিমাণ প্রায় ৪০ শতাংশ, প্রোটিনো ফ্যাট থাকে ৩ শতাংশ। এগুলি ছাড়াও ভিটামিন বি, ভিটামিন সি, ক্যালশিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সিলেনিয়াম, কপার, ম্যাগনেশিয়াম ইত্যাদি খনিজ লবণ উপস্থিত থাকে তেঁতুলে।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৮: সাইনাস নাকি কখনওই সারে না?

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে তেঁতুলের ব্যবহার

পৌষ্টিকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা বাড়াতে

তেঁতুলের মধ্যে উপস্থিত উপকারী ফাইবার এবং স্টার্চহীন পলিস্যাকারাইড থাকে, যা পেরিস্টলসিস অর্থাৎ পৌষ্টিকনালীর খাদ্য সঞ্চালনে কার্যকারী ভূমিকা নেয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
 

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে

আগেই বলেছি তেঁতুলে প্রায় ২০ শতাংশ টারটারিক অ্যাসিড থাকে। টারটারিক অ্যাসিডে উপস্থিত উপকারী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট শরীর থেকে ফ্রি রেডিক্যাল মুক্ত করে এবং শরীরের দুরারোগ্য ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলে।
 

কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে

তেঁতুলে উপস্থিত থাকে হেমিসেলুলোজ, পেকটিন, মিউসিলেজ, ট্যানিন ইত্যাদি জাতীয় আঠালো পদার্থ যা বৃহদান্ত্রের মিউকাস পর্দাকে রক্ষা করে এবং খাদ্য থেকে উৎপন্ন টক্সিন পদার্থকে শোষণ করে কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
 

শরীরে ভিটামিনের চাহিদা পূরণে

তেঁতুলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে। এছাড়াও তেঁতুলে নিয়াসিন, রাইবোফ্ল্যাবিন, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন এ, থায়ামিন থাকে যা মানব শরীরের ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে।
 

সর্দি কাশিতে

সর্দি-কাশি বা গলা ব্যথায় তেঁতুল গোলা উষ্ণ গরম জলে নুন মিশিয়ে গার্গেল করলে উপকার পাওয়া যায়।
 

পেটের অসুখে

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে তেঁতুলকে কোষ্ঠকাঠিন্য ও হজমের অর্বথ্য ওষুধ হিসাবে মানা হয়। তেঁতুল বীজের গুঁড়ো পুরনো ডায়ারিয়া এবং আমাশয় নিয়ন্ত্রণে ও ব্যবহার করা হয় আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে।
 

ক্ষুধামান্দ্য কমাতে

তেঁতুল রসের সঙ্গে দুই এক কুচি দারুচিনি মিশিয়ে চিবিয়ে খেলে খিদে বারে এবং ক্ষুধামান্দ্য ভাব কমে যায়।
 

হার্ট ঠিক রাখতে

তেঁতুলে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ উপস্থিত থাকে যেগুলি হল পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, কপার, সিলেনিয়াম ইত্যাদি। পটাশিয়াম-সহ অন্যান্য লবণ মানব শরীরের ভেতরের আয়নের মাত্রা ঠিক রেখে ব্লাড প্রেসার এবং হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করে।
 

বিষক্রিয়া কমাতে

ধুতরো ফুলের বিষক্রিয়ায় এবং পুরনো মদের বিষক্রিয়া কমাতে তেঁতুল জল কার্যকারী ভূমিকা নেয়। গ্রামে-গঞ্জে এই টোটকা খুবই ব্যবহার করা হয়।
 

আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে

কনজাংটিভিটিস, আমাশয়, জন্ডিস, গুমোজ্বর, ফোঁড়া, অর্শ, চোখ ফোলা ও হাঁপানিতে তেঁতুলের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায় আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে।

আমাদের অনেকেরই হয়তো জানা ছিল না যে তেঁতুল আমাদের শরীরে পক্ষে কতটা উপকারী, তাই এটিকে আমাদের প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় খুব একটা খুঁজে পাই না। তবে বছর দুইয়েকের শিশু এবং বাতের পেসেন্ট ছাড়া সকলেই সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন নিজেদের খাবারের বিভিন্ন পদে তেঁতুলকে রাখতেই পারেন।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content