শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


“ও আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে…গাছে শিউলি ফুটেছে, কালো ভ্রমরা জুটেছে…” সলিল চৌধুরীর কথা ও সুরের লহোমায় সৃষ্ট ছোট্ট অন্তরার এই গান সকলকে জানান দেয় যে শরৎ এসেছে। শিশির ভেজা শিউলি যেন দেবীর আগমনীর সুর বয়ে নিয়ে আসে। স্বর্গের উদ্যান অমরাবতিতে বিরাজমান পারিজাত বৃক্ষই আসলে ধরাধামের শিউলি গাছ। শিউলির কমলা রঙের পুষ্পবৃন্তের ন্যায় দেবীর গাত্রবর্ণ হওয়ায় মা দুর্গার পুজো-অর্চনা ঝরে পড়া শিউলি দিয়েই হয়ে থাকে। যদিও ঝরে পড়া পুষ্প দিয়ে পুষ্পাঞ্জলি হয় না তবুও শিউলির ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এ বার পাঠকদের শোনাবো, কীভাবে এই পারিজাত বৃক্ষ দেবলোক থেকে আমাদের ধরাধাম এল। সমুদ্র মন্থনে উৎপন্ন পারিজাত বৃক্ষটি দেবরাজ ইন্দ্র নিজ উদ্যানে স্থাপন করেন। ইন্দ্রলোক মহিত করা এই গাছ শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় মর্তে আসে।

একদা মুনিবর নারদ ইন্দ্রলোকের উদ্যান থেকে একটি পারিজাত পুষ্প নিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে উপহারস্বরূপ দেন এবং তিনি অনুরোধ করেন যে প্রিয়তমা পত্নী রুক্মীনিকে প্রদান করার জন্য। অপরদিকে চতুর দেবর্ষি কৃষ্ণের প্রথমাপত্নী সত্যভামার কাছে গিয়ে বলেন যে তিনি খুবই মর্মাহত ভগবান কৃষ্ণের আচরণে কারণ দেবলোক থেকে আনা সেই বিশেষ পুষ্প শ্রীকৃষ্ণ রুক্মিণীকে প্রদান করেছেন এবং সত্যভামাকে বঞ্চিত রেখেছেন।

রাগে ও মনোকষ্টে জর্জরিত সত্যভামা তখন কান্নায় ভেঙে পড়লেন। শ্রীকৃষ্ণ তখন সত্যভামাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন তিনি আরও একটি পুষ্প তাঁর জন্য স্বর্গ থেকে আনাবেন। কিন্তু সত্যভা মা তাঁর ভালোবাসার প্রমাণস্বরূপ সমগ্র পারিজাত বৃক্ষটাকেই নিজের উদ্যানে চাইলেন। কিন্তু ইন্দ্রের উদ্যান থেকে সহজে এই বৃক্ষ আনা সম্ভব নয় জেনে ভগবান কৃষ্ণ রাতের অন্ধকারে দ্বাররক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে অতি সন্তর্পণে পারিজাতবৃক্ষ আনতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ধৃত শ্রীকৃষ্ণ তখন দেবরাজের সম্মুখীন হয়ে সমস্ত কথা জানালেন। দেবরাজ সহজে সেই পারিজাত বৃক্ষকে হারাতে চাইলেন না তাই তিনি শ্রীকৃষ্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন।
যুদ্ধের ফলস্বরূপ দেবরাজ ইন্দ্র পরাস্ত হলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ সেই পারিজাত বিক্ষোকে স্বর্গ থেকে মর্তে আনলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর সুন্দর কৌশল প্রয়োগ করে স্বর্গ থেকে আনা পারিজাত বৃক্ষটি এমনভাবে বসালেন প্রথমা স্ত্রী সত্যভামার উদ্যানে যাতে ওই বৃক্ষের পুষ্পসহ সমস্ত শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়ল দ্বিতীয়া স্ত্রী রুক্মিণীর উদ্যানে। ফলে দুই রানিকেই সন্তুষ্ট রইলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র সমুদ্র মন্থন থেকে প্রাপ্ত সেই বিশেষ পারিজাত বৃক্ষকে হারানোর ক্ষোভে অভিশাপ দিলেন যে মর্তের এই গাছে কোনওদিন ফল জন্মাবে না, বীজ হবে না। তারপর কৃষ্ণ সেই বিশেষ পারিজাত গাছকে সুকৌশলে এমন করে রোপন করলেন যে পারিজাত বৃক্ষের গুড়ি অর্থাৎ কাণ্ড অংশটি থাকবে সত্যভামার উদ্যানে এবং পুষ্প দ্বারা সজ্জি‌ত সমস্ত শাখা প্রশাখা গুলি থাকবে দ্বিতীয়াপত্নি রুক্মিণীর উদ্যানে। এ ভাবে নিজের লীলার কৌশলে দুই রানিকেই সন্তুষ্ট করলেন। রাতের অন্ধকারে ফোঁটা, এই ফুল কখনও দিনের আলোর মুখ দেখবে না।

এ বিষয়ে অবশ্য অন্য এক পৌরাণিক উপাখ্যান জড়িত আছে। এক সংবেদনশীল রাজার পারিজাত নামের সুন্দরী এক রাজকন্যা ছিলেন। নবযৌবন না সেই রাজকন্যা ভগবান আদিত্য অর্থাৎ সূর্যের প্রেমে অনুরক্ত হয়ে পড়েন। সূর্যদেবের নির্দেশে সেই রাজকন্যা সকল রাজ ঐশ্বর্য পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সূর্যের পায়ে সমর্পণ করলেন। বেশ কিছুদিন পর সূর্যদেব পারি যাতে প্রতি উদাসীন হয়ে তাকে ছেড়ে পুনরায় আকাশে বিলীন হয়ে যান।

অবশেষে বিরহ কষ্টে কাতর রাজকন্যা তখন প্রাণ ত্যাগ করেন। সেই রাজকন্যার চিতাভস্ম থেকে জন্ম হয় শিউলি গাছের। তাই শিউলি ফুল কোনভাবেই সূর্য রশ্মির মুখ দেখে না। রাতের অন্ধকারে ফুঁটে থাকা সেই ফুলগুলি ভোরের আলো দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝরে পড়ে। এ ভাবেই শিউলি ফুল প্রতিদিন সূর্য উদয় সঙ্গে সঙ্গে আত্মবিসর্জন দিয়ে শিশির ভেজা মাটির সবুজের সঙ্গে মিশে যায়।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, পর্ব-২৬: রাধা কৃষ্ণের মিলনস্থল ‘কদম গাছ’

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৬: আজগুবি ‘নয়’, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা!

 

এক নজরে

 

গাছের পরিচিতি

পারিজাত শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে সংস্কৃত শব্দ ‘পারিন’ থেকে। পারিন কথার অর্থ সমুদ্র। তাই পারিজাত বৃক্ষ হল সমুদ্রজাত বৃক্ষ। আমরা আগেই জেনেছি সমুদ্র-মন্থনের ফলে সৃষ্ট এই গাছ।
বিজ্ঞানসম্মত নাম: নিকট্যানথিস আর্বরট্রিটিস(Nyctanthes arbortritis)।
বাংলা নাম: শিউলি
সংস্কৃত নাম: পারিজাত
ইংরেজি নাম: বাবব (Babob)।
হিন্দি নাম: হরশিঙ্গার
গোত্র: অলিএসি। (Oliaceae)
 

গাছের প্রকৃতি

শিউলি গাছ হল বহুবর্ষজীবী, গুপ্তবীজী, দ্বিবীজপত্রী, সপুষ্পক, বহু শাখান্বিত স্বল্প উচ্চতা বিশিষ্ট বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। এই গাছের গুড়ি অপেক্ষাকৃত মোটা এবং রসালো প্রকৃতির হয়ে থাকে।
 

গাছের বিস্তৃতি

শিউলি গাছের আদি উৎপত্তিস্থল হল হিমালয় পাদদেশ সংলগ্ন দক্ষিণ এশিয়া। উষ্ণ আর্দ্র বায়োম এর অন্তর্ভুক্ত এই গাছ ইন্দো-চায়না, সুমাত্রা ও জাভা দ্বীপে অধিক পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এই গাছ জন্মায় ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোতে এবং আসাম, অরুণাচলপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ছত্তীসগড় ইত্যাদি রাজ্যেও।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৯: খাবারে একদম মশলা নয়?

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

শিউলি গাছের ফুল থেকে নিষ্কাশিত রাসায়নিক উপাদানগুলি হল আলফা পাইনেন, ফিনাইল অ্যাসিটালডিহাইড, পিসাইমেন ইত্যাদি।
শিউলি গাছের বীজে উপস্থিত থাকে ওলিক অ্যাসিড, স্টিয়ারিক অ্যাসিড, পামিটিক ক্যাসিড, লিগনোসেরিক অ্যাসিড, লিনোলেইক অ্যাসিড, নিকটেন্থিক অ্যাসিড, গ্লুকোজ, ম্যানোজ ইত্যাদি।
গাছের ছালে উপস্থিত থাকে নানান ধরনের অ্যালকালয়েড এবং গ্লাইকোসাইডস।
গাছের সবুজ পাতায় উপস্থিত থাকে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, গ্লাইকোসাইড, ডি ম্যানিটল, ট্যানিক অ্যাসিড, মিথাইল স্যালিসাইলেট, ক্যারোটিন, বেনজয়িক অ্যসিড, নিকোটিফ্লোরিন, ফ্রিডেলিন, অ্যাসকরবিক অ্যাসিড এবং অন্যান্য ভোলাটাইল অয়েল।

আরও পড়ুন:

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১২: স্বপ্নাদেশের দেবী ভবানী

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-৩০: আ দেখে জারা কিসমে কিতনা হ্যায় দম… এই গানে পঞ্চমের বাজি ছিলেন কিশোর ও আশা

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

পেটের অসুখ নিরাময়

চার থেকে পাঁচটি শিউলি পাতা ভালোভাবে ধুয়ে তা থেঁতো করতে হবে। তার তিক্ত রস খালি পেটে খেলে ক্ষুধা বৃদ্ধি করবে ও পেটের অসুখ নিরাময় করে। শিশুদের পেটের সমস্যার ক্ষেত্রে এই রস খুবই উপকারী।
 

অর্শের বেদনায়

যারা নিয়মিত অর্শের সমস্যায় ভুগছেন, তারা প্রতিদিন একটি করে বীজ জলের সঙ্গে গিলে খাবেন যতদিন না সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। এই বীজের পেস্ট বানিয়েও অর্শের স্থানে লাগালে উপকার পাবেন।
 

সর্দি-কাশির উপশমে

শিউলি পাতাতে তো রস খেলে জ্বর ও সর্দি কাশি সেরে ওঠে। আদিবাসীরা পাতার রসের সঙ্গে মধু মিশিয়ে ব্যবহার করেন শুকনো কাশি নিরাময়ের জন্য।
 

কৃমি বিনাশে

শিউলি পাতার রস নুনের সঙ্গে মিশিয়ে পরপর সাত দিন খেলে কৃমি নিরাময় হয়।
 

মানসিক অবসাদ দূরীকরণে

দুশ্চিন্তা, মানসিক অবসাদ, মাথা ধরা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও শিউলি জুড়ি মেলা ভার।
 

বাতের ব্যথা দূর করতে

শিউলি গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে নিষ্কাশিত তেল সায়টিক, রিউমেটিক ও আর্থারাইটিস অসুখের অব্যর্থ ওষুধ হিসেবে কাজ করে।
 

জীবাণুর সংক্রমণ বিনাশ করতে

শিউলি গাছের পাতা ফুল ও বীজ থেকে নিষ্কাশিত উপাদানগুলো অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল হিসাবে কাজ করে।
 

ত্বকের পরিচর্যায়

ত্বকের চর্চার ক্ষেত্রে শিউলি ফুলের রস ফেশমাস্ক তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। শিউলি পাতার রসের সঙ্গে সরষের তেল মিশিয়ে যে তেল তৈরি হয় তা দাঁত চুলকানি ইত্যাদি চর্মরোগ নিরাময়ে সাহায্য করে।
 

অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে

এই গাছের বিভিন্ন অংশ থেকে নিষ্কাশিত জৈব রাসায়নিক উপাদানগুলি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসাবে বিশেষ ভাবে কাজ করে থাকে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বলছে, এই গাছ থেকে নিষ্কাশিত উপাদানগুলি ইমিউনোস্টিমুলেটর হিসাবেও কাজ করে থাকে।
 

স্ত্রী রোগ নিরাময়ে

বর্তমান চিকিৎসা শাস্ত্রে মহিলাদের টনিক তৈরিতে শিউলি পাতার রস ব্যবহার করা হয়। স্ত্রীরোগ উপশমের ক্ষেত্রে আদিবাসীদের মধ্যে মাসিকের তিনদিন পর থেকে তিনটি কচিপাতা পাঁচটি গোলমরিচ সহযোগে পেটে খাওয়ানোর রীতি প্রচলন আছে।
 

চুলের সমস্যা দূর করতে

অকালে চুল পড়া, চুল পাকা এবং খুশকি নিরাময়ের জন্য শিউলি গাছের বীজ থেকে তৈরি তেল ব্যবহার করা হয়।

নানাবিধি রোগ নিরাময়ের জন্যই হয়তো ধর্মীয় সংস্কারের বন্ধনে আবদ্ধ রেখে পারিজাত অর্থাৎ শিউলি গাছকে আজও রক্ষা করার রীতি প্রচলিত আছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content