শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

শীতের দুপুর মানেই নানান ধরনের আচারের কথা মনে পড়ে আর মেয়েদের সব থেকে প্রিয় হল কুলের আচার। বিভিন্ন ধরনের কুল যেমন টোপাকুলই হোক বা নারকেল কুল বাঙালি মেয়ে-বৌদের শীতের দুপুরের সঙ্গী। কুল গাছকে ডাকা হয় বদ্রি নামে, যা সৃষ্টিকর্তা নারায়ণের অপর নাম। আমরা সবাই মহান তীর্থক্ষেত্র বদ্রীনাথ বা বদ্রীনারায়ণ নামটা শুনেছি। বদ্রীনাথ তীর্থস্থানে পর্বতের উপরে একটি বদরি বৃক্ষ অর্থাৎ কুল গাছ দেখতে পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়। এই কুল গাছ হিন্দুদের কাছে খুবই পবিত্র কারণ এই গাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি।

ত্রেতাযুগের রামায়ণও কুল গাছের অস্তিত্ব জানান দেয়। বর্বর রাক্ষস রাবণ যখন সীতাকে হরণ করে লঙ্কার উদ্দেশ্যে যান তখন শ্রীরামচন্দ্র ও লক্ষণ, সীতাদেবীকে বনের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে কুল গাছকে জিজ্ঞাসা করেন দেবীর কথা। কুল গাছ তখন জানান দেয় যে মাতা সীতাকে রাক্ষস রাবণ হরণ করেছেন এবং লঙ্কার উদ্দেশ্যে নিয়ে গিয়েছেন। বাধা দেওয়া সত্ত্বেও দেবীসীতাকে আটকাতে পারেনি এবং দেবীর নানান অলংকার তাঁর শাখা-প্রশাখায় আটকে যায়।
কুল গাছের এই বদান্যতা রামচন্দ্রকে মুগ্ধ করেন এবং তিনি আশীর্বাদ স্বরূপ বলেন যে, কুল গাছ চার যুগেই বর্তমান থাকবে। এমনকি মরুভূমি অঞ্চলেও। আবার শ্রীরামচন্দ্রকে ঘিরে অস্পৃশ্য সাভারির গল্পকথাতেও কুলের অস্তিত্ব আমরা পেয়ে থাকি। দুই ভাই যখন বনের মধ্যে সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েন তখন তাঁদের সাক্ষাৎ হয় অস্পৃশ্য সাভাবির সঙ্গে। সন্নিকটে থাকা একটি কুল গাছ থেকে কুল তুললেন এবং প্রতিটি ফলকে খানিকটা খেয়ে ফলের পক্কতা ঠিকঠাক বিচার করার পরেই শ্রীরামচন্দ্রকে খাওয়ার জন্য দিচ্ছিলেন।

ভগবান নারায়ণ সেই অস্পৃশ্যর এঁটো কুল নিজের ক্ষুধা নিভৃতির জন্য গ্রহণ করলেন। দরিদ্র অস্পৃশ্য ওই ভক্তের, ভগবানের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা অতি বিরল একটি উদাহরণ। বিতাড়িত সাভারি, শ্রীরামচন্দ্রের আশীর্বাদে আবার মালিনী রূপ পেয়ে তাঁর স্বামী গৃহে ফিরে যান। এই কুল ফল অর্থাৎ বদরিফল আজও বিভিন্ন পুজো অর্চনায় অর্ঘ্য হিসাবে নিবেদন করা হয়।
আমাদের অনেকেরই ঋষি পত্নী অরুন্ধতীর কথা জানা আছে। একদা অরুন্ধতীকে একা বনমধ্যে রেখে ঋষিরা হিমালয়ে ফল ও বনৌষধি আরোহণের জন্য গেলেন। তখন বনের মধ্যে খরা-দুর্ভিক্ষ চলছিল। দেবী অরুন্ধতি তখন সেই আশ্রমের থেকে পার্শ্ববর্তী আঞ্চলিক দুঃস্থদের একাগ্র মনে সেবা করতে লাগলেন। প্রায় ১২ বছর ধরে ওই অঞ্চলে খাদ্যাভাব ও খরা চলছিল। সেই সময় দেবাদিদেব মহাদেব ব্রাহ্মণের বেশ পরিধান করে দেবীর কাছে ভিক্ষা চাইলেন।

অরুন্ধতী জানালেন যে, তাঁর কাছে সেই মুহূর্তে কোনও খাবারই আর নেই। তিনি বন থেকে সংগ্রহ করা কুল ওঁকে খেতে দিতে পারেন। মহাদেবের নির্দেশ মতো অরুন্ধতী দেবী তখন কুল ফল রান্না শুরু করলেন এবং রান্না চাপিয়ে তিনি ভিক্ষুক ঋষির কাছে বসে তাঁর পবিত্র বাণী শুনতে লাগলেন। মহাদেবের মুখনিঃসৃত বাণী শোনা মাত্রই ১২ বছরের অনাহার, ক্লান্তি, দুঃখ সব যেন মুহূর্তে ভুলে গেলেন এবং তাঁর মনে হল যেন দ্বাদশ বছরে কিছুই ঘটেনি। খানিক পরেই ঋষিরা ফিরে এলেন। দেবাদিদেব তখন নিজের ছদ্মবেশ পরিত্যাগ করে ত্রিনয়নী মহেশ্বরের রূপ ধারণ করে দেবী অরুন্ধতীকে বরপ্রদান করলেন।

পৌরাণিক কাহিনিতে বর্ণিত আছে যে, অপ্সরা ঘৃতাচির রূপে মুগ্ধ হয়ে ঋষি ভরদ্বাজের বীর্য স্খলন হয়। সেই বীর্য থেকে জন্ম হয় অপরূপা সুন্দরী শ্রুরবতীর। কালের নিয়মে শ্রুরবতী যৌবনবতী হয়ে ওঠেন। একদা ঋষি ভরদ্বাজ ভ্রমণে গেলে সুরবতী দেবরাজ ইন্দ্রকে নিজের পতিরূপে বরণ করতে চাইলেন। তখন ইন্দ্র দেব ঋষি বৈশিষ্ঠের রূপ ধারণ করে এসে বললেন যে, তিনি যদি তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে চান তাহলে তাঁর দেওয়া বদ্রি ফলগুলি যতক্ষণ না সিদ্ধ অর্থাৎ নরম হচ্ছে তিনি যেন পক্ক করেন। কিন্তু সময় বয়ে যায়, জ্বালানিও একসময় শেষ হয়ে যায় কিন্তু কুল আর সিদ্ধ হয় না। তখন শ্রুরবতী নিজের দুই পা জ্বালানি হিসাবে দিয়ে কূল সিদ্ধ করতে থাকে অথচ কুল তখনও সিদ্ধ হয় না। অবশেষে সুরবতী এতটাই নিজ তপস্যায় একাগ্র ছিলেন যে নিজের সমগ্র অঙ্গ অগ্নিতে সমর্পণ করতে উদ্যত হন। অবশেষে দেবরাজ ইন্দ্র নিজে মহিমায় আত্মপ্রকাশ করে শ্রুরবতীকে বলেন যে তিনি তাঁর তপস্যায় মুগ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করার কথা জানান।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, পর্ব-২৯: পুজো-পার্বনের সঙ্গী কুশ

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৩: ঠাকুর সন্নিধানে সারদার কল্যাণব্রতে দীক্ষা

 

এক নজরে

 

গাছের পরিচিতি

কুল গাছের আদি উৎপত্তিস্থল চিন দেশ হলেও অনেকের মতে, কুলের অন্যান্য অনেক প্রজাতির প্রাচীন উৎপত্তিস্থল হল উত্তর ভারত।
বিজ্ঞানসম্মত নাম: জিজিমপাস জুজুবা। (Zizyphus jujuba)
বাংলা নাম: কুল।
সংস্কৃত নাম: ‘বদ্রী’।
বৈদিক শব্দাবিধান অনুযায়ী ‘বদর’ থেকে বদরি কথা এসেছে এবং বদর কথার অর্থ হচ্ছে ধৈর্য সাধক।
গোত্র: রেমনেসি (Rhamnaceae)।
 

গাছের বিস্তৃতি

কুল গাছের আদি উৎপত্তিস্থল চিন দেশ হলেও মতান্তরে এটি ভারতই প্রথম বিস্তার লাভ করেছিল। চিন ও ভারত-সহ এশিয়া মহাদেশে প্রায় সমগ্র অংশেই এই গাছ দেখতে পাওয়া যায়। এশিয়া এবং আফ্রিকা মহাদেশের উষ্ণ মরু বায়োম অঞ্চলে কুল গাছের পাঁচ থেকে ছয়টি প্রজাতির আধিক্য পরিলক্ষিত হয়। এছাড়াও ভেষজ গুণ বর্তমান থাকায় রাশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলেও কুলগাছ বর্তমানে চাষ করা হচ্ছে।
 

গাছের প্রকৃতি

কুল গাছ ছোট থেকে মাঝারি সাইজের গুল্ম জাতীয়, বহু শাখান্বিত, কাঁটাযুক্ত উদ্ভিদ। এই গাছের উচ্চতা ৩ থেকে ৪ মিটার আবার কখনো কখনো ১০ থেকে ১৬ মিটার পর্যন্তও হতে পারে। পাতা যৌগিক পত্র প্রকৃতির, পুষ্পবিন্যাস হলুদাভ সবুজ বর্ণের অ্যাক্সিলারি সাইম প্রকৃতির হয়। ফল গোলাকার অথবা ডিম্বাকার সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে এবং পাকলে হলুদ থেকে গাঢ় লাল রঙের হয়।

আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-১৭: জয়রামবাটির জগদ্ধাত্রীপুজো

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৪: সে যেন অন্য এক ‘পূনর্মিলন’

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

উপস্থিতের রাসায়নিক পদার্থ-ফুলের মধ্যে উপস্থিত থাকে ৭৩ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট, ৪ শতাংশ প্রোটিন এবং ৭ শতাংশ ফ্যাট। আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সোডিয়াম, জিঙ্ক ইত্যাদি খনিজ লবণ যথেষ্ট পরিমাণে থেকে থাকে। এছাড়াও নানান ধরনের ভিটামিন যেমন ভিটামিন এ, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন সি উপস্থিত থাকে। এগুলি ছাড়াও অ্যালফিটোলিক অ্যাসিড, বাটুলিনিক অ্যাসিড, ম্যাকলিনিক অ্যসিড, কলুব্রিনিক অ্যাসিড।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-১: প্রকৃতি অসমকে সাজাতে কোনও কার্পণ্যই করেনি

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৪৯: বেশি ঘুম শরীরের পক্ষে ভালো?

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

লিভার ক্যানসার প্রতিরোধে

কুল ফলের নির্যাস থেকে যে সকল জৈব রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যায় তা Hep-G2 অর্থাৎ হেপাটোমা কোষের সক্রিয়তা অর্থাৎ কার্যকারিতা কমিয়ে দিয়ে লিভার ক্যানসার দূর করতে সাহায্য করে ।
 

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে

কুলের বীজে বিভিন্ন রকমের জৈব রাসায়নিক তেল অর্থাৎ দোলাটাইল ওয়েল উপস্থিত থাকে যা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। এছাড়াও এই তেল ব্যাকটিরিয়া, ছত্রাকনাশক ও অন্যান্য মাইক্রবস ধ্বংস করার জন্য খুবই উপকারী।
 

রক্ত আমাশা প্রতিরোধে

কুলগাছে ছাল এক থেকে দুই গ্রাম বেটে তার সঙ্গে দুধ মিশিয়ে খেলে রক্ত আমাশা দূর হয়।
 

নিউরো প্রটেকটিভ হিসেবে

কুলে উপস্থিত ভেষজ পদার্থ সিজিনাল সর্দি কাশি, ঠান্ডালাগা, গলা খুসখুশের মতো অসুখে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। আয়ুর্বেদ স্বাস্থ্যমতে কুল পাতা বেটে তার সঙ্গে গোলমরিচ মিশিয়ে খেতে পারলে গলার স্বর পরিবর্তন এবং গলার খুসখুসানি দূর হয়।
 

হৃদরোগ প্রতিরোধে

বর্তমান বিজ্ঞানের অত্যাধুনিক গবেষণার দ্বারা কুলের নির্যাস থেকে কার্ডিওট্রনিক উৎপন্ন হয়। ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতিতেও হার্টের অসুখ প্রশমনে কুলের ব্যবহার উল্লেখ আছে।
 

মাথার যন্ত্রণা উপশমে

প্রচণ্ড মাথা ধরলে এবং মাথার যন্ত্রণা হলে কুল গাছের কঁচি পাতা ও কচি ডগ বেটে কপালে প্রলেপ লাগিয়ে রাখলে এই যন্ত্রণার অনেকটা উপশম হয়।
 

অশ্ব ও মলদ্বারের সমস্যা নিরাময়ে

অশ্বের যন্ত্রণা এবং রক্তপাতের ক্ষেত্রেও কুলপাতা সিদ্ধ করে তা একটি পরিষ্কার কাপড়ে পুঁটলি করে মলদ্বারে সেঁক দিলেও যন্ত্রণা ও ব্যথার উপশম হয়।
 

স্ত্রী রোগ উপশমে

শুকনো কুলের বীজ বাদ দিয়ে শ্বাস গুঁড়ো করে তা পাঁচ গ্রামের মতন নিয়ে আখের গুঁড় সঙ্গে পরপর কয়েকদিন খেলে মহিলাদের শ্বেতস্রাব বা রক্তস্রাব বা জননঅঙ্গের কষ্ট প্রশমিত হয়।
 

আমাশয় প্রতিরোধে

পেটের নানান সমস্যা ও আমাশয় নিরাময়ের ক্ষেত্রে ১০ থেকে ১৫ গ্রাম শুকনো কুল তিন কাপ জলের সিদ্ধ করে তা এক কাপের পরিণত করতে হবে। ওই সিদ্ধ জল সাদা দই ও দু’ চামচ বেদানার রস মিশিয়ে খেলে আমাশয় কমে যাবে।
 

মানসিক স্থৈর্য বাড়াতে

কুল ফলের মধ্যে উপস্থিত স্যাপোনিন নামক জৈব রাসায়নিক পদার্থ নিদ্রাহীনতা অর্থাৎ ইনসোমনিয়া কাটাতে কার্যকরী ভূমিকা নেয়। আমাদের নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশেও নদীতে মাঝিরা নৌকা যাত্রা সময় ‘বদর বদর’ বলে যাত্রা শুরু করেন অর্থাৎ যখন সমুদ্র উত্তাল হয়ে ওঠে তখন ঢেউয়ের মাঝে তারা বদর বদর বলে নিজেদের স্থৈর্য বাড়ায় এবং দুশ্চিন্তা দূর করে।

এ ভাবেই বৈদিক যুগ থেকে আজও আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ কুলকে ভগবান নারায়নের প্রতিরূপ মনে করে যেমন পূজার নৈবিদ্যে ব্যবহার করে আসছে তেমনই চিকিৎসা বিজ্ঞানেও কুল গাছের বিভিন্ন অংশের ব্যবহার ক্রমেই বেড়ে চলেছে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content