শনিবার ৫ অক্টোবর, ২০২৪


রেখাচিত্র: দেবাশিস দেব।

বছর দশেকের বাবুল। বড্ড দুষ্টু। বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি, সাইকেল চালানো কিংবা খেলাধুলো— সবেতেই দারুণ পটু। স্কুলের টিফিনের সময় ক্রিকেট খেলতে গিয়ে একদিন মাথায় পেলে চোট। বাড়ি ফিরে জ্বর এল, সঙ্গে মাথায় যন্ত্রণা। ভয়ে চোটের কথা বললো না মা-বাবাকে। সবাই ভাবল ইনফ্লুয়েঞ্জা, সর্দি, জ্বর। ডাক্তারবাবুও সেই মতো ওষুধ দিলেন। দিন দুয়েকের মধ্যে জ্বর কমলেও বেড়ে গেল মাথার যন্ত্রণা, শুরু হল বমি। জ্ঞান হারালো বাবুল। সে জ্ঞান আর ফিরে এল না। বলের চোট থেকে মস্তিষ্কের ভিতরে রক্তক্ষরণ হয়ে একটি ছোট্ট জীবনের অকালে পরিসমাপ্তি ঘটলো।

ইন্টারনাল হেমারেজ কথাটা আমরা ভীষণ শুনে থাকি। মাথায় চোট এবং হঠাৎ মৃত্যু মানেই যে ইন্টারনাল হেমারেজ, সেটা কাউকে বলে দিতে হয় না। সাব আরাকনয়েডনয়েড হেমারেজও তাই। ভাবতে আশ্চর্য লাগে যে এত সুরক্ষার পরেও ব্রেনে চোট লাগে কীভাবে! মাথার করোটিতে থাকে চুল, তারপর পেশীর স্তর, তারপর করোটির হাড়। তার ভিতরে মস্তিষ্কের আবরক পর্দা অর্থাৎ মেনিনজেসের তিনটে স্তর। এরপর মস্তিষ্ক সুষুম্না রসে বা সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইডে (সিএসএফ) ভাসমান মস্তিষ্ক বা ব্রেন।
মাথায় চোট মানেই কিন্তু ইন্টারনাল হেমারেজ নয়। চোট লাগতে পারে নানা কারণেই। রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনায়, চলন্ত ট্রেনে, পোষ্টের ধাক্কায়, খেলতে গিয়ে, ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে গিয়ে, বাথরুমে পড়ে গিয়ে, অস্ত্র থেকে ইত্যাদি। যে কারণেই চোট লাগুক না কেন, প্রথম এবং প্রধান উপসর্গ কিন্তু ব্যথা, যা সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতে পারে, কিছুক্ষণ বাদেও হতে পারে। অল্পক্ষণ থাকতে পারে, আবার দীর্ঘস্থায়ীও হতে পারে। ব্যথা হতে পারে শুধু চোট লাগার জায়গায় কিংবা সাড়া মাথা জুড়ে। ব্যথার সঙ্গে বমি থাকতে পারে, নাও থাকতে পারে।

চোট যদি শুধুমাত্র বাইরে হয়, মাথার চামড়া যাকে আমরা বলি স্ক্যাল্প, সেটা কেটে যেতে পারে, থেতলে যেতে পারে, ফুলে যেতে পারে। এটাকেই আমরা চলতি কথায় বলি মাথা ফেটেছে। অনেক সময় করোটির হাড়ে চিড় ধরতে পারে, হাড় ভেঙে গিয়ে মস্তিষ্কে বা ব্রেনে গেঁথে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে প্রথমেই যেটা করবেন সেটা হল, ক্ষতস্থানে বরফ চেপে ধরা, রক্তপাত শুরু হলে রুমাল-গামছা, যা হাতের কাছে পাবেন, সেটা দিয়েই জায়গাটা চেপে ধরে রাখা। এই চেপে ধরা অবস্থাতেই ডাক্তারের কাছে যাবেন। অনেক সময় ক্ষতস্থানে কয়েকটি সেলাই করার প্রয়োজন হতে পারে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৩: বায়োপসি মানেই ক্যানসার?

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-২: আইজেনস্টাইন, যুদ্ধজাহাজ ও মন্তাজ

করোটির হাড়ে ক্রাক ফ্র্যাকচার বা সরু চিড় ধরলে সাধারণত কোনও চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না (যদি না জায়গাটায় নতুন করে আবার চোট লাগে), নিজে থেকেই সেটা জুড়ে যায়। তবে হাড় ভেঙে ব্রেনে গেঁথে গেলে বড় অপারেশনের প্রয়োজন হয়। আঘাত যদি গুরুতর হয়, তবে ব্রেনের মধ্যে বা ব্রেনের মেনিনজেস অর্থাৎ আবরক পর্দার বিভিন্ন স্তরের মধ্যে রক্তক্ষরণ শুরু হয়, রক্তনালি ফেটে এবং রক্ত জমাট বেঁধে ব্রেনের মধ্যেকার প্রেসার বেড়ে যায়। আগেই বলেছি, ব্রেন থাকে করোটির ভিতর ভীষণ সুরক্ষিত অবস্থায় এবং সেরিব্রো স্পাইনাল ফ্লুইড বা মস্তিষ্ক সুষুম্না রসে ভাসমান। রক্তপাতের ফলে চাপ বেড়ে গিয়ে এই রসের চলাচল বাধা প্রাপ্ত হয় প্রায় ৭০ শতাংশ। এর ফলে একটানা মাথায় যন্ত্রণা হয়, সকালের দিকে যা হয় অসহনীয়, সোজা হয়ে দাঁড়ালে কিছুটা কমে যায়। প্রায় কুড়ি শতাংশ রোগীর ব্রেনের ভিতরের চাপ আঘাতের পর কমে যেতে পারে। এটা হয় সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড কমে যাওয়ার ফলে। এক্ষেত্রে সারা মাথা জুড়ে যন্ত্রণা শুরু হয়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৯: যোগ্য বা অযোগ্য—যে মানুষই রাজার আশেপাশে থাকেন, রাজা তারই কথায় ওঠেন-বসেন

এই ধরনের মাথার যন্ত্রণাকে বলে পোস্ট ট্রমাটিক হেডেকও বলে। এই যন্ত্রণা বহুদিন স্থায়ী হয়, কখনও বাড়ে-কখনও কমে, কানে নানারকম শব্দ হতে পারে, মনে হতে পারে মাথায় কেউ যেন লোহার টুপি পরিয়ে রেখেছে বা মাথা চেপে ধরে রেখেছে। মস্তিষ্কের রক্তনালীর দেওয়ালে ব্যথা গ্রহণকারী অসংখ্য গ্রাহক কোষ আছে। চোট লাগলে এরা উত্তেজিত হয়। ফলে ব্যথা বোধ হয়। রক্তনালী স্থিতিস্থাপকতার পরিবর্তনের জন্য ব্যথা হতে পারে। আবার অল্প চোটে মাথার পেশির কোষকলা গুলো ফুলে উঠে ওই জায়গার রক্তনালীগুলোর যন্ত্রণা গ্রাহক ঘোষকে উত্তেজিত করে, ফলে ব্যথা হয়। যন্ত্রণার সঙ্গে বমি হয় ব্রেনের চাপ বেড়ে যাওয়ার ফলে, যা খুবই বিপদজনক লক্ষণ। তবে দুই একবার বমি করলে চিন্তার কিছু নেই। শিশুরা ভয়ে এবং যন্ত্রণায় বমি করতেই পারে। বারে বারে বমি হলেই সেটা চিন্তার ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

অনেকেই চোট লাগার ফলে অজ্ঞান হয়ে যান। জ্ঞান ফিরে এলে কিছুই মনে করতে পারেন না। একে বলে ট্রমাটিক অ্যামেনশিয়া। স্মৃতিলোপ তিন রকম হতে পারে। চোট লাগার আগের কথা রোগী ভুলে যেতে পারেন, কীভাবে কখন চোট লাগলো সেটা ভুলে যেতে পারেন, চোট লাগার পর যা যা ঘটেছে–সেগুলোও ভুলে যেতে পারেন। এই তিন ধরনের ভুলে যাওয়া একই সঙ্গে ঘটতে পারে, নাও পারে। চিকিৎসার মাধ্যমে এই স্মৃতিলোপ ধীরে ধীরে কমে আসে, রোগী আবার সব মনে করতে পারেন। তবে ‘হারানো সুর’-সহ বিভিন্ন সিনেমায় যেমন দেখানো হয়, এক গুঁতোতে স্মৃতি চলে গেল আরেক গুঁতোতে ফিরে এল, বাস্তবে তা কিন্তু কখনই হয় না।
আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-২: “যে ‘কেবল’ পালিয়ে বেড়ায়”

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৮: চলতে চলতে ‘সাহেব বিবি ও গোলাম’

হেড ইনজুরি বা মাথার চোট থেকে অনেকের দৃষ্টিশক্তি কমে যায়; ঘ্রাণ শক্তি, শ্রবণ শক্তি বাকশক্তি চলে যায়, পক্ষাঘাত হতে পারে। ব্রেনের ঠিক কোথায় কতটা আঘাত লেগেছে, তার উপর এইসব উপসর্গ দেখা দেবে কিনা, তা নির্ভর করে। আঘাত লাগার পরেই অনেকের নাক মুখ কান দিয়ে রক্তপাত ঘটতে পারে। কাজেই মাথার আঘাতকে কখনওই হালকাভাবে নেওয়া উচিত নয়।

অবশ্যই হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে ডাক্তারকে দেখাবেন। তাঁর পরামর্শ মতো এক্সরে, সিটি স্ক্যান, রক্ত পরীক্ষা ইত্যাদি করাবেন। আর একটা কথা, ইন্টারনাল হেমারেজ মানেই কিন্তু মৃত্যু নয়। সঠিক চিকিৎসায় রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content