মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

বিশ্বকবির সুরের তালে মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে ‘কেতকী’ নামটা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরোচিত কেতকীর অন্তর্গত বর্ষা ঋতুর মন কেমন করা (“আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছয়ে…”, “আবার শ্রাবণ হয়ে এলে ফিরে…”, “আষাঢ় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো…”, “আমার নিশিত রাতের বাদল ধারা…”, “আজি নাহি নাহি নিদ্রা…”, “এমন দিনে তারে বলা যায়…” ইত্যাদি) গানগুলো আমাদের সকলেরই খুব প্রিয়। আবার কবিগুরুর বিভিন্ন গানের অভ্যন্তরেও আমরা কেতকী নামটা পেয়ে থাকি। কিন্তু জানেন কি ‘কেতকী’ নামটা একসময় ছিল নিষিদ্ধ। সুমিষ্ট গন্ধযুক্ত ফুলের গাছের নাম অনুসারে কেউ তাদের সন্তানদের নাম কেতকী রাখতেন না একসময়। পুরান মতে, কেতকী গাছ হল প্রাচীন ঋষিদের দ্বারা অভিশপ্ত একটি গাছ।

এই গাছের ফুল দেবাদিদেব মহাদেবের পুজোয় কোনওভাবেই উৎসর্গ করা যাবে না। স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী একদা ভোলা মহেশ্বর সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় ঋষিদের আশ্রম সংলগ্ন এক উদ্যানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। সেই সময় ঋষিমুণিরা আশ্রমে না থাকলেও ঋষি পত্নীরা পরম বলশালী ও যোগী পুরুষকে দেখে মোহিত হয়ে পড়েন। তাঁরা মুগ্ধতায় বশীভূত হয়ে নগ্ন শিবকে অনুসরণ করতে থাকেন।
পরবর্তীকালে ঋষিরা কুটিরে ফিরে এসে ঘটনাটি জানতে পেরে ভীষণভাবে রাগান্বিত হন এবং সম্পূর্ণ সত্য না জেনেই সেই পরম সত্য ও সুন্দর শিবকে অভিশাপ দেন। ঋষিরা বলেন, লিঙ্গ প্রদর্শনপূর্বক যে পুরুষ তাঁদের কুটিরের আশেপাশে ভ্রমণ করছিলেন তাঁর লিঙ্গ যেন খসে পড়ে। অভিশাপের ফলে দেবাদিদেবের লিঙ্গ খসে পড়ে কিন্তু তা ধরণীর এত গভীরে প্রবেশ করে যার আদি-অন্ত খুঁজে পাওয়া যায় না।

পরে একসময় মুণিঋষিরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এবং পালনকর্তা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন। ঋষিদের করুণ নিবেদনে বিষ্ণু পাতালে প্রবেশ করেন এবং ব্রহ্মা স্বর্গে যান লিঙ্গ ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু ভগবান বিষ্ণু লিঙ্গের কোনও আদি অন্ত না পেয়ে ফিরে আসেন। ব্রহ্মা স্বর্গে পৌঁছে বিফল হন কিন্তু তিনি ঋষিদের কাছে এসে কেতকী ফুলকে সাক্ষী রেখে বলেন যে তিনি লিঙ্গের অগ্রভাগের অন্তদর্শন করেছেন। ভগবান নারায়ণের প্রশ্নের জালে ব্রহ্মা যখন জর্জরিত তখন তিনি জানান যে তিনি মিথ্যা বলেছেন। মিথ্যা সাক্ষী দেওয়ার জন্য সেই থেকেই কেতকী ফুল অভিশপ্ত এবং এই ফুল ভগবান শিবের পুজোয় পরিত্যাক্ত। মনে করা হয় কাশির আদি-অন্ত হীন যে শিবলিঙ্গ তা হল এই কাহিনীর শিবলিঙ্গ।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, পর্ব-২৭: শরতের শিশির ভেজা শিউলি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪০: ব্রণ হয়েছে? তার মানেই কি লিভার খারাপ?

আবার লোকোকথায় প্রচলিত আছে যে দেবাদীদেবের অভিশাপের ফলেই নাকি কেতকী ফুল অভিশপ্ত। কৈলাসে একসময় মহাদেব এবং পার্বতী পাশা খেলছিলেন। সেই খেলাতে পার্বতী মহাদেবকে পরাজিত করেন এবং তিনি পরাজয়ের গ্লানি মুছতে কেতকী বনের অভ্যন্তরে গভীর ধ্যানে মগ্ন হন। পার্বতী স্বামীরে এই মনকষ্ট অনুভব করে তাঁকে আবার কৈলাসে ফিরিয়ে আনার জন্য এক সুন্দরী যুবতীর রূপ ধারণ করে তাঁর সম্মুখে আসেন। গভীর ধ্যানে মগ্ন দেবাদিদেব মহাদেব কোনওভাবেই অনুরক্ত এবং ধ্যানচুতো হন না। তখন পার্বতী সুকৌশলে কেতকী ফুল নিয়ে শিবের তপসায় বাধা সৃষ্টি করেন। প্রধান্বিত শিব তাঁর চক্ষু উন্মেলন করে কেতকী ফুলকে পুজোয় নিষিদ্ধ হওয়ার অভিশাপ দেন। তাই যতই কেতকী ফুল সুগন্ধের অধিকারী হোক না কেন শিব পূজোয় বা শিব মন্দিরের আশেপাশে কেতকীর আগমন নিষিদ্ধ।
আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল, পর্ব-৮: পার্ক, ইট, এঞ্জয়

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৭: অ্যাঁ, বলো কী নন্দলাল…!

 

এক নজরে

 

গাছের পরিচিতি

বিজ্ঞানসম্মত নাম: প্যানডানাস আমার্লিফোলিয়াস (Pandanus amaryllifolius)
সংস্কৃত নাম: কেতকী
বাংলা নাম: কেয়া বা কেওড়া বা কেতকী
গোত্র: প্যানডেনসি (Pandanceae)
 

গাছের বিস্তৃতি

কেয়া গাছের আদি উৎপত্তিস্থল হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মহাদেশ। কেতকী অর্থাৎ কেয়াগাছ দেখতে পাওয়া যায় ভারতবর্ষ শ্রীলঙ্কা, তাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন ইত্যাদি দেশগুলিতে। ১৭৭৮ সালে প্রথমবার ইন্দোনেশিয়া থেকে এই গাছ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আনা হয়। তারপর ধীরে ধীরে এটি সমুদ্র উপকূলবর্তী রাজ্যগুলিতে বিস্তার লাভ করে। আমাদের দেশের মধ্যে কেতকী গাছ কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, কেরালা, উড়িষ্যা এবং আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে পরিলক্ষিত হয়। পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবন উপকূলবর্তী অঞ্চলে কেয়া গাছের আধিক্য দেখা যায়।
 

গাছের প্রকৃতি

কেয়া অর্থাৎ কেতকী গাছ হল গুল্ম জাতীয় এবং একলিঙ্গ উদ্ভিদ। এই গাছ উচ্চতায় তিন থেকে চার মিটার হয়ে থাকে। গোলাকার ও কাঁটাযুক্ত কান্ড থেকে শাখা-প্রশাখা বের হয়। লম্বা ও সরু পাতাগুলি গাঢ় সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। গাছটি একলিঙ্গ হওয়ার কারণে পুরুষ কেতকী গাছকে বলা হয় সিত কেতকী এবং স্ত্রী কেতকী গাছকে ডাকা হয় স্বর্ণকেতকী /হেমকেতকী নামে। বর্ষাকালে (প্রধানত আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসে) স্ত্রী গাছের সবুজপাতার মধ্যে দিয়ে সুন্দর সাদা বর্ণের ফুল ফোঁটে এবং অত্যাধিক বৃষ্টির ফলে নুয়ে পড়া শুভ্র ফুলগুলি গাছের শোভা আরও বাড়িয়ে তোলে।

আরও পড়ুন:

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-১২: স্ট্যানলি ম্যাথুজ— একজন কিংবদন্তি, লড়াই আবেগ আর মেহনতী জনতার বন্ধু

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-8: চলতি কা নাম কিশোর

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

উদ্ভিদবিজ্ঞানের একাধিক গবেষণার ফলে জানা গিয়েছে, কেতকী ফুলের নির্যাস থেকে নিষ্কাশিত তেলের অভ্যন্তরে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ। সেগুলি হল বেঞ্জাইল অ্যালকোহল, বেনজাইল অ্যাসিটেট, বেনজাইল সালিসাইলেট, বেনজাইল বেনজোয়েট, ফিনাইল ইথাইল অ্যালডিহাইড, জেরানিঅল, ব্রোমোস্টাইরিন, ফিনাইল ইথাইল অ্যালকোহল ইত্যাদি ইত্যাদি।

ছবি: সংগৃহীত।

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

ব্যথার উপশমে

কেতকীর মঞ্জুরীপত্র থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা মাথার যন্ত্রণা ও কাঁধের ব্যথা ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এই তেল রিউমেটিক বাতের ক্ষেত্রেও খুবই উপকারী।
 

বলকারক হিসেবে

কেতকী গাছের মূল থেকে যে তেল পাওয়া যায় তা কামোত্তেজক এবং বলবৃদ্ধিকারক হিসাবে খুবই কার্যকরী।
 

চুলের সমস্যায়

মাথার চুল কালো করতে এবং খুশকি দূর করতে কেতকী পাতা বেটে তার রস মাথায় লাগাতে পারেন। মাথায় উকুন হলেও কেতকী পাতার রস লাগিয়ে রাখলে উকুন বিনষ্ট হয়।
 

নিদ্রাহীনতার ক্ষেত্রে

কেতকী ফুলের বাটা নির্যাস, তিলের তেলের সঙ্গে মিশিয়ে মাথায় আধঘণ্টা লাগিয়ে রাখলে নিদ্রাহীনতা অনেকাংশে কাটে।
 

ত্বকের সমস্যা ও ইউনানি চিকিৎসা

পদ্ধতিতে কেতকী গাছের পাতার রস সিফিলিস, গুটিবসন্ত রোগ, খোস পাঁচড়া নিরাময়ের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। শ্বেতী রোগ নিরাময়েও এটি কাজ করে।
 

শীঘ্রপতন দূরীকরণে

শীঘ্রপতন রোধ করতে কেয়া গাছের পরাগ উপকারী ভূমিকা নেয়।
 

হৃদরোগ নিরাময়ে

বর্তমান বিজ্ঞানে প্রমাণিত যে কেয়া গাছের পাতা নির্যাস হৃদরোগের ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
 

প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে

কেয়া ফুলের নির্যাস থেকে প্রাপ্ত জৈব রাসায়নিক তেল গুলি নানান ধরনের প্রসাধন শিল্পে (তেল, সাবান, ফিনাইল) ব্যবহৃত হয়।
 

মানসিক চিকিৎসা

চিকিৎসাবিজ্ঞানের আশীর্বাদে কেয়া গাছের ফুল এবং পাতা থেকে প্রাপ্ত বায়োকেমিক্যাল নির্যাস তথা ওষুধ মানসিক রোগীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।

এই সকল কারণেই হয়তো প্রাচীনকাল থেকে আয়ুর্বেদশাস্ত্রে এবং ইউনানি চিকিৎসাশাস্ত্রে কেতকীর বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content