সোমবার ৭ অক্টোবর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

ভারতে আনুমানিক চার হাজার বছর আগে আম গাছের প্রথম চাষ শুরু হয়েছিল। প্রাচীন এই গাছকে হিন্দু পুরাণ মতে ইচ্ছাপূরণ বৃক্ষ হিসাবে অভিহিত করা হয় কারণ এই গাছ ভালোবাসা এবং উৎসর্গের প্রতীক। হিন্দু স্বাস্থ্য মতে আম গাছকে সৃষ্টির দেবতা ভগবান প্রজাপতি অবতার হিসাবে বিশ্বাস করা হয়। তাই প্রায় সব রকম শুভ কাজে এবং পূজার্চনায় আম্রপল্লব ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আম্রপত্রকে দেবতার উদ্দেশ্যে তর্পনের সময় বা জলদানের সময় চামচ হিসাবে ব্যবহার করা রীতি ও প্রচলিত হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। অতি প্রাচীন এই সুমিষ্ট ফলের গাছকে ঘিরে বাংলায় বহু লোকো কথা প্রচলিত আছে তার কয়েকটি কাহিনি আজ পাঠকদের শোনাবো।

● প্রথমত: পার্বতীর সঙ্গে একদা শিবের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। তখন দেবাদিদেব মহাদেব আম গাছের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারপরই ললিতার ইচ্ছায় মনকষ্টে কাতর শিব নিজের পার্বতীকে ফিরে পান এবং কৈলাসে ফিরে যাওয়ার পূর্বে নিজে বিবাহ সেরে ফেলেন ওই আম্র বৃক্ষের তলায়। আর এই কারণবশতই হয়তো আজও বিবাহস্থলে আম্রপল্লব ঝোলাবার ইতি চলে আসছে।

● দ্বিতীয়ত: আগেকার লোকেদের বিশ্বাস ছিল যে গর্ভাধানের সঙ্গে সঙ্গে যদি বাড়ি সংলগ্ন আম গাছে যদি নব আম্রপত্র বিকাশিত হয় তাহলে গর্ভবতী নারী পুত্রের সন্তানের জন্ম দেন।
● তৃতীয়ত: শিব ও পার্বতীর দুই পুত্র গণেশ ও কার্তিকের মধ্যে কে অধিক বুদ্ধিমান এটি জানতে ভীষণ রকম কৌতূহল প্রকাশ করলেন দেবতারা। দেবতারা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন কিন্তু ব্রহ্মা দেব জানালেন যে তিনি মনুষ্যদের সৃষ্টিকর্তা। তাই দেব সন্তানদের বিচার করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এক্ষেত্রে নারদ মুনি নিজ বুদ্ধি বলে এই সমস্যার সমাধান করতে পারে। অগত্যা দেবতারা নারদের শরণাপন্ন হলেন। দেবতাদের অনুরোধে নারদ মুনি একটি সোনালি পাকা আম মহাদেবের হাতে উপহার হিসাবে তুলে দিলেন এবং বললেন যে এই ফলটি হল জ্ঞানফল। যিনি এই ফলটি খাবেন তার ওপর চিরন্তর জ্ঞান ঝড়ে পড়বে। নারদের কথা শুনে শিব পার্বতী মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন যে ফলটি তাদের দুই সন্তানের মধ্যে ভাগ করে দেবেন। নারদ আবার ফন্দি এতে বললেন যে এটি আশীর্বাদ পষ্ট ফল তাই এই ফলটিকে খন্ডিত করা যাবে না এবং এই ফলটি একজন মাত্র পুরোপুরি খেতে পারেন। দেবী পার্বতী বিচলিত হয়ে বললেন, “তবে কি উপায়, মহাদেব?” শোনা মাত্র নারদ মুনি নিদান হাকলেন যে দুই ভাইয়ের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা হোক এবং যে প্রতিযোগিতায় জিতবে সে আম্র ফলটি লাভ করবে। কার্তিক ও গণেশকে ডেকে মনি বললেন যে, এই পৃথিবীকে যে প্রথমে তিনবার প্রদক্ষিণ করে ফিরবে সে এই প্রবৃত্ত জ্ঞান ফলটি লাভ করবে। শোন আমার তো ময়ূরের পিঠে চোরে পৃথিবী প্রদক্ষণ শুরু করলেন দেব সেনাপতি কার্তিক। কিন্তু এমন বিশাল চেহারা আর বাহন মুসিককে নিয়ে দাদা গণেশ চিন্তায় পড়লেন। তবে বুদ্ধির দ্বারা সিদ্ধিদাতা গনেশ তখন করজোড়ে তিনবার এক মনে নিজের পিতা-মাতাকে প্রদক্ষিণ করে প্রতিযোগিতা সম্পূর্ণ করে ফেললেন। ভাই কার্তিক ফিরে এসে দেখলেন সেই জ্ঞান ফল তখন দাদার হাতে। শুধু একটি আম্রফলকে কেন্দ্র করে নারদ এত বড় সমস্যা সমাধান করে ফেললে।

● চতুর্থত: এক সময় বুদ্ধের অবতারে মহাকপি বানর রাজ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রায় আসি হাজার সেনা নিয়ে গঙ্গাতীরে গভীর বনের মধ্যে একটি আম গাছে থাকতেন। তিনি বানর সেনাদের আদেশ দিয়েছিলেন যে একটিও ফল যেন মাটিতে না পড়ে তাহলে অনর্থ হবে। কিন্তু ঘটনাচক্রে একটি আম নদীর জলে পড়ে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছয় বজ্রায় ভ্রমণরত রাজা ব্রম্ভ দত্তের হাতে। অসংখ্য সৈন্য নিয়ে রাজা তখন সেই আমবাগান ঘিরে ফেললেন। তখন বানর রাজ নদীর দুই পাড়ের দুইটি গাছের শাখার উপর ভর করে শুয়ে পড়লেন এবং তার সেনাদের তার শরীরের ওপর দিয়ে অন্য পাড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন কিন্তু হিংসাপরায়ণ দেবদত্ত নামক বানরের ইচ্ছাকৃত অধিকতর বল প্রয়োগের ফলে মহাকবির শিরদাঁড়া ভেঙে গেল এবং তিনি মৃত্যুবরণ করলেন। এক রাজার নিজের প্রজাদের প্রতি এইরূপ আত্মত্যাগ দেখে মহারাজা ব্রহ্মদত্ত মহাকবি দেহ ওই আমগাছের নিচে সমাধিস্ত করলেন এবং তার ওপর একটি মন্দির স্থাপন করলেন।

আপনাদের অনেকেরই জানা আছে যে কোনও পুজোর সময় পূণ্য কুম্ভঘট স্থাপন করা হয় যা জলপূর্ণ থাকে। এই ঘরটি হল ধরিত্রীমাতার প্রতীক যার মধ্যে জল হল ‘জীবনদাত্রী’, ডাব হল পবিত্র ‘জ্ঞানচেতনা’ এবং আম্রপল্লব হল ‘জীবনে প্রতীক’। এই ভবেই বহুবচন ধরে ভারতীয়দের সংস্কার ও সংস্কৃতিতে আম গাছের নানা অংশ মিলেমিশে রয়েছে।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: ‘লঙ্কা কাণ্ড’

গা ছমছমে ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-২: কপালে জমেছে ঘাম, শুকিয়ে গিয়েছে জিভ, পেছন থেকে ভেসে আসছে গা ছমছমে শব্দ

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৪: স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের ‘রাত-ভোর

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬২: প্রথম রবীন্দ্রজীবনী

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: ম্যাঙ্গিফেরা ইন্ডিকা
● ইংরেজি নাম: ম্যাঙ্গো
● বাংলা নাম: আম
● গোত্র: এনাকারডেসি
● গাছের প্রকৃতি: আম গাছ হল গুপ্তবীজি, দ্বিবীজপত্রী, বহুশাখান্বিত বহুবর্ষজীবী এবং বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ।
● গাছের বিস্তৃতি: গভীর সুনিস্কাশিত এবং উর্বর দোআঁশ মাটি আম চাষের জন্য উপযুক্ত। একটু উঁচু বা মাঝারি জমি যেখানে বৃষ্টির জল কোনোভাবেই জমে না এমন জমিতে এবং উষ্ণ আদ্র জলবায়ুতে আম গাছ ভালো জন্মায়। আম গাছের আদি উৎপত্তিস্থল হলো দক্ষিণ এশিয়া মূলত ভারত, বর্মা এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ। আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যে আমের ব্যাপক চাষ হয় এবং ভারত প্রতিবছর বিদেশে আম রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। আম উৎপাদনে অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ বিহার, মধ্যপ্রদেশ এবং গুজরাত ইত্যাদি রাজ্য উল্লেখযোগ্য।
 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

প্রতি ১০০গ্রাম পাকা আমের কার্বোহাইড্রেট অর্থাৎ শর্করার পরিমাণ থাকে ১১.৬ গ্রাম, প্রোটিন থাকে ০.৯ গ্রাম এবং ফ্যাট থাকে ০.২ গ্রাম। এছাড়াও পাঁকা আমে থাকে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ এবং সাইট্রিক অ্যাসিড, মালিক অ্যাসিড, টার্টারিক অ্যাসিড নামক জৈব অ্যাসিড। ১০০ গ্রাম পাকা আমের শক্তির পরিমাণ ২৩০ কিলোজুল। আমে রয়েছে ফাইবার ১.১৭ থেকে ২.৬ শতাংশ, সিলিকা থাকে ০.৪১ শতাংশ, আয়রন থাকে ০.০৩ শতাংশ, এবং আঁশ থাকে ১.৭২-৩.৬৬ শতাংশ।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১০: কিশোর কণ্ঠের উপর যেন এক অলিখিত দাবি ছিল পঞ্চমের

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১৯: পাকা আম খাবেন, নাকি কাঁচা আম?

গল্প: ফিরে পাওয়া পঁচিশ

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে এর ব্যবহার

 

পাথুরি রোগ নিরাময়ে

কয়েকটি কচি আমের পাতা হালকা রোদে শুকিয়ে নিয়ে গুড়ো করে নিতে হবে। তারপর সেই গুরুর সঙ্গে জল মিশিয়ে সারারাত ভিজিয়ে রাখতে হবে। পরের দিন সকালে খালি পেটে সেই জল খেলে তা শরীরের অঙ্গ থেকে পাথরকে বিচ্ছিন্ন করে দেবে এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে অপসারণ করবে। শুধু কিডনি বা পিত্তথলির পাথর নয় এই জল থেকে আমাদের দেহের বিভিন্ন টক্সিন দূর হয়ে যাবে।
 

আমাশয়

কচি আমপাতার রস দুই থেকে তিন চা চামচ একটু গরম জলে খেলে আমাশয় সেরে যায়।
আবার আম গাছের ছালের রস এক থেকে দুই চাচা চামচ প্রায় ১০০ থেকে দেড়শ মিলি লিটার ছাগলে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে রক্ত আমাশয় অনেকটাই নিরাময় হয়। প্রয়োজনে এর সঙ্গে মধুও মেশাতে পারেন।
 

সিফিলিস নিরাময় করতে

আম গাছের ছালে প্রচুর পরিমাণে ট্যানিং উপস্থিত থাকে। আম গাছের বল্কল নিঃসৃত আঠা সিফিলিস রোগ সারাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়।
 

পেটের সমস্যায় ও বমি বমি ভাব

অনেক সময় পেট খারাপ হলে আম গাছের ছালের ভেতরে অংশ বেটে টক দই দিয়ে খেলে পেট খারাপ সেরে যায়। যাদের প্রায়ই বমি বমি ভাব হয়ে থাকে তারা তিন থেকে চারটি কচি আম পাতা জলের সিদ্ধ করে নিন এবং সেই জলটাকে ছেঁকে সমস্ত দিন ধরে একটু একটু করে পান করলে শরীরের দাহ এবং বমি বমি ভাব অনেকটাই কেটে যায়।
 

শরীর ঠান্ডা রাখতে

গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহে শরীরকে ভেতর থেকে ঠান্ডা করতে আম পোড়ার শরবত খুবই উপকারী। কাঁচা আমকে কাঠের আগুনে পুড়িয়ে শরবত তৈরি করা হয়।
 

রক্ত তৈরিতে

আমের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড থাকে যা রক্ত তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এছাড়াও এই ফলের মধ্যে ম্যাঙ্গিফেরলিক অ্যাসিড, লিউকোসায়ানিডিন, এম্বলিক অ্যাসিড এবং পারমেটিক অ্যাসিড ও পাওয়া যায়।
 

শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে

রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে আম পাতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। টাইপ ওয়ান ডাইবেটিস নিয়ন্ত্রণে আম পাতায় উপস্থিত যৌগ অন্থোসায়াানিডিন কার্যকারী ভূমিকা নেয়। এছাড়াও তিন-বিটা টেরাক্সেরল এবং ইথাইল অ্যাসিটেট রক্তের শর্করার মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।

আরও পড়ুন:

স্বাদে-আহ্লাদে: আম দিয়ে তৈরি এই লোভনীয় স্বাদের আচার খেয়েছেন?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৮: কোষার ভান্ডার ছররি থেকে কুঠাঘাট হয়ে কুরদার

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৪: একজন জ্ঞানী পণ্ডিত এবং ব্যবসায়ীর মধ্যে রাজা কাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?

 

ভিটামিন ও খনিজ লবণের চাহিদা মেটাতে

কাঁচা এবং পাকা উভয় আমিই একদিকে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ যেমন ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিসিয়াম, দস্তা সোডিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, জিংক, ম্যাঙ্গানিজ উপস্থিত থাকে অন্যদিকে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স এবং ভিটামিন সি থাকে যা আমাদের দেহ গঠনে সাহায্য করে।
 

হেঁচকির সমস্যায়

আম পাতা পুড়িয়ে যদি তার ধোয়া নিঃশ্বাসের সঙ্গে নেওয়া যায় তবে তা বিস্ময়কর ভাবে হেঁচকি দূর করে।
 

পৌরষ্য বৃদ্ধিতে

দুধের সঙ্গে যদি পাকা আমের রস মেশানো হয় তখন তাকে ‘সোমধারা’ বলা হয়। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে এই সোমধারাপুরুষদের বলদান করে এবং শুক্রবহ স্রোতকে শুদ্ধ করে।
 

দাঁত এবং চুলের সুরক্ষায়

কচি আম পাতা রস দিয়ে দাঁত মাজলে অকালে দাঁত পড়া বন্ধ হয়। হয়তো এই কারণবশতই ওড়িশার বাসি বিয়ের দিন আম পাতা দিয়ে বরের দাঁত মাজার একটা প্রথা আজও চালু আছে।
কচি আমের আঠা ও শাঁস থেঁতো করে জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে এবং সেই জল ছেঁকে চুলের গোড়ায় লাগালে চুল পড়া বন্ধ হয়ে যায়।
 

কাষ্ঠবদ্ধতা দূরীকরণ

পক্ক আমি ফাইবারের মাত্রা প্রচুর পরিমাণে থাকায় তা অনেকটা কাষ্ঠবদ্ধতা দূর করে। জলখাবারের সঙ্গে আম অথবা আম ও দুধ বা দই সহযোগে শরবত তৈরি করে খেতে পারলে তা কাষ্ঠবদ্ধতা দূরীকরণে সাহায্য করে।

এছাড়াও চড়কের বিধান অনুযায়ী, কচি আম হল রক্তপিত্তকর, মধ্য কাঁচা আম পিত্তকর এবং পাকা আম বর্ণ মাংস ও শুক্র দান করে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রমতে আমের বীজ কৃমিনাশক , রক্তের অর্শ বন্ধ করে এবং মেনরাহিয়া নিরাময়ে উপকারী ভূমিকা নেয়।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content