সোমবার ২৫ নভেম্বর, ২০২৪


রুদ্রাক্ষ। ছবি: সংগৃহীত।

শ্রাবণ মাস হিন্দুদের কাছে অন্তত্য পবিত্র, কারণ এই সময় ভগবান রুদ্র অর্থাৎ শিবের মাথায় জল ঢেলে পুজো দেওয়ার বহুল প্রচলন রয়েছে আমাদের দেশ। সর্বত্যাগী, ধ্যানমগ্ন দেবাদিদেব ও পার্বতীর দাম্পত্য লীলার অভিমান থেকেই জন্ম হয় রুদ্রাক্ষের। রাজকন্যা পার্বতীর সারা অঙ্গে অলংকারের ছটা ঝলমল করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু ভোলানাথ পার্বতীর অলংকারের প্রতি উদাসীন হওয়ায় দেবীর মনে অভিমান হতে থাকে।

একদিন বসন্তের আগমনে যখন তুষারাবৃত পর্বত অপরূপ শোভায় সেজে উঠলো, তখন পতিব্রতা পার্বতীর নারী সত্তায় এক অনুভূতি উত্তাল হয়ে উঠল। এরূপ পরিস্থিতিতে তিনি নিজেকে স্থির রাখতে না পেরে ধ্যানমগ্ন স্বামী দেবাদিদেবকে জানালেন, “আমি প্রকৃতির মতোই সেজে উঠতে চাই। স্বামী আপনি আমাকে অলংকার প্রদান করুন।” বাহ্যিক সৌন্দর্যে উদাসীন ভোলানাথ ধ্যান ভঙ্গ করে চক্ষু উন্মীলিত করেন। স্ত্রীর অভিমানী মন উপলব্ধি করে ভোলামহেশ্বরের চোখ অশ্রু সজল হয়ে পড়ে। সেই অশ্রু বিন্দু থেকেই জন্ম হয় রুদ্রাক্ষের। দেবাদিদেবের নির্দেশ মতো সেই রুদ্রাক্ষের বীজ দিয়ে তৈরি মালা, আমলেট, কানের ইত্যাদি অলংকারে সুসজ্জিত হন দেবী। পুরাণ অনুযায়ী, রুদ্রাক্ষ ভগবান শিবের অশ্রু বিন্দু থেকে উৎপন্ন, তাই শিবের আরেক নাম রুদ্র।

মতান্তরে শ্রীমৎ ভাগবত পুরাণে রুদ্রাক্ষকে কেন্দ্র করে একটি গল্পকথার উল্লেখ পাওয়া যায়। মায়া নামে এক দৈববলে শক্তিশালী অসুর মুনিঋষিদের ওপর খুবই অত্যাচার করতেন। সেই অসুর তিনটি ধাতু দিয়ে দুর্ভেদ্য তিনটি পুরি তৈরি করেন। একটি হয় সোনা দিয়ে, আরেকটি রুপোর এবং অন্যটি লোহা দিয়ে তৈরি করেন। এই তিনটি শহরকে একত্রে বলা হত, ত্রিপুর এবং মায়াসুর ত্রিপুরাসুর নামে ত্রাস সৃষ্টি করতে ত্রিলোক জুড়ে। দেবতারা এই অসুরের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে মহাদেবের শরণাপন্ন হন। মহাদেবের সঙ্গে ত্রিপুরাসুরের ঘোর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধের রথের সারথী হলেন স্বয়ং ব্রহ্মা এবং বিষ্ণু নিজে হলেন ধনুর্বান। মহাদেবের রথের চাকা হল সূর্য ও চন্দ্র। সেই যুদ্ধে ভগবান শিব রুদ্র মূর্তি ধারণ করে ত্রিপুরাসুরকে পরাজিত করে মুনিঋষি এবং দেবতাগণকে অত্যাচারের হাত থেকে মুক্ত করলেন।
দীর্ঘ যুদ্ধের শেষে দেবাদিদেবের শরীর থেকে শ্বেত বিন্দু নিঃসরণ হয় যা বিন্দু বিন্দু আকারে পৃথিবীতে পড়তে থাকে। সেই শ্বেত বিন্দু থেকেই রুদ্রাক্ষের জন্ম হয়। আর শিবমন্ত্র-সহ এই রুদ্রাক্ষ যদি কোনও মানুষ ধারণ করে তাহলে তা কঠিন তপস্যার মতো পূণ্য অর্জন হয়। রুদ্রাক্ষ-সহ যদি কোনও জন্তুও মারা যায়। তবে সে পরলোকে না গিয়ে শিবলোকে ঠাই পায়। এই কারণবশতই শিবপুরাণে ও পদ্মপুরাণে রুদ্রাক্ষকে শক্তির আধার হিসাবে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।

এই রুদ্রাক্ষ একমুখী, ত্রিমুখী, চতুর্মুখী, পঞ্চমুখী থেকে শুরু করে বহুমুখী হতে পারে। বিভিন্ন রুদ্রাক্ষকে বিভিন্ন দেব-দেবীর প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যেমন দ্বিমুখী রুদ্রাক্ষ-হর পার্বতী একত্রে, ত্রিমুখী -অগ্নি দেবতা, চতুর্মুখী-ব্রহ্মা দেব, পঞ্চমুখী-মহাকালেশ্বর শিব, ষষ্ঠ মুখী-দেবসেনাপতি কার্তিক, সপ্তমুখী-দেবী মহালক্ষী, অষ্টমুখী-সিদ্ধিবিনায়ক গণেশ, নবমুখী-দুর্গা, দশমুখী-বিষ্ণু, একাদশমুখী-শ্রী হনুমান, দ্বাদশমুখী-আদিত্য, ত্রয়োদশমুখী-কামদেব, চতুর্দশমুখী- শিব ও বজরংবলী একত্রে, পঞ্চদশমুখী-পশুপতিনাথ, ষোড়শমুখী-রুদ্রাক্ষ, সপ্তদশমুখী-বিশ্বকর্মা, অষ্টাদশ মুখী-মা বসু মাতা।

প্রতিটি রুদ্রাক্ষ মানব জীবনের ভিন্ন ভিন্ন কাজকে সম্পন্ন করে। মন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে যদি দিনে শতবার রুদ্রাক্ষের মালা জপ করা যায় তবে তা জীবনে সুখ-শান্তি নিয়ে আসে। তবে সাধারণ সাংসারিক মানুষের ক্ষেত্রে রাশি ও লগ্ন ফল এবং নাক্ষত্রিক যোগ বিচার বিবেচনা করেই রুদ্রাক্ষ ধারণ করতে হয়।

রুদ্রাক্ষকে আবার পুরাণ মতে গোত্র অনুসারেও ভাগ করা হয়ে থাকে। যেমন শিব গোত্র, শিখা গোত্র, জ্যোতি গোত্র, সাবিত্রী গোত্র ইত্যাদি। শিব গোত্রের রুদ্রাক্ষ গুলির নাম হল-প্রজাপতয়, মহিপাল, কপোট, গ্রন্থিক। শিখা গোত্রের মধ্যে থাকে-কুটিল, বেতাল, পদ্মমহানস। জ্যোতি গত্রের অন্তর্ভুক্ত রুদ্রাক্ষের নাম হল-ধৃতরাষ্ট্র, গোপাল, বক। সাবিত্রী গোত্রের রুদ্রাক্ষ গুলি হল কুটিকা, গুটিকা, দণ্ডিন, শরৎ।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: টেম্পেল ট্রি চাঁপার এই গুণগুলি সম্পর্কে জানতেন?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৪: কোন সকালে মুক্তির অপেক্ষায় ‘ত্রিযামা’

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: এলিওকার্পাস জেনিট্রাস।(Elaeocarpus ganitrus)
● গোত্র: এলিওকার্পিসি।(Elaeocarpaceae)
● গাছের প্রকৃতি: রুদ্রাক্ষ গাছ বহুবর্ষজীবী, মাঝারি উচ্চতা বিশিষ্ট শাখান্বিত, সপুষ্কক উদ্ভিদ। গাছটি উচ্চতায় ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। গাছের পাতাগুলি সবুজ হলেও শুকনো পাতা হালকা লাল রঙের হয়ে থাকে। পুষ্পবিন্যাস ‘এক্সিলারি রেসিম’ প্রকৃতির হয়ে থাকে। ছোট ছোট সাদা রঙের ফুলগুলিতে হালকা বেগুনি আভা লক্ষ্য করা যায়। ফল নীলাভ বেগুনি রঙের হয়ে থাকে এবং এর মধ্যস্থ বীজ সম্পূর্ণ অবস্থায় পাথরের ন্যায় শক্ত হয়।

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

উপস্থিত রাসায়নিক পদার্থ-রুদ্রাক্ষে বিভিন্ন ধরনের অ্যালকালয়েড বা উপক্ষার উপস্থিত থাকে। এই উপক্ষারগুলি হল এলিওকার্পিন, কুয়েরসেটিন, ফ্ল্যাভোনয়েডস, রুদ্রকাইন ইত্যাদি। রুদ্রাক্ষের তেলের মধ্যে উপস্থিত থাকে স্টিয়ারিক অ্যাসিড, আইসোপ্যামেটিক অ্যাসিড।

আরও পড়ুন:

অমর শিল্পী তুমি, পর্ব-৩: অভিনয় নয়, কিশোর মনে-প্রাণে একজন গায়ক হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করতে চেয়েছিলেন

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৭১: ইংরেজের চোখে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন ‘দাগী আসামী’

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

মানসিক অবসাদ দূরীকরণে

রুদ্রাক্ষে উপস্থিত তড়িৎ চুম্বকীয় আবেশ এবং প্যারাম্যাগনেটিক আবেশ মানব শরীরে নিউরোফিজিওলজি এবং হিউম্যান সাইকোলজিতে ব্যবহার করা হয়। রুদ্রাক্ষ অনিদ্রা নিয়ন্ত্রণ করে এবং মনকে শান্ত রাখে।
 

রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে

হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে রুদ্রাক্ষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। হৃদরোগ প্রতিরোধ করে রুদ্রাক্ষ। গ্রাম বাংলার বুকে এখনও রোগীদের পালস ক্ষীণ হয়ে এলে হৃদ যন্ত্রকে সক্রিয় রাখার জন্য রুদ্রাক্ষ ঘষা ও মধু নির্দিষ্ট মাত্রায় মিশিয়ে রোগীকে খাওয়ালে তা ‘কোরামিনের’ মতো কাজ করে।
 

জীবাণু ধ্বংস করতে

রুদ্রাক্ষ তেলের রাসায়নিক বিশ্লেষণে দেখা গিয়েছে যে এটিতে ভিটামিন-সি, সাইট্রিক অ্যাসিড উপস্থিত থাকে যা অ্যান্টিভাইরাল, আন্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টি-ফাংগাল এবং অ্যান্টি-প্রোটোজুয়াল হিসাবে কাজ করে।
 

যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে

প্রাচীন আয়ুর্বেদ মতে রুদ্রাক্ষ ঘসা, যক্ষ্মা রোগের ওষুধ হিসাবে কাজ করে। রোগের প্রাথমিক অবস্থায়, রুদ্রাক্ষ যদি তুলসী মঞ্জুরীর সঙ্গে ঘষে খাওয়ানো যায়। তবে তার যক্ষ্মা রোগের উপকারী ওষুধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
 

মৃগী রোগ প্রতিরোধে

রুদ্রাক্ষ থেকে পাওয়া ইথানল নির্যাস মৃগী রোগ উপশমে কার্যকারী ভূমিকা নেওয়া।
 

ক্রিমিনাশক হিসেবে

সারারাত রুদ্রাক্ষ ভেজানো জল সকালে খালি পেটে খেলে তা কৃমিনাশক হিসেবে কাজ করে। শরীরের অন্যান্য ব্যাধির ক্ষেত্রেও রুদ্রাক্ষ ভেজানো জল খালি পেটে খুবই উপকারী।

আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৬৮: উন্নতমানের প্রোটিনের উৎস বলেই মাছ এত জনপ্রিয়

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৭: গৃহিণী সারদার প্রথম দক্ষিণেশ্বর আগমন

 

আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণায়

আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণায় নানান মুখি রুদ্রাক্ষ শরীর ও মনের জন্য খুবই উপকারী। যেমন—
দ্বিমুখী রুদ্রাক্ষ রোম্যান্টিক ইচ্ছা পূরণ করে।
ত্রিমুখী রুদ্রাক্ষ স্বাস্থ্য ভালো রাখে। উচ্চশিক্ষা লাভে সাহায্য করে।
চতুর্মুখী রুদ্রাক্ষ সুস্থতা, বুদ্ধি বৃদ্ধি ও অনান্য সুখবৃদ্ধি করে।
পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষ আনন্দ বয়ে আনে জীবনে।
ষষ্ঠমুখী শারীরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
সপ্তমুখী জ্ঞান ও মানসম্মান প্রদান করে।
অষ্টমুখী সকল বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে জীবনে শান্তি বয়ে আনে।
নবমুখী রুদ্রাক্ষ ধন-সম্পদ বৃদ্ধি করে ও ঐশ্বর্য বাড়িয়ে তোলে।
দশমুখী রুদ্রাক্ষ সুস্বাস্থ দান করে।
একাদশমুখী রুদ্রাক্ষ দাম্পত্য জীবনে সুখদন করে ও দীর্ঘায়ু প্রদান করে এবং
দ্বাদশমুখী রুদ্রাক্ষ আধ্যাত্মিক জ্ঞান লাভ করিয়ে জীবনে মুক্তি ও আলোর পথ দেখায়।

এ সব কারণেই হয়তো প্রাচীন বৈদিক যুগ থেকে ভারত সহ চিন, জাপান ও অন্যান্য এশিয়া মহাদেশের দেশগুলিতে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মানুষজন রুদ্রাক্ষ ধারণ করে আসছে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

আপনার রায়

ইসরোর চন্দ্রযান-৩ কি তৃতীয় বারের এই অভিযানে সাফল্যের স্বাদ পাবে?

Skip to content