সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: সংগৃহীত।

বহু পূর্ব থেকেই ভারতে বিভিন্ন গাছ-গাছালিকে ঘিরে নানান পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে এবং এ দেশের মানুষের আত্মিক সংস্কারে দৃঢ় ছাপ ফেলেছে নানান গাছপালা। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলিদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র একটি গাছ হল শাল গাছ। আমারা অনেকেই জানি যে, ভগবান বুদ্ধের জন্মগ্রহণ, নির্বাণ লাভ এবং অন্তিম নিঃশ্বাস ত্যাগ হয়েছিল একটি বিশেষ শাল গাছের পাদদেশ। সিদ্ধার্থের মা মহামায়াদেবী প্রসবের পূর্বে পিতৃগৃহে যাওয়ার পথে লুম্বিনি উদ্যানে অবস্থিত একটি বিশাল শাল গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে নিচ্ছিলেন। ওই বৃক্ষের সুন্দর লাল ফুলগুলি এতটাই তাকে মুগ্ধ করেন যে তিনি তা তুলতে উদ্যত হন। ঠিক তখনই জন্ম হয় সিদ্ধার্থের। এই কারণবশতই আজও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত আছে যে নারী যদি সন্তান ধারণে ইচ্ছুক হন তবে তারা পুষ্পিত অবস্থায় শাল বৃক্ষকে নানান লৌকিক আচারে পূজার্চনা করেন।

বৌদ্ধ ধর্মাবলীদের কাছেও শাল গাছ অত্যন্ত প্রিয় একটি গাছ। এবার আসা যাক, হিন্দুদের কাছে এই গাছ কেন এত পবিত্র। শ্রীরামচন্দ্র বনবাসে থাকাকালীন রাক্ষস রাজ রাবণ দ্বারা সীতা হরণ হয়। দেবী সীতাকে উদ্ধারে প্রচেষ্টায় যখন দুই ভাই রাম লক্ষণ বনের মধ্যে ঘুরছিলেন তখনই তাদের সাথে বানরার সুগ্রীবের সাক্ষাৎ হয়।নিজ ভ্রাতা দ্বারা সিংহাসন চুত সুগ্রীব তখন নির্বাসিত হয়ে ওই বনেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলে। ঘটনাচক্রে ভগবান শ্রীরামের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তিনি নিজের মনকষ্ট প্রভুর সামনে তুলে ধরেন। শ্রীরামচন্দ্র সুগ্রীবকে তাঁর রাজত্ব ও স্বয়ীপত্নীকে ফিরে পাওয়ার আশ্বাস দেন এবং তার পরিবর্তে সুগ্রীবকে তার সৈন্য সামন্ত নিয়ে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ জানান। কিন্তু বানরাজ সুগ্রীবের মনে সংশয় হল যে, কীভাবে বনবাসী রামচন্দ্র প্রবল পরক্রমশালী বালীকে পরাজিত করে তার হারান সিংহাসন ফিরিয়ে আনবেন।
ভাই লক্ষণ তখন দাদার পরাক্রমশীলতার প্রমাণ দেখাতে ওই বনেই অবস্থিত পরপর সাতটি শাল গাছকে একটি তীরের ফলায় ছেদ করার জন্য অনুরোধ করেন দাদা রামচন্দ্রকে। নারায়ণ অবতারে ধনুর্বান রামচন্দ্র তখন একটি তীরের ফলায় ওই সাতটি বিশালাকার শাল গাছকে ছেদন করেন এবং তীরটি পুনরায় তাঁর সন্নিকটে ফিরে আসে। সমগ্র ঘটনাটা পরিদর্শন করার পর সুগ্রীবের মনের সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কেটে যায়।

এই কারণবশতই শাল গাছ হিন্দুদের কাছে অতি পবিত্র একটি বৃক্ষ রূপে আজও পুজো পেয়ে আসছে। ভারতীয় বহু লৌকিক লোকগাঁথায় শাল গাছের উল্লেখ পাওয়া যায়। গুজরাতের একটি অঞ্চলে বাবা ভীমনাথের আবাসস্থল হল একটি অতি প্রাচীন শাল গাছ। স্থানীয় বাসিন্দারা মহাদেবের ওই আবাসস্থলটিতে একটি সুসজ্জিত বিরাট মন্দিরে পরিণত করার জন্য ওই বৃক্ষ ছেদনে উদ্ধত হন। কিন্তু নির্মাণশিল্পীরা কাজ শুরু করার পূর্বেই বাবা ভীমনাথ তাদের স্বপ্নে দেখা দিয়ে সতর্ক করেন। ফলে ওই গাছ আর কাটা হয় না, আজও ভক্তরা ওই প্রাচীন শালবৃক্ষকে ঘিরে থাকা ছোট্ট একটি মন্দিরে বাবা-মহাদেবের দর্শনে যান। একই রকমভাবে শুধু লোকোকথা নয় লৌকিক চিকিৎসা পদ্ধতিতেও শাল গাছের ভূমিকা রয়েছে।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: এই ১০ সমস্যা দূর করতে জবা ফুলের জুড়ি মেলা ভার, জানতেন?

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: শোরিয়া রোবাষ্টা (Shorea robusta)
●বাংলা নাম: শাল।
●গোত্র: দীপ্তেরোকারপেস (Dipterocarpaceae)।
●গাছের বিস্তৃতি: শাল গাছের আদি উৎপত্তিস্থল ভারত উপমহাদেশ এবং হিমালয় পাদদেশের দক্ষিণ অংশ। বাংলাদেশ, ভুটান, চিন, নেপাল, পাকিস্তান ইত্যাদি দেশগুলিতেও শাল গাছের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। ভারতের মধ্যে মধ্যপ্রদেশ, অসম, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ মতো রাজ্যগুলিতে শাল গাছ প্রচুর পরিমাণে দেখা যায়।
●গাছের প্রকৃতি: শাল গাছ বহু বর্ষজীবী, কাষ্ঠল, দ্বিবীজপত্রী, সপুষ্পক উদ্ভিদ। এই গাছটি উচ্চতায় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। গাছের ছাল হালকা বাদামি বর্ণের এবং মসৃণ প্রকৃতির হয়ে থাকে। গাছের কেন্দ্রে কালো রঙের সারি কাঠ অর্থাৎ হার্ট উড (Heart wood ) উপস্থিত। গাছের পাতা প্রায় কুড়ি সেন্টিমিটার লম্বা, ডিম্বাকৃতি, সবুজ সরল একক পত্র। টার্মিনাল প্রকৃতি পুষ্পবিন্যাসে ছোট্ট ছোট্ট হালকা হলুদ ফুলগুলি সজ্জিত থাকে।
 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

শাল গাছের ছালে এবং পাতায় নানান ধরনের জৈব রাসায়নিক পদার্থ উপস্থিত থাকে। গাছের কাণ্ড অংশে উপস্থিত থাকে হপিয়াফেনল, ট্রাইটারপিনয়ড, লিউকো অ্যান্থো থ্রোসায়ানিডিন, তারপিন অ্যালকোহল এবং শাল গাছের বীজে উপস্থিত থাকে প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, পামিটিক অ্যাসিড, স্টিয়ারিক অ্যাসিড, ওলিক অ্যাসিড ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

কলকাতার পথ-হেঁশেল: অফিসপাড়ার ক্যান্টিন ডেকার্স লেনে কোলাহল

মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৪: ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে কোচস্থাপত্যের অন্যতম কীর্তি দেওতাপাড়া শিব মন্দির

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

ওজন নিয়ন্ত্রণে

৩০ বছর বয়সের পর থেকে অনেকেই অত্যাধিক মেদ এবং ওজন জনিত সমস্যায় ভোগেন। তারা একেবারে কচি শাল কাঠ ২৫ গ্রাম মতো থেতো করে ৫ কাপ জলে প্রথমে সিদ্ধ করে নেবেন। তারপর ওই জল ফুটিয়েদের কাপ মতো হলে ছেকে খেলে মেদ কমে যাবে এবং যারা অতিরিক্ত ধর্ম যাদের অতিরিক্ত ঘর্ম নিঃসরণ হয় তারাও এক্ষেত্রে উপকার পাবেন।
 

কৃমি জনিত সমস্যা দূরীকরণ

প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে, শাল গাছের কচি পাতা থেঁতো করে এক চামচ মত রস করে গরম জলে মিশাতে হবে এবং তারপর সেটা খালি পেটে ঠান্ডা করে খেলে কৃমি নাশ হবে।
 

ক্ষত এবং ঘা সারিয়ে তুলতে

শাল গাছের অভ্যন্তরে থাকা আঠা দিয়ে হতভাগা পরিষ্কার করলে তা তাড়াতাড়ি সেরে যায়।
 

গনেরিয়া রোগ নিরাময়

শাল গাছের আঠায় উপস্থিত রেসিন, টেনিন এবং অন্যান্য জৈব রাসায়নিক উপাদানগুলি গনেরিয়া রোগ নিরাময় সক্ষম।
 

আমাশয় ও বদ হজমে নিরাময়

নির্দিষ্ট পরিমাণে শাল গাছের আঠা নিয়ে চিনি সহযোগে খেলে আমাশা অনেকটাই সেরে যায় বলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্র দাবি করে।

বদহজম, গ্যাস, মাথা ধরা, ঝিমুনি ইত্যাদি ভাব দূর করতে তিন থেকে চারটি শাল পাতা চার কাপ জলে সিদ্ধ করে ফুটিয়ে তা এক কাপে পরিণত করতে হবে। তারপর এটিকে দুবেলা খাবারের পর খেলে এই সকল সমস্যা দূর হবে।
 

কানের পুঁজ সারাতে

শালগাছের কান্ডের ভেতরের অংশ নিয়ে তার ১০ গুণ পরিমাণ জল মিশিয়ে ফুটিয়ে ১/৪ করতে হবে। তারপর সেটিকে ছেঁকে বারে বারে কানে লাগালে কানের পুঁজ কমে যাবে।
 

শরীরের চুলকানি কমাতে

শাল গাছের সবুজ সতেজ পাতা জলে ফুটিয়ে অর্ধেক পরিমাণ করতে হবে। তারপর সেটিকে বারে বারে শরীরে লাগালে চুলকানি সেরে যাবে।
 

যৌনাঙ্গের রোগ সারাতে

শাল গাছের কচি কাঠ থেঁতো করে জলে সিদ্ধ করতে হবে এবং তা দিয়ে ধুলে রোগ নিরাময় হবে।

আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৫: সফল হোগি তেরি আরাধনা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৫: টনিক খাওয়া শরীরের পক্ষে ভালো?

 

আরও যে সব কাজে লাগে

চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যবহার ছাড়াও শাল কাঠের বহুল ব্যবহার দৈনন্দিন জীবনে লক্ষ্য করা যায়। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি কথা উল্লেখ করলাম।

শাল গাছ থেকে নির্গত রেসিন অর্থাৎ আঠা পূজার্চনার ক্ষেত্রে ধূনো হিসাবে ব্যবহার করা হয়।

গ্রামাঞ্চলে আদিবাসী সম্প্রদায় শাল বীজকে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে, কারণ এই বীজে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ক্যালশিয়াম উপস্থিত থাকে।

শাল গাছের কাঠ থেকে রেলে বগি, আসবাবপত্র, জানলা দরজা, কাঠের সেতু, নৌকা ইত্যাদি তৈরি হয়।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content