শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


ছবি: প্রতীকী।

‘আমলকি চাই? আমলকি, টক মিষ্টি ফল আমলকি। কোষ্ঠকাঠিন্য ও হজমে গন্ডগোল-সহ নানান রোগের অব্যর্থ ওষুধ দুইকুচি আমলকি”—লোকাল ট্রেনে অথবা বাসে ফেরিওয়ালাদের সুরে যাত্রীরা এই কথাটি প্রায়ই শুনেছেন এবং আমলকির ব্যবহারে তারা উপকারও পেয়েছেন। ছোট বড় সকলেরই পরিচিত এই আমলকি ফল ও গাছই হল এই সপ্তাহের লেখার বিষয়।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসা শাস্ত্রে, আমলকি গাছের প্রায় সব অংশই মানব জাতির কল্যাণের কাজে ব্যবহৃত হয়। যেমন ফল, ফুল, বীজ, পাতা, মূল, বল্কল ইত্যাদি অংশগুলি কোষ্ঠকাঠিন্য দূরীকরণে, জ্বরে, রক্ত পরিশোধনকারী হিসাবে, কাশি-হাঁপানি নিয়ন্ত্রণে, চোখ ও চুলের সমস্যায় উপকার দিয়ে আসছে সেই ঋকবেদের সময় থেকে। তেমনই আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রে এটি ক্যানসারও নিরাময় করে। হয়তো এই কারণেই আমলকি গাছকে ‘ধাত্রীমা’ বা ‘ধাত্রীকা’ উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছে। হিন্দুদের কাছে খুবই প্রবিত্র গাছ হিসাবে পরিচিত এই গাছটিকে ঘিরে নানান পৌরাণিক কাহিনিও প্রচলিত আছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। বৃহৎ পুরাণ অনুযায়ী দেবী পার্বতী এবং লক্ষ্মীর কাছে আমলকি খুবই পবিত্র বৃক্ষ।

একদা লক্ষ্মী এবং পার্বতীর মধ্যে সামান্য বিবাদ ঘটে থাকে। শিবপত্নী পার্বতী ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে, তিনি নতুন এক ধরনের পূজার অর্ঘ্য শ্রীবিষ্ণুর পদতলে নিবেদন করবেন এবং তা শুনে লক্ষ্মীও মনে মনে ঠিক করলেন যে তিনিও নতুন কোন পূজার উপাদান দিয়ে দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করবেন। দুই দেবী সেই বিষয়কে ঘিরে কাঁদতে শুরু করলেন এবং তাদের চোখের জল থেকে সৃষ্টি হল এই আমলকি গাছ এবং সেই গাছের পাতা দিয়ে দুই দেবী শিব ও বিষ্ণুকে তুষ্ট করলেন।

একদিকে যেমন শিবরাত্রির দিন আমলকি গাছকে পুজো করা হয় অন্যদিকে আবার বিষ্ণু ভক্তরা আমলকি একাদশী পালন করেন ফাল্গুন মাসের একাদশীর দিনে। ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ট ভাবে মিলেমিশে আছে নানান দেবদেবীর উপস্থিতি। লোকো কথা অনুযায়ী, আমলকী গাছে ভগবান বিষ্ণু এবং তার প্রিয় পত্নী লক্ষ্মী অধিষ্ঠান করে তাই হিন্দুরা আমলকী একাদশীতে এই গাছকে পুজো করেন।

ব্রহ্মাণ্ড পুরাণে আমলকি একাদশীর বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। মহামুনির বশিষ্ঠের বর্ণনা অনুযায়ী, বৈদিশার রাজা চিত্রসেন ছিলেন বিষ্ণু পুজোর একনিষ্ঠ পূজারী। বিষ্ণু মন্দিরের দক্ষিণ দিকে থাকা এক আমলকি বৃক্ষকে কেন্দ্র করে চিত্রসেন সারাদিন উপবাস করেন এবং রাত জেগে বিষ্ণুর উপাসনা করে আমলকি একাদশী পালন করেছিলেন। এর বহুকাল পরে একদিন গভীর অরণ্যে রাজা যখন নরখাদক দস্যুদের হাতে পড়লেন তখন তিনি আমলকি একাদশী পালনের পূণ্য ফলের দৌলতে নিজের প্রাণ ফিরে পেলেন।
তিনি এক দৈববাণীর মাধ্যমে জানলেন যে, যে সকল ভক্ত আমলকি একাদশী পালনের মাধ্যমে শ্রীহরির সেবা করেছেন তাদের ভগবান বিষ্ণু জন্ম জন্মান্তর রক্ষা করার বর প্রদান করেছেন। তাই হয়তো ফাল্গুন মাসের একাদশী তিথিতে ভক্তরা উপোস করে সকালে আমলকি বৃক্ষকে স্নান করিয়ে তাঁর গোড়ায় জল দান করেন এবং এরপর নানান প্রথা অনুযায়ী ওই গাছকে পুজো করেন। সারাদিন উপবাসের পর ব্রাহ্মণ ভোজন করান এবং দরিদ্র নারায়ণ সেবা করেন। ফলস্বরূপ ভক্তরা সুস্বাস্থ্য ও ধনসম্পদের কামনা করেন।

আমলকির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যে নামটা না বললেই নয় তা হলো চ্যবনপ্রাশ। চ্যবনপ্রাশের মূল উপাদান হল আমলকি। চ্যবনপ্রাশকে কেন্দ্র পরে যে লৌকিক কাহিনি আছে, প্রসঙ্গত তা না উল্লেখ করলেই নয়।

মহা মুনি ভৃগুর পত্নী ছিলেন পুলোমা। একদা ঋষির কুটিরে এক নরাধাম এসে অন্তঃসত্ত্বা পুলোমাকে হেনস্তা করতে উদ্যত হলেন। ভীত পুলোমা তখন সেই অবস্থাতেই অপরিণত সন্তান প্রসব করলেন এবং তাঁর নাম দেওয়া হল চ্যবন। অপরিণত অবস্থায় তাঁর জন্ম হওয়ায় তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল ছিলেন। পরবর্তীকালে এক সুন্দরী রাজকন্যা সঙ্গে তার বিবাহ হয় কিন্তু তিনি শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তখন অশ্বিনী তাকে এক মহাঔষধ তৈরি করে পান করান। ফলস্বরূপ তিনি তাঁর শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে যৌবন ফিরে পান এবং নিজ পত্নীকে নিয়ে সুখী দাম্পত্য গড়তে পারেন। সেই সময়কাল থেকেই ওই ওষুধের নামকরণ করা হয় চব্যনপ্রাশ। আয়ুর্বেদের যুগ থেকে বর্তমান বিজ্ঞানের যুগেও বলবৃদ্ধি কারক হিসাবে এবং বার্ধক্য রোধের জন্য আমলকী ফলের ব্যবহার হয়ে আসছে।
আরও পড়ুন:

হাত বাড়ালেই বনৌষধি: বাড়িতে চন্দন আছে? কমতে পারে অনেক অসুখ-বিসুখ

জিৎ-রুক্মিণীর ‘বুমেরাং’ সায়েন্স ফিকশন কমেডি, লক্ষ্য আট থেকে আশি: সৌভিক

 

এক নজরে

● বিজ্ঞানসম্মত নাম: এমবেলিকা মায়েরোবালান (Embelica myrobalan)
● বাংলা নাম: আমলকি
● হিন্দি নাম: আমলা
● গোত্র: ইউফরবিয়েসি (Euphorbiaceae)

● গাছের বিস্তৃতি: সারা ভারতের মধ্যে আমলকি গাছের আধিক্য পরিলক্ষিত হয় উত্তরপ্রদেশ এবং হিমাচল প্রদেশে। মধ্যপ্রদেশে খানিকটা অংশে আমলকি বন রয়েছে। প্রায় দু’ হাজার মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট পার্বত্য ঢালু জমিতে আমলকি গাছের চাষ ভালো হয়।

● গাছের প্রকৃতি: এই গাছ হল বহুবর্ষজীবী, বহু শাখান্বিত, কাষ্ঠল, চিরহরিৎ বৃক্ষ। পাতা যৌগিক পত্র। আমলকি ফল গোলাকার, কাঁচা অবস্থায় সবুজ এবং পাকলে হালকা গোলাপি রংয়ের হয়। ফল টক মিষ্টি এবং সামান্য তিটকুটে বা কষা প্রকৃতির হয়ে থাকে। বর্তমানে সারা বছর বাজারে আমলকি পাওয়া গেলেও এই গাছ ফুল-ফল ধারণ করে অক্টোবর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত এবং সতেজ ফল বাজারে আসে শীতের শেষে।
 

কী কী উপাদানে ভরপুর?

আমলকি ফলে প্রচুর পরিমাণে অ্যাসকরবিক অ্যাসিড অর্থাৎ ভিটামিন সি থাকে। প্রতি ১০০ গ্রাম আমলকিতে প্রায় ৫০০ মিলিগ্রাম অ্যাসকরবিক অ্যাসিড থেকে থাকে। মানব শরীরে ভিটামিন সি খুবই প্রয়োজন এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসাবে কাজ করে। ভিটামিন সি ছাড়াও এর মধ্যে উপস্থিত সক্রিয় প্রাকৃতিক উপাদান। সেগুলি হল: অ্যালাজিট্যানিন, ফ্ল্যাভোনয়েডস, গ্যালিক অ্যাসিড, ক্যাম্ফেরল, পিউনিক্যাফোলিন, ফাইলানেমব্লিন, পিউনিগ্লুকোনিন ইত্যাদি ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-৪: আমারে তুমি অশেষ করেছ

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৮: মনে পড়ে পঞ্চমের কণ্ঠে শোলে ছবির সেই বিখ্যাত ‘মেহবুবা মেহবুবা…’ গানটি?

 

চিকিৎসাশাস্ত্রে আমলকির ব্যবহার

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে

আমলকি ফল ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে সক্ষম। আধুনিক বিজ্ঞানের উচ্চ মানের গবেষণায় প্রমাণিত যে, আমলকি রক্তে শর্করার পরিমাণ অনেকটাই কমায়, তৃষ্ণা অর্থাৎ জল পিপাসা কমায় এবং মধুমেহ রোগজনিত বারংবার প্রস্রাব নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে। আমলকি বয়সজনিত কিডনির সমস্যাতেও কার্যকারী ভূমিকা নেয়।
 

ক্যান্সার নিরাময়ে

আমলকির পাতা, বল্কল এবং ফল লিভার ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সক্ষম। আমলকিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি থাকার জন্য এটি অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। তাই আমলকি লিভার জনিত ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। দুপুরের খাবারের আধঘণ্টা পর কাঁচা আমলকি খেলে তা লিভার ফাংশন বাড়াতে কার্যকারী ভূমিকা নেয়।
 

কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন আমলকি সেবন রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা অনেকটাই কমাতে সাহায্য করে। এটি টাইগ্লিসারাইডের এবং অন্যান্য স্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিডের মাত্রাও কমায়। রক্ত পরিশ্রুতকারী হিসাবে আমলকির জুড়ি মেলা ভার।
 

হৃদরোগ সারাতে

অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সাইন্স-এর একটি জার্নালে প্রকাশিত যে হৃদরোগ প্রতিরোধে আমলকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। প্রাণীদের হৃদপিণ্ডের কার্যক্ষমতা বাড়াতে আমলকি খুবই উপকারী।
 

জীবাণু বিনাশকারী হিসাবে

আমলকি ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়া-সহ নানান অনুজীবীকে ধ্বংস করতে পারে। নানান ধরনের সংক্রমণজনিত রোগ থেকে মুক্তি পেতে শরীরের আভ্যন্তরীণ ইমিউনিটি পাওয়ার কে বাড়াবার জন্য প্রাত্যহিক খাদ্যতালিকায় আমলকি থাকাটা আবশ্যক।

আরও পড়ুন:

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-৩: সুন্দরবনে মানুষের আদি বসতি

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-১: জয়রামবাটির আদরের ছোট্ট সারু

 

আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে

অমৃত ফল আমলকির সঙ্গে প্রায় ৪০ রকমের ভেষজ পদার্থ মিশিয়ে তৈরি করা হয় চ্যবনপ্রাশ যা আয়ুর্বেদ মতে এক সঞ্জীবনী। এটি বার্ধক্য সরিয়ে দীর্ঘায়ু লাভের পথ সুগম করে। নানান ধরনের রোগ প্রতিরোধ করে এবং জরা রোধ করে। ইউনানি চিকিৎসা শাস্ত্রেও আমলকি গাছের ফল, বীজ, পাতা, মূল, ফুল এবং বল্কল ব্যবহৃত হয়।
 

পৌষ্টিকতন্ত্র জনিত সমস্যা সমাধানে

টক, মিষ্টি ও ঈষৎ কষা ভাবযুক্ত আমলকি ফল হজমে সাহায্যকারী এবং এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সক্ষম। প্যানক্রাইটিসের মতো মারাত্মক অসুখের ক্ষেত্রেও আমলকি ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।
 

বাতের অসুখ নিরাময়ে

আমলকির মধ্যে উপস্থিত ভিটামিন সি এবং এমব্লিক্যানিন্স নামক যৌগ থাকায় আমলকি ফল অস্টিওপোরোসিস এবং রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিসের মতো কষ্ট জনিত বাতের বিরুদ্ধে কাজ করে।
 

চুল চোখ ও দাঁত সুরক্ষিত রাখতে

আমলকিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি থাকার জন্য এটি অসময়ে চুল পড়া বন্ধ করে, চুলের বৃদ্ধি বাড়িয়ে তোলে, চোখের দৃষ্টি শক্তি ঠিক রাখে এবং অসময় দাঁত পড়া প্রতিরোধ করে।
 

সর্দি কাশি এবং হাঁপানি রোগ কমাতে

আমলকিতে উপস্থিত উৎকৃষ্ট মানের অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট মানব শরীরের ইমিউনিটি পাওয়ারকে অনেকগুণ বাড়িয়ে সিজিনাল সর্দি কাশি নিয়ন্ত্রণ করে এবং হাঁপানি উপশমকারী হিসাবে কাজ করে।

চিকিৎসা শাস্ত্রে আমলকির ব্যবহার থেকে বোঝা যায় যে প্রাচীন মহর্ষিরা এই কারণেই আমলকিকে ‘অমৃতফল সঞ্জীবনী’ উপাধিতে সম্মানিত করেছিল। আদি গুরু শঙ্করাচার্য বলেছিলেন যে গরিব ব্রাহ্মণ এর কাছে ঐশ্বর্য লাভের পরিবর্তে দ্বাদশীর দিনে একটি আমলকি ফল পাওয়া অমূল্য সমান।‌

* হাত বাড়ালেই বনৌষধি (Herbs-and-seeds): স্বাতীলেখা বাগ (Swatilekha Bag), উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞ।

আপনার রায়

রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটে দফা বৃদ্ধি করা জরুরি?

Skip to content