রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


আয়ুর্বেদ শাস্ত্র মতে, পান দূরে রাখতে পারে নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা। ছবি: সংগৃহীত

“ভালোবাসার এমনই গুণ, পানের সঙ্গে যেমনই চুন।
বেশি হলে পোড়ে গাল, কম হলে লাগে ঝাল।”


পান নিয়ে তৈরি এই অসাধারণ ছড়াটা গ্রাম বাংলার মানুষের ভাব ও ভাবনার সঙ্গে এমন ভাবে মিলেমিশে ঘর বেঁধেছে যে, তা কোনওভাবেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসীদের কাছে পান পাতা হল ঐশ্বর্য এবং সতেজতার প্রতীক। আর এই পান পাতা নিয়ে বহু লৌকিক উপাখ্যান জড়িয়ে আছে ভারতীয় পুরাণে। স্কন্দপুরাণ অনুযায়ী, দেবতারা যখন অমৃতের জন্য সমুদ্রমন্থন করেছিলেন তখনই পান পাতা উঠে আসে সাগরের গর্ভদেশ থেকে।

তাই হিন্দুশাস্ত্র মতে, পানপাতার বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন দেব-দেবী অধিষ্ঠান করেন। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি দেবদেবীর অবস্থানের বর্ণনা দেওয়া হল।
● প্রথমত: ভগবান বিষ্ণু পান পাতার অভ্যন্তরে অবস্থান করেন।
● দ্বিতীয়ত: মহালক্ষী পান পাতার গোড়ার দিকে অধিষ্ঠান করেন।
● তৃতীয়ত: দেবী সরস্বতী পান পাতার মধ্যভাগে অবস্থান করেন।
● চতুর্থত: দেবরাজ ইন্দ্র এবং শুক্র দেবতা পান পাতার অগ্রভাগে অবস্থান করেন।
● পঞ্চমত: দেবাদিদেব মহাদেব এবং কামদেব পান পাতার বাইরের ত্বকে অধিষ্ঠান করেন।
● ষষ্ঠত: দেবী পার্বতী পান পাতার বাঁদিকে বিরাজ করেন।
● সপ্তমত: মাতা বসুমাতা পান পাতার ডানদিকে অবস্থান করেন।
● অষ্টমত: ভগবান আদিত্য অর্থাৎ সূর্য সমগ্র পান পাতা জুড়েই অবস্থান করে।
তাই হয়তো প্রতিটি পুজো বা মঙ্গলিক অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হল পানপাতা। তাই নারায়ণের আসন সাজাতে পান সুপারি, পুজোর ঘটের মুখে রাখা পান পাতা, নৈবেদ্য সাজাতে পানের খিলি, বরণডালাতে এবং পুরোহিতকে দক্ষিণা প্রদানের সময় যেমন পানের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, তেমনিই বিবাহের সময় শুভদৃষ্টিতে, বরণডালাতে, গায়ে হলুদের তত্ত্বে এবং হলুদ কোটার প্রথাতে এয়োদের মুখে পান সুপারির ব্যবহার আজও অব্যাহত। পান, বাংলা ও বাঙালির আচার, সংস্কার, অনুষ্ঠানে এতটাই জড়িয়ে আছে যে, মেয়েকে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর সময় পানমশলা-সহ পানের ডাবর পাঠানোর রীতি আজও চলে আসছে বাংলার ঘরে ঘরে। গ্রামবাংলায় একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে—

“পানের সজ্জা পানের ডাবর পান মসলার বাটি
কন্যারে পাঠালেম আমি করি পরিপাটি।”


এইসব কারণেই হয়তো অথর্ববেদের সময় থেকে আজও সপ্তসিরা অর্থাৎ পান ভারতীয় পুজোআচ্চা থেকে শুরু করে যে কোন শুভ কাজে অংশগ্রহণ করে চলেছে।
 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: পিপার বেটেল
● গোত্র: পিপারেসি
● বাংলা নাম: পান।
● সংস্কৃত নাম: তাম্বুল
● গাছের প্রকৃতি: উদ্ভিদবিদ্যা অনুসারে পান গাছ একটি লতানো গুপ্তবীজি এবং দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ। পান গাছ নিজের আরোহীমুলের সাহায্যে নিজে উপরের দিকে ওঠে।
● গাছের বিস্তৃতি: পান গাছের প্রাচীন উৎপত্তিস্থল হল দক্ষিণ এশিয়া। পান গাছের বিস্তৃতি ফিলিপিনস থেকে যাত্রা শুরু করে মালয়েশিয়া ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড, মায়ানমার, মাদাগাস্কার, নিউগিনি, মালদ্বীপ এবং ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে।

আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: গরমে রক্ষাকবচ ‘টম্যাটো’

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: ডায়াবিটিস এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির ক্ষতি হচ্ছে? কী ভাবে সমস্যা এড়েবেন

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: অজীর্ণ রোগে ঘরে বসেই আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে প্রতিকার সম্ভব

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

পান থেকে যেসব যৌগ নিষ্কাশিত করা গিয়েছে সেগুলি হল পলিফেনল, অ্যালকালয়েডস, স্টেরয়েড ট্যানিন ইত্যাদি। এছাড়াও নানা ধরনের অপরিহার্য তেল অর্থাৎ এসেনশিয়াল অয়েল পানের নির্যাসে খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। পানের রসে উপস্থিত আছে ক্যাভিবেটল, হাইড্রোক্সি ক্যাভিওল, পেপারবেটল, অ্যারিকলিন, ইউজইনল, ক্যাভিকল, কার্ভাক্রল ক্রায়োফেলিন, স্যাফরল, কার্ডিনিন, বিটা সিটোসেরল, পামেটিক অ্যাসিড, স্টেয়ারিক অ্যাসিড, পিপার লগিউমাইন, এসট্রাগল ইত্যাদি যৌগ।
 

চিকিৎসাশাস্ত্রে এর ব্যবহার

 

হজমশক্তি বর্ধনে

পানপাতা রস হজমশক্তি বাড়াতে এবং মুখের অরুচি ঠিক করতে খুবই উপকারী। তবে এই রস বাসি হলে এর কর্মক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়। প্রতিদিন খাওয়ার পর যদি নিয়ম করে একটি পান খাওয়া যায় তবে তা মুখে যে লালারস তৈরি করে তা আমাদের হজমশক্তি অনেকাংশে বাড়িয়ে তোলে।
 

চর্মরোগ নিরাময়

হাতে পায়ে হাজা হলে পানের রস অল্প গরম করে সারারাত লাগিয়ে শুলে, অনেকটা উপশম পাওয়া যায়। এমনকি, দাদ এবং চুলকানিতেও পানের রস বেশ কয়েকদিন ঘষে লাগিয়ে দিলে, কিছুদিন পর ওই স্থান সেরে ওঠে।
 

পুঁজ নিরাময়

পানের রস, পুঁজ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ভালো কাজ করে। পানির রসের সঙ্গে সমপরিমাণে জল মিশিয়ে কুলকুচি করলে দাঁতের মাড়ির ক্ষত এবং পুঁজ অংশ ধীরে ধীরে সরে ওঠে। কানে পুঁজ হলে পানের রস গরম করে দুই এক ফোটা করে কানে দিলে পুঁজ সেরে যায়। নখকুনির ক্ষেত্রেও পানের রস গরম করে দিনে তিন থেকে চার বার নখের কোণায় দিলে ব্যথা থেকে অনেকটা উপশম পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩২: কি ‘উপহার’ সাজিয়ে দেব

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৭: পঞ্চমের কথা মতো ড্রাম ছেড়ে অমরুতের পিঠের উপর স্যাম্পল রিদম বাজাতে শুরু করলেন ফ্রাঙ্কো!

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-৭: ভারতের উত্তরাধিকার, কৌরব ও পাণ্ডবগণ

 

জন্মনিয়ন্ত্রণ

আমাদের গ্রাম বাংলার একটি অতি পরিচিত টোটকা হল পানের মূল বেটে খেলে তা গর্ভনিরোধক হিসেবে কাজ করে। আধুনিক বিজ্ঞানের একটি জার্নালে,প্রকাশিত বিভিন্ন গবেষণা পত্র থেকে জানায় যে পান পাতা রসের মধ্যেও অ্যান্টিফার্টিলিটি প্রপার্টি উপস্থিত।
 

টিউমার ও ক্যানসার প্রতিরোধে

ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ফার্মাসিউটিক্যাল রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট এর আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে যে পান পাতা রসে উপস্থিত আছে, অ্যান্টিটিউমার, অ্যান্টি আলসার এবং অ্যান্টি মিউটাজেনিক যৌগ যা টিউমার, আলসার ও ক্যানসার নিরাময়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।

পান-পাতার নির্যাসে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান উপস্থিত আছে। সেগুলি হল বিটা ক্যারোটিন এবং আলফা টেকফেরাল। তাই এই পাতার নির্যাস একা অথবা হলুদের সঙ্গে যৌথভাবে চিবিয়ে খেলে মানুষের মুখের ক্যানসার অনেকাংশে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়।
 

ফোঁড়া নিরাময়

অত্যাধিক গরমের একটি অতি পরিচিত সমস্যা হল লোম ফোঁড়া এবং বিষ ফোঁড়া। এক্ষেত্রে পান পাতার সোজা পিঠে ঘি মাখিয়ে ফোঁড়ার উপর বসিয়ে দিয়ে হালকা করে ছেক দিতে হবে বেশ কয়েকদিন, তাহলেই দ্রুত ওই ফোঁড়া পেকে গিয়ে ফেটে যাবে।
 

শ্লেষ্মা নিয়ন্ত্রণে

শ্লেষ্মা নিয়ন্ত্রণে পান পাতা রসের একটা বিচিত্র বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। নতুন পাতার রস যেমন শ্লেষ্মা বৃদ্ধি করে, অন্যদিকে পুরনো পান পাতার রস শ্লেষ্মা অনেকাংশে সারিয়ে তোলে।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৯: প্লেগে কন্যার মৃত্যু, সেই শোক অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে পায় ভিন্নতর মাত্রা

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৫১: সর্বত্র নিরবিচ্ছিন্ন প্রচার প্রয়োজন, তবেই বাড়বে মাছ নিয়ে সচেতনতা, উপকৃত হবে আমজনতা

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১০: তত্ত্বতালাশ

 

যক্ষা নিয়ন্ত্রণ

যক্ষা হাঁপানি এবং ফুসফুস জনিত শ্বাস-প্রশ্বাসের রোগ নিয়ন্ত্রণেও পানের রস সক্রিয় ভূমিকা নেয়।
 

হৃদরোগ প্রতিরোধে

পান পাতায় উপস্থিত যৌগ রক্তের ঘনত্ব অনেকটা কমিয়ে হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং হৃদরোগ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে।
 

অন্যান্য রোগ ব্যাধি নিরাময়

এছাড়াও পান পাতা কুষ্ঠ রোগ নিয়ন্ত্রণে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে, বাতের রোগ দূর করতে এবং নার্ভের টনিক তৈরিতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে।
 

সাবধানতা

বিশেষ বিশেষ রীতিতে বা পার্বনের ঘরযোগে গুরুপাক খাবারের পর অথবা নিমন্ত্রণ বাড়ির চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় রকমারি পদ আহারের পর একখানা পান না হলে বাঙালির রসভঙ্গ হয়। পান যেন বাঙালির শেষ পাতের অমৃত। তবে যারা নিয়ম করে বেশি মাত্রায় পান খান তাদের ক্ষেত্রে একটা সাবধানতার কথা বলতেই হয়। অত্যাধিক হারে পান খাওয়ার ফলে পৌষ্টিকনালির পেরিস্টলসিস সঞ্চালন কমে যায় এবং এক্ষেত্রে হিতে বিপরীত হয়।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content