রবিবার ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


কদম ফুল। ছবি: সংগৃহীত।

যে বৃক্ষের সঙ্গে বর্ষা ঋতু ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে সেই গাছের পৌরাণিক ও বৈজ্ঞানিক দিকগুলি আজ পাঠকদের জানাব। সুখ-সৌভাগ্য ও ঐশ্বর্যের প্রতীক কদম্ব বৃক্ষ অর্থাৎ কদম গাছে ফুল ফোটে না বর্ষার গর্জন না শুনলে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্ম মতে, এই কদম গাছ নানান দেব-দেবী আবাসস্থল। প্রেমের ঠাকুর শ্রীকৃষ্ণ মধুবনে একটি কদম গাছের নিচে বসেই বাঁশি বাজাতে এবং তাঁর প্রেয়সী রাধিকা ও গোপিনীদের সঙ্গে কদম গাছের তলায় নৃত্য করতেন। আবার কালিয়নাগ দমনের পূর্বে শ্রীকৃষ্ণ কদম্ব বৃক্ষের ওপরে আরোহন করেন এবং সেখান থেকেই যমুনার জলে ঝাঁপ দেন কালিয়ানাগকে বিনাশ করতে। গরুর পাখি স্বর্গলোক থেকে মর্তে অবতরণ করে ওই কদম গাছেই বসতেন।

এই কদম গাছ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কৃপায় অমরত্ব লাভ করেছে। আবার বৃন্দাবনের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় যে, গোপিনীরা যমুনায় স্নান করার পূর্বে তাঁদের বস্ত্র যখন নদীর তীরে রেখেছিলেন তখন ছোট্ট কৃষ্ণ তাঁদের জব্দ করার জন্য সেইসকল বস্ত্র কদম গাছের একটি শাখায় ঝুলিয়ে দেন এবং সেই গাছেই আত্মগোপন করেন। কদম গাছকে ঘিরে কৃষ্ণলীলা যতই বলা হবে ততই যেন কম হবে।

এই কারণেই হয়তো, বৃন্দাবন বাসীদের নিকট কদম গাছ অত্যন্ত পবিত্র এবং কৃষ্ণপ্রেমীরা কদম ফুল দিয়ে কৃষ্ণ মন্দির সাজাতে এবং অঞ্জলি দিতে খুব ভালোবাসেন। এই কদম গাছকে কেন্দ্র করে সমগ্র ভারত অর্থাৎ উত্তর থেকে শুরু করে দক্ষিণের মানুষের মনের মধ্যে ধর্মীয় ভাব বিরাজ করছে। উত্তর ভারতে যেমন কদম গাছ শ্রীকৃষ্ণ অর্থাৎ পালনকর্তা নারায়ণের সঙ্গে অতপ্রতভাবে জড়িত তেমনই দক্ষিণ ভারতের মানুষের বিশ্বাস যে মা চণ্ডী রুপী দুর্গা এই কদম গাছেই অধিষ্ঠান করেন। শক্তিরূপীনি দুর্গার দাক্ষিণাত্যের মন্দির “মিনাক্ষী মন্দির”-র সামনে একটি বিশাল কদম্ব বৃক্ষ রোপিত আছে।
কর্নাটকের রাজা কদম্ব রাজের নির্দেশ মতো ওই গাছের নামকরণ করা হয় কদম্ব বৃক্ষ এবং সেই সময় থেকেই এই গাছকে অতিপবিত্র গাছ বলে মনে করা হয়। প্রাচীন রাজার সম্মানে কর্ণাটক সরকার প্রতিবছর কদম্ব উৎসব পালন করেন। “কদম্ব” উৎসবটি পালন করা হয় প্রতিবছর ভাদ্র মাসে শুক্লা একাদশী তিথিতে। উৎসবের দিনে একটি কদমশাখা নিয়ে জমিতে পুঁতে পুজো করা হয় এবং তারপর নানান সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সারাদিন ধরে চলতে থাকে। দিনের শেষে নতুন ধানের শীষ প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করার প্রচলন হয়ে আসছে কর্নাটকে অধিবাসীদের ক্ষেত্রে। এ ভাবেই বছরের পর বছর ধরে কদম গাছ দাক্ষিণাত্যের মানুষের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে।

ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত রাজা উত্থানপদ এবং রানি সুনিতির পুত্র ‘ধ্রুব’-র নাম অনেকেই শুনেছেন কিন্তু জানেন কি যমুনা তীরে একটি কদম গাছের তলায় বসেই ধ্রুব তার সাধনা পর্ব শুরু করেন। পৌরাণিক কাহিনিতে জানা যায় যে ছোট্ট ধ্রুব সাধনার প্রথম পর্বে তিনি কদমগাছের কন্দ এবং মূল চিবিয়ে খেয়ে বেঁচে থাকতেন এবং দ্বিতীয় পর্বে শুকনো পাতা চিবিয়ে জীবন অতিবাহিত করতেন এবং তৃতীয় পর্বে শুধুমাত্র যমুনার জল খেয়ে সাধন পর্ব চালান। তারপর তিনি চতুর্থ স্তর থেকে বায়ু সেবন করে ও অন্তিম পর্বে শ্বাস বন্ধ করে একাগ্র চিত্রে বিষ্ণু সাধনা করেছিলেন এবং ফলস্বরূপ সিদ্ধিলাভ করেন। বিষ্ণুর পরম ভক্ত ধ্রুবর নাম অনুসারে জ্যোতিষ্কমণ্ডলের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল গ্রহটির নামকরণ করা হয় ধ্রুবতারা।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি, পর্ব-২৫: স্বাদ আনে, স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী, তিল বীজ ব্যবহারে কী লাভ?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৮: খেলার ছলে এসেছিনু যেথা ‘হারজিৎ’-র পর্ব রাখিনু সেথা

কদম্ব উৎসবের মতোই উড়িষ্যায় একটি উৎসব পালিত হয় যাকে “করম উৎসব” নামে অভিহিত করা হয়। এই উৎসব প্রচলনের পিছনে রয়েছে একটি লৌকিক উপাখ্যান। উড়িশার এক গ্রামে এক ব্যবসায়ী তাঁর সাতকন্যা ও সাত পুত্রদের নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করতেন। একদা বাণিজ্যের কারণে দূরদেশে রওনা হবার পূর্বে তিনি তাঁর পুত্র,কন্যা ও জামাতদের ডেকে তাঁর ব্যবসায়ের দায়িত্ব দিলেন। বণিকের বিদেশে গমনের পরপরই তার সন্তানরা প্রচুর পরিশ্রম করলেন কিন্তু ফলস্বরপ ব্যবসায় উন্নতি করতে পারলেন না। দিনে দিনে তাঁরা দুর্ভাগ্যের শিকার হতে লাগলেন।

এমন সময় এক ব্রাহ্মণের নিকটে তাঁরা তাদের দুঃখের কথা জানালেন। তখন সেই ব্রাহ্মণ বললেন যে গ্রামের বিশেষ একটি কদম্বগাছে যে কদমরাজ ও কদমরানি থাকেন তাদের পুজো করলে তাঁরা সুখ-সৌভাগ্য ফিরে পাবেন। ব্রাহ্মণের নির্দেশ মতো ওই বণিকের পুত্রকন্যা ও জামাতারা সকলে মিলে কদম গাছকে কেন্দ্র করে একটি মন্দির তৈরি করলেন এবং সমস্ত উপাচার মেনে পুজো শুরু করলেন।
আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১৪: সুন্দরবনের মৎস্যদেবতা মাকাল

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৮: চল্লিশ পার হলেই নিরামিষ?

এমন সময় বাণিজ্য থেকে বণিক ফিরে এসে উৎসবমুখর সন্তানদের প্রতি অত্যাধিক ক্রধান্বিত হয়ে ওই মন্দির ভেঙে দিলেন। ফলস্বরূপ, কদম রাজ ও কদমরানি ওই বৃক্ষ পরিত্যাগ করলেন এবং ওই বৃক্ষটির মারা গেল। তারপরই বণিকের জীবনে নেমে এলো ঘোরতর দুর্ভাগ্যের অন্ধকার। মনে কষ্টে বনিক আবার সেই ব্রাহ্মণের শরণাপন্ন হলেন। ব্রাহ্মণ তখন বণিকের পূর্বের অহংকারী আচরণের জন্য তাঁকে চরমভাবে তিরস্কার করলেন। ব্রাহ্মণ নির্দেশ দিলেন যে বণিক যদি গভীর অরণ্যের মধ্যে থাকা সেই কদম গাছকে খুঁজে কদমরাজ ও কদমরানিকে কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁদের নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে এনে পুজো করেন। তবেই তিনি আবার পূর্বের সুখ-সমৃদ্ধি-সৌভাগ্য ফিরে পাবেন। ব্রাহ্মণের নির্দেশ মত বণিক নিজের বাড়ির সন্নিকটে একটি মন্দির স্থাপন করে কদমরাজ ও কদম রানিকে সেখানে পুজো করলেন। তারপর থেকে বণিক সপরিবারে সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলেন। এরপর থেকেই ওড়িশায় “করম উৎসব” পালিত হতে থাকে।
 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত পরিচয়: বিজ্ঞানসম্মত নাম-অ্যান্থ্রসেফালাস ইন্ডিকাস। (Anthocephalus indicus)
● বাংলা নাম: কদম।
● সংস্কৃত নাম: কদম্ব।
● গোত্র: রুবিয়েসি।
● গাছের প্রকৃতি: কদম গাছ হল বহুবর্ষজীবী, বহু শাখান্বিত, গুপ্তবীজী, বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। গাছটির কাণ্ড কাস্টল প্রকৃতির হয়ে থাকে। বর্ষা ঋতুতে হলুদ বর্ণের ফুল ফোটে।

আরও পড়ুন:

পরিযায়ী মন, পর্ব-৬: বৈতরণীর পারে…

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১৫: আর যাহা খায় লোকে স্বদেশে ও বিদেশে / খুঁজে পেতে আনি খেতে-নয় বড় সিধে সে!…

 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

কদম গাছে গুড়িতে অ্যালকালয়েড, স্টেরয়েড, ট্রেনিন উপস্থিত থাকে। কদম গাছের অন্যান জৈব-রাসায়নিক পদার্থগুলি হল ট্রাইটার্পিন, ট্রাই টারপিনয়েড, গ্লাইকোসাইড, ফ্লাভোনয়েড, স্যাপোনিন, ক্যাডোমডাইন, ফ্ল্যাভনয়েডস, কেডামিন, আইসো ক্যাডামাইন ইত্যাদি ইত্যাদি।
 

চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহার

 

ব্যথা উপশমে

সুশ্রুত সংহিতা অনুসারে, মচকে বা পড়ে যাওয়ার ফলে কোন স্থানে ব্যথা হলে কদম পাতার শেক দিলে বা উষ্ণ গরম কদম পাতা সেই জায়গায় বেঁধে রেখে দিলে ফোলা ও ব্যথা অনেকটাই উপশম হয়।
 

ব্যাকটিরিয়া ধ্বংস করতে

কদম গাছের ছালের নির্যাসে উপস্থিত নানান জৈব রাসায়নিক যৌগ থেকে বর্তমানে নানা রকম এন্টিবায়োটিক তৈরি হচ্ছে। এটি ব্যাকটিরিয়া ধ্বংসকারী হিসেবে কার্যকরী ভূমিকা নেয়।
 

স্ত্রীরোগ নিয়ন্ত্রণে

কদম গাছের ছালের শুকনো গুড়ো স্ত্রী রোগ নিয়ন্ত্রণে কার্যকারী ভূমিকা নেয়। কিন্তু কদম গাছে মূল গর্ভপাত ঘটাতে সাহায্য করে।
 

কৃমি রোগ সারাতে

বাচ্চাদের কৃমি দূর করতে কদম পাতার রস খুবই কার্যকারী।
 

ত্বকের সমস্যায়

প্রাচীনশাস্ত্র মতে ব্রণ দূর করতে কদম পাতার রস ব্যবহার করা হতো।
 

পাইরিয়া বা মুখের ক্ষত দূরীকরণে

যারা পাইরিয়া অর্থাৎ মুখের দুর্গন্ধের সমস্যায় ভোগে তারা কদম ফুলের কুচি সিদ্ধ করে সেই জল দিয়ে দুবেলা কুলকুচি করলে এই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারবেন। এটি অনেকটা মাউথ ফ্রেশনারের কাজ করে। আবার যারা মুখের ক্ষত অর্থাৎ ঘা এর সমস্যায় ভুগছেন তারা কদম পাতার ক্কাথ তৈরি করে বেশ কয়েকদিন রাত্রে শোয়ার আগে লাগিয়ে ঘুমোলে এই সমস্যা থেকে মুক্ত হতে পারবেন।
 

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে

বর্তমান বিজ্ঞানের দৌলাতে কদম গাছের বল্কল থেকে ডায়াবেটিস ওষুধ তৈরি হচ্ছে।
 

জ্বর ও কাশির সমস্যায়

কদম গাছের ছাল জ্বর না শোক হিসাবে কাজ করে।
 

শারীরিক জ্বালা ভাব দূরীকরণে

চরক বিধানে বলা আছে যে কদম পাতার রস হাতে পায়ের তালুর জ্বালা দূর করতে সাহায্য করে। কদম পাতার রস মাখলে এই জ্বালা অনেকটাই কম হয়।
 

পুরুষদের শুক্রশোধনে

প্রাচীন শাস্ত্রমতে পুরুষদের শুক্র শোধনে কদম গাছের নির্যাস খুবই কার্যকারী। কদমগাছের ফুলের রেনু পুরুষ শরীরে মত্ততা আনে এবং শরীরকে বলবান করে তোলে।

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

Skip to content