শুক্রবার ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

বায়োপসি। চার অক্ষরের এই শব্দটি নিয়ে চোদ্দ গন্ডা বিপত্তি। ডাক্তারবাবু কোনও রোগীর বায়োপসি করতে চাইলে, আমাদের হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে। আমরা ধরেই নেই, রোগীর নিশ্চয়ই ক্যানসার হয়েছে! আমাদের কাছে বায়োপসি আর ক্যানসার শব্দ দুটি প্রায় সমার্থক। আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলি, ডাক্তারবাবু কোনও খারাপ সন্দেহ করছেন নাকি? মানে ক্যানসার ট্যানসার! কিংবা বলি, কি দরকার ডাক্তারবাবু খোঁচাখুঁচি করে! বেশ তো আছি। যে কদিন বাঁচি এভাবেই চলুক। খুঁচিয়ে দিলেই তো ক্যানসার! অনেকে আবার আবদার করেন, বায়োপসি না করে অন্য কোনওভাবে রোগটা ধরা যায় না! আসলে বিষয়টি সম্বন্ধে আমাদের কোনও স্বচ্ছ ধারণা নেই বলেই এসব উল্টোপাল্টা প্রশ্ন মনে আসে।

বায়োপসি কথাটি একটি ল্যাটিন শব্দ। ভাঙলে পাওয়া যায় ‘বায়োস’, যার অর্থ হল জীবিত কলা, আর ‘অপসি’ মানে অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগ নির্ণয় করার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে। যেমন এক্সরে, রক্ত মল মূত্র পরীক্ষা, স্ক্যান, এন্ডোস্কোপি, এমআরআই ইত্যাদি। এসব নানান পরীক্ষা ডাক্তার বাবুদের রোগ নির্ণয় সাহায্য করে। বায়োপসিও এরকমই এক বিশেষ ধরনের পরীক্ষা পদ্ধতি। কোনও জীবদেহের অংশ বিশেষ নিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করার নামই হল বায়োপসি। অবশ্য যত সহজে ব্যাপারটা বলা গেল, তত সহজে কিন্তু করা যায় না।
আমরা জানি যে আমাদের দেহ অসংখ্য কোষ দিয়ে তৈরি। দেহের একেক জায়গায় এই কোষের চরিত্র একেক রকম। অণুবীক্ষণ যন্ত্রে দেখা হয় যে কোষে কোনও অস্বাভাবিকতা রয়েছে কিনা! থাকলে সেই অস্বাভাবিকতা কোন ধরনের এবং কতটা? এর সাহায্যে প্যাথলজিস্ট সিদ্ধান্ত নিতে কী? নানা ধরনের পদ্ধতি রয়েছে বায়োপসির। সেগুলো এই লেখার আলোচ্য বিষয় নয়। বরং বলি যে বায়োপসি নিয়ে আমাদের কী কী ভুল ধারণা আছে!

বায়োপসি মানেই কি ক্যানসার? অর্থাৎ শুধু ক্যানসার নির্ণয়েই কি বায়োপসি করা হয়? আগেই বলেছি যে জটিল রোগ নির্ণয়ের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে বায়োপসি একটি। কাজেই শুধুমাত্র ক্যানসার নির্ধারণের জন্য বায়োপসি করা হবে কেন! ধরা যাক কারও দেহে কোনও টিউমার অর্থাৎ ফোলা অংশ বা আলসার মানে ঘা দেখা দিল। প্রাথমিক কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষায় কোনও সিদ্ধান্তে আসা গেল না। সে সব ক্ষেত্রে ওই সন্দেহজনক জায়গা থেকে কিছুটা অংশ নিয়ে বায়োপসি করে আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারি যে তাতে কোনও অস্বাভাবিকতা আছে কিনা, থাকলে তার ধরন এবং বিস্তৃতিই বা কতটা অর্থাৎ এই বায়োপসির সাহায্যে সঠিকভাবে আমরা কোনও রোগের গতি-প্রকৃতি বুঝতে পারি। এই যে টিউমার বা আলসারের কথা বললাম,সেটা কোনও প্রদাহ বা ইনফ্লামেশনের জন্য হতে পারে। যেমন টনসিলাইটিস, ফ্যারিনজাইটিস—গলায় ঘা হয়েছে সঙ্গে গ্ল্যান্ড ফুলেছে, এমনটা তো আমরা হামেশাই দেখি।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২২: স্টেরয়েড বড় ভয়ঙ্কর ওষুধ?

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১: আমি ‘কেবলই’ স্বপন…

আবার টিউবারকুলোসিসের জন্যও এমনটা হতে পারে। এই বায়োপসির সাহায্যে আমরা সন্দেহজনক স্থান থেকে টিবির কারণ জায়েন্ট সেল পেতে পারি। চিকিৎসাও সেই মতো হবে। আবার প্রদাহর কারণও পেতে পারি। একটা প্রদাহ জনিত গ্ল্যান্ড,টিবি গ্ল্যান্ড বা ক্যানসার গ্ল্যান্ড– প্রত্যেকের চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন। কাজেই বায়োপসি করলেই ক্যানসার কোষ পাওয়া যাবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছেন! লিভার বায়োপসি করে হয়তো কারও সিরোসিস পাওয়া গেল। দীর্ঘদিন হাড়ের ঘা শুকোচ্ছে না—অস্টিওমায়িলাইটিস পাওয়া গেল। ক্যানসার পাওয়া যেতে পারে, আবার ক্যানসার ছাড়া অন্য রোগও পাওয়া যেতে পারে। আসল কথা হল, জটিল কোনও রোগ নির্ণয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বায়োপসিই আজ শেষ কথা বলে।

বায়োপসি করে আমরা যে শুধু কোষের অস্বাভাবিকতা বুঝতে পারি তাই নয়, অস্বাভাবিক হওয়ার আগের অবস্থাও ধরতে পারি। ক্যানসারের ক্ষেত্রে ম্যালিগন্যান্ট কোষ— কতটা তার বিভাজন হয়েছে, সেই বিভাজন কি ধরনের— এসব দেখে কি ধরনের চিকিৎসা এবং সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, সেটা আগেভাগেই বোঝা যায়। ডাক্তারি পরিভাষায় প্রি ম্যালিগন্যান্ট কন্ডিশন বলে একটা ব্যাপার আছে অর্থাৎ ক্যানসার হওয়ার আগের অবস্থা। রোগটা এমন একটা পর্যায়ে এসেছে, যার থেকে যে কোনও সময় সেটা ক্যানসারে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন ধরা যাক ঠোঁটের কোণে ঘা, যা ধীরে ধীরে ভিতর দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, যাকে আমরা লিউকোপ্লাকিয়া বলি– এর থেকে ক্যানসার হতেই পারে, আবার নাও হতে পারে। বায়োপসি করে যদি কোনও ক্ষত সন্দেহজনক মনে হয়, তবে আমরা সহজেই সেটা অপারেশন করে আগেভাগেই বাদ দিতে পারি অর্থাৎ বায়োপসির সাহায্যে কোনও অসুখ বিপদজনক হওয়ার আগেই সে সম্বন্ধে সাবধান হওয়ার সুযোগ থাকে।
আরও পড়ুন:

পঞ্চতন্ত্র: রাজনীতি-কূটনীতি, পর্ব-৮: জীবনে উন্নতি করতে হলে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গেই আপনাকে থাকতে হবে

অজানার সন্ধানে: পাচার হয়েছিল টন টন সোনা ও দামি ধাতু! ৮৫ বছরের সেই ভূতুড়ে রেলস্টেশন এখন অভিজাত হোটেল

অনেকেরই ধারণা, বায়োপসি করলেই নাকি ক্যানসার বেড়ে যায়, যেজন্য তারা ডাক্তারবাবু অ্যাডভাইস করা সত্ত্বেও বায়োপসি এড়িয়ে চলেন। ফলে রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। অনেক শিক্ষিত লোককেও এমন অভিযোগ করতে শুনেছি, গ্ল্যান্ড ফোলা নিয়ে ভালোই ছিলাম, যেই খোঁচাখুঁচি মানে বায়োপসি হল, অমনি রোগটা বাড়তে শুরু করল। অর্থাৎ রোগ বেড়ে যাবার জন্য তারা বায়োপসিকেই দায়ী করেন। ব্যাপারটা কিন্তু ঠিক তা নয়। এমনিতেই ক্যানসার রোগটি সুযোগ পেলেই এক স্থান থেকে আরেক স্থানে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যাকে আমরা ডাক্তারি পরিভাষায় বলি মেটাসটেসিস। সরাসরিভাবে কিংবা রক্ত, লসিকা নালী বাহিত হয়ে ক্যানসার সহজেই দেহের বিভিন্ন গ্ল্যান্ডে, ব্রেনে, লিভারে, ফুসফুসে ও অন্যান্য স্থানে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

বায়োপসি না করে বসে থাকার অর্থ হল, এই ছড়িয়ে পড়াকে ত্বরান্বিত করা। আর বায়োপসি করলে প্রথমেই নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে যে রোগটা কি ক্যানসার না অন্য কিছু– তারপর সেই মতো দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যাবে। ক্যানসারের আজকাল আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। সময় মত রোগ ধরা পড়লে রেডিওথেরাপি বা বিকিরণ চিকিৎসা, সার্জারি বা শল্য চিকিৎসা, কেমোথেরাপি বা ওষুধের সাহায্যে চিকিৎসা করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহজেই ক্যানসার সারিয়ে তোলা সম্ভব। যদি বায়োপসি করে ক্যানসার ধরা পড়ে, তবে তার ধরনটা কি, বিস্তৃতি কতটা অর্থাৎ রোগটা কোন স্টেজে—এসবও জানতে পারি। চিকিৎসা পদ্ধতি নির্বাচনের ক্ষেত্রে যেগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৫: গায়ের জামা হাওয়ায় উড়বে বলে দেহের সঙ্গে ফিতে দিয়ে বেঁধে রাখতেন

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-১৭: দু’ মাস আগের এক সন্ধ্যা

সোজা কথায় বলতে গেলে, এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যাপারে সঠিক বৈজ্ঞানিক গাইডলাইন দিতে পারে একমাত্র বায়োপসিই। আর আগেই তো বলেছি বায়োপসি না করলে রোগই ধরা পড়বে না, কাজেই চিকিৎসাও শুরু করা যাবে না। এবার তাহলে আপনিই বেছে নিন যে রোগ পুষে রেখে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাবেন, না তাড়াতাড়ি বায়োপসি করে রোগটা নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করবেন। আর আগেই তো বলেছি ক্যানসার মানেই মৃত্যু—এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে ক্যানসার সম্পূর্ণ সেরে যায়। কিন্তু বায়োপসি ছাড়া কে আপনাকে দিব্যি দিয়ে বলবে যে রোগটা ক্যানসার অথবা ক্যানসার নয়।

বায়োপসি সম্বন্ধে সাফাই গাওয়া আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হল বায়োপসি সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে যে অহেতুক ভীতি আছে, তা দূর করা। বিজ্ঞানের চরম অগ্রগতির যুগে, তার সাহায্য নিয়ে সবাই সুস্থভাবে বেঁচে থাক, এই আশা তো আমরা করতেই পারি।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content