রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

বাবার মাস শ্রাবণে লেখার বিষয়ে ছিল শিব শক্তি ‘রুদ্রাক্ষ’, যা দেবাদিদেবে মহাদেবের অশ্রু বিন্দু থেকে উৎপন্ন হয়েছে। আর ভাদ্রের মাসের জন্মাষ্টমী তিথিতে অর্থাৎ এই সংখ্যায় লেখার বিষয়বস্তু হল পালনকর্তা বিষ্ণুর ঘাম থেকে সৃষ্ট ‘তিল’। বৈদিক যুগ থেকেই ভারতের মানুষ তিলকে ভগবানের পূজার উৎসর্গ হিসাবে এবং নিজেদের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে আসছে।

তিল গাছের আদি উৎপত্তিস্থল মধ্য এশিয়া এবং আর্যদের মাধ্যমে প্রথমবার ভারতে আসে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার মানুষের প্রধান খাদ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল তিল। খ্রিস্টজন্মের বহু পূর্ব থেকেই এ দেশে তিল থেকে তৈরি তেল এবং তিল থেকে উৎপন্ন মদ বিভিন্ন সম্প্রদায় মানুষ তাদের খাদ্য তালিকায় স্থান দিয়েছিল। আজও ভারতীয়রা সাদা তিল থেকে উৎপন্ন তিলের নাড়ু, তিলের খাজা, তিলপাটালি পুজোর নৈবিদ্য হিসেবে অর্পণ করছে।

এছাড়াও বিবাহ এবং শ্রাদ্ধের বাসরে সংকল্প ও অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে তিন অপরিহার্য। এই তিল গাছ বিষ্ণুপ্রিয়া লক্ষ্মীর অত্যন্ত প্রিয়। এক সময় ভগবান নারায়ণ সপত্নীক মর্তে আগমন করেন। সেই সময় দেবী মাঠভর্তি তিল ফুল দেখে মুগ্ধ হন এবং নারায়ণকে গোপনে রেখে কিছু ফুল তুলে নেন। কিন্তু জগতের পালনকর্তার কাছে কোন কিছুই গোপন থাকে না। নারায়ণ তখন দেবীর উদ্দেশ্যে বললেন যে, দেবী জমির মালিকের অনুমতি ছাড়াই গাছ নষ্ট করেছে।

তাই তাঁর অন্যায়ের শাস্তি তাকে নিতে হবে এবং তাঁকে শাস্তিস্বরূপ নারায়ণ তিন বছরের জন্য মর্তে ওই চাষি পরিবারের সঙ্গে থাকতে নির্দেশ দিলেন। মা লক্ষ্মী তখন একরাশ মনকষ্ট নিয়ে স্বামীর সঙ্গ পরিত্যাগ করে এক ব্রাহ্মণী রূপ ধরে চাষীর গৃহে এলেন। হৃতদরিদ্র ব্রাহ্মণ চাষী স্ত্রী, তিন পুত্র এবং দুই কন্যা সহ কোনও রকমে দিনাতিপাত করতে তবুও গৃহে আগত অতিথিকে তারা আশ্রয় দিলেন।
ধনলক্ষ্মীর কৃপায় গরিব ব্রাহ্মণ চাষীর সৌভাগ্যের দরজা খুলে গেল। দেবীর মহিমায় তার জমিতে উৎপাদিত ফলনের দ্বিগুণ পরিমাণ তিলের ফলন শুরু হল। এরপর সেই ব্রাহ্মণ প্রচুর জমি-জমা-সম্পত্তি এবং গরুর মালিকানা লাভ করলেন। কিন্তু অহংকারহীন ওই ব্রাহ্মণ তার ও তার অতিথিকেও পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে সম্পত্তির অংশীদার করলেন।

এ ভাবেই দিন কাটতে লাগলো। কিন্তু দেবীর মর্তে নির্বাসনের সময়সীমা শেষ হতেই দেবী লক্ষ্মী নানা অলংকারে সুসজ্জিত হয়ে এক চমৎকার রথে উঠে আকাশে গমন করলেন। ব্রাহ্মণ চাষি ও তার পরিবার তখন দেবীলক্ষ্মীকে না চিনতে পারার মনকষ্টে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। ঐশ্বর্য ও বৈভবের দেবী লক্ষ্মী তখন তাদের আশীর্বাদ করলেন যে তাদের পরিবারের সঙ্গে কয়েকটি বছর কাটিয়ে তিনি খুবই সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তাদের আগামী জীবন সুখ সম্পদ ও সমৃদ্ধে অতিবাহিত হবে। পরবর্তীকালে ওই ব্রাহ্মণ এক ধনী ব্যক্তির ন্যায় বাকী জীবন অতিবাহিত করেছিলেন।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, পর্ব-২৪: শাল গাছের এই গুণগুলি জানতেন?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৭: সে কোন প্রভাতে হইল মোর সাধের ‘নবজন্ম’

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: Sesamam indicum (সেসামাম ইনডিকাম)
● বাংলা নাম: তিল
● গোত্র: পেডালিয়াসি (Pedaliaceae)
● গাছের প্রকৃতি তিল গাছ একবর্ষজীবী, বীরুৎ জাতীয়, গুপ্তবীজী, দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ। গাছের ফুল ছোট সাদা বর্ণের হয়ে থাকে। পডের অভ্যন্তরে সাদা বীজগুলি সজ্জিত থাকে। অক্সালিক এসিড বীজে উপস্থিত থাকা এটি সামান্য তিক্ত স্বাদযুক্ত হয়।
● গাছের বিস্তৃতি তিল গাছ এশিয়া, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আমেরিকায় চাষ হয়। তিল উৎপাদনে এশিয়ার মধ্যে ভারত প্রথম এবং বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। আবার ভারতের মধ্যে কেরালা রাজ্যটি তিল উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। কেরালা সবকটি জেলাতেই তিল চাষ হয়।
 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

তিল গাছের বীজে উপস্থিত থাকে সেসামিন, ফাইটিক অ্যাসিড, ফাইটোস্টেরল, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়াম, কপার, অক্সালিক অ্যাসিড, লিনোলেইক অ্যাসিড ইত্যাদি যৌগ। এছাড়াও তিল বীজ থেকে যে তেল উৎপন্ন হয় তাতে নানান ধরনের ভিটামিন উপস্থিত থেকে থাকে।

আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৬: তোমার গানের এই ময়ুরমহলে

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-৯: রাজবাড়ির সান্নিধ্যে নারীর উড়ান

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

অর্শের ব্যথা নিরাময়

অর্শ, বলি, নালিঘা, ভগন্দর ইত্যাদির ব্যথার ক্ষেত্রে সাদা তিল বাটা ও গাওয়া ঘি একসঙ্গে মিশিয়ে সেটা গরম করে মলদ্বারে সেঁক দিলে ব্যথা অনেকটা উপশম হয়।
 

রক্ত আমাশয়ে

বহু পুরনো রক্ত আমাশা দূর করতে ৭ থেকে ৮ গ্রাম কালো তিল এবং তিন থেকে চার গ্রাম কুল গাছের মূলের ছাল কারণ একত্রে বেটে নিয়ে রস তৈরি করতে হবে এবং সেই রস অর্ধেক পরিমাণ দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে রক্তআমাশা নিরাময় হবে।
 

দাঁতের সেনসিটিভিটি সারাতে

অনেকেরই ঠান্ডা বা গরম কিছু খেলে দাঁত শিরশির করে ওঠে এবং অন্যান্য মাড়ির সমস্যা দেখা যায়। সেক্ষেত্রে দশ গ্রাম কালো তিল খোসা ছাড়িয়ে বেটে খেলে এই অসুবিধা অনেকাংশে কমে।
 

কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে

যারা অতিরিক্ত কোলেস্টেরল এবং রক্তে ট্রাইগ্লিসারাইড জনিত সমস্যায় ভুগছেন তারা তাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় তিল তেল ব্যবহার করতে পারেন। তিল বীজ থেকে নিঃসৃত তেল খারাপ স্নেহ পদার্থ শরীর থেকে সরিয়ে নির্দোষ স্নেহ পদার্থ সঞ্চয় করে সমগ্র সিস্টেমকে কার্যকারী রাখে।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১০: দশমহাবিদ্যা ও ঠাকুরের কালীভাবনা…

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৬: গলা সাধলেই লতাকণ্ঠী?

 

ক্যানসার প্রতিরোধ করতে

তিলবীজে উপস্থিত প্লুজসফেরল নামক রাসায়নিক পদার্থ ক্যান্সার প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা নেয়।
 

কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে

তিল বীজে থাকা ভালো স্নেহ পদার্থ পৌষ্টিকতন্ত্রে পিচ্ছিলতা প্রদান করে কোষ্ঠকাঠিন্যর দূর করে।
 

লিভারকে সুস্থ রাখতে

তিলবীজে উপস্থিত সেসামিন নামক জৈব রাসায়নিক পদার্থ লিভারকে সুস্থ রাখে।
 

ঋতুচক্র স্বাভাবিক করতে

অনিয়মিত ঋতুচক্রকে স্বাভাবিক করতে তিল তেলর ওষুধ ব্যবহার করা হয়। প্রাত্যহিক খাদ্য তালিকায় তিল রাখলে এই সমস্যা অনেকটা দূর হয়।
 

রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে

অনেকেরই মলদ্বার এবং জননেন্দ্রিয় দিয়ে থেকে রক্ত পড়তে থাকলে ১০ গ্রাম মতো কালোতিল সারারাত ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং পর দিন সকালে বেটে, আতকা দুধের সঙ্গে খালি পেটে খেলে এই রোগ নিরাময় হয়।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content