শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: রঞ্জন দত্ত।

দাঁতে পোকার প্রসঙ্গে উঠলেই আমার ছোটবেলার কথা খুব মনে পড়ে। আর মনে পড়ে পাড়ার গোপালের মায়ের কথা। ছোট্ট বেলায় বেশ কয়েকবার দাঁতের যন্ত্রণায় ভুগেছি। আমার ঠাকুরমা যাকে আমরা কর্তামা বলে ডাকতাম, আমাকে নিয়ে বেশ কয়েকবার পাড়ার গোপালের মায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে দাঁতের পোকা বার করেও এনেছে। স্পষ্ট মনে আছে, গোপালের মা প্রথমে আমার হাতের চেটোতে কিছুটা মাজন দিয়ে আঙুল দিয়ে দাঁতের ব্যথার জায়গায় ঘষে ঘষে লাগাতে বলতো। মিনিট কয়েক পরে থুতু করে যখন ফেলতাম, তখন দেখতাম, খুব খুদে খুদে কালো পোকা সেই থুতুর মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রায় ৫৫ বছর আগের সেই ঘটনা আজও আমার স্মরণে আছে। বড় হয়ে অবশ্য জেনেছিলাম যে, দাঁতে পোকা বলে কিছু হয় না।
আসলে দাঁতে যে কালো ছোপ বা দাগ পড়ে, যাকে বলা হয় ডেন্টাল কেরিস, আমরা তাকেই পোকা বলে ভাবি। এই দন্তক্ষয় বা ডেন্টাল কেরিস নানা কারণেই হতে পারে। দাঁতের বাইরে যে আবরণ থাকে তাকে বলে এনামেল, যেটা দাঁতের ভেতরের নরম অংশ যাকে পাল্প বলা হয়, সেটাকে সযত্নে রক্ষা করে। আমরা সারাদিন নানা ধরনের যেসব খাবার খাই, তার মধ্যে কার্বহাইড্রেট প্রধান ভাত, রুটি, আলু, চিনির প্রাধান্য থাকে। ভালো করে দাঁত পরিষ্কার না করলে এসব খাবারের টুকরো দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকে।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৮: জ্বরে ভাত খাবেন?

ডাক্তারের ডায়েরি, পর্ব-৩৩: সেই সব মহান ডাক্তারবাবুরা / ১

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৩: কালাদেওর বলি

আমাদের মুখের ভেতরে থাকে নানা ধরনের আণুবীক্ষণিক জীবাণু বা মাইক্রো অর্গানিজম। যেমন ল্যাকটো ব্যাসিলাস অ্যাসিডোফেলাস, ল্যাকটো ব্যাসিলাস ওডোলটোলাইটিকাস, ফার্মেন্টাই ইত্যাদি। এরা মুখের ভেতর দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা কার্বহাইড্রেট জাতীয় খাবারের টুকরোগুলোর সঙ্গে বিক্রিয়া করে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি করে। এছাড়াও অ্যাসিটিক অ্যাসিড, পাইরুভিক অ্যাসিড-সহ আরও কিছু অ্যাসিড তৈরি হয়। অ্যাসিডগুলোই দাঁতের বারোটা বাজায়। এনামেল নষ্ট করে, দাঁতে কালো দাগ পড়ে, দাঁতে গর্ত হয়। বেশ ব্যথা হয়, টনটন করে। এর নেপথ্যে পোকার কোনও ভূমিকা নেই। দন্তক্ষয় বা ডেন্টাল কেরিসকেই আসলে আমরা পোকা বলে ভুল করি।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৩: রবীন্দ্রনাথের পোশাকআশাক

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৩৬: রামের সন্ধানে ভরতের যাত্রা সফল হল কি?

মহাভারতের আখ্যানমালা, পর্ব-৫৫: বালক অষ্টাবক্রের বুদ্ধিবলে পিতা কহোড় পেলেন নবজীবন

নিয়মিত দাঁত পরিষ্কার রাখলে কিন্তু এই বিপত্তি হয় না। রোজ দু’বার দাঁত ব্রাশ করতে হবে। দুপুরে এবং রাতে শুতে যাবার আগে। যে কোনও ভালো টুথপেস্ট কিংবা মিহি গুঁড়ো মাজন অর্থাৎ পাউডার দাঁত মাজার জন্য ব্যবহার করা উচিত। ওপরের পাটিতে উপর থেকে নিচে এবং নিচের পাটিতে নিচ থেকে ওপরে ব্রাশ করতে হবে। দাঁতের ফাঁকে খাবারের টুকরো বেশি আটকে থাকে। এজন্য ফ্লস ব্যবহার করা উচিত। দন্ত বিশেষজ্ঞর সঙ্গে এ ব্যাপারে পরামর্শ করা যেতে পারে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৪: সুন্দরবনের সুন্দর কাঁকড়া

স্বাদে-আহ্লাদে: চিকেন প্রিয়? তাহলে এমন হায়দরাবাদি চিকেনে জমিয়ে দিন দুপুর

দশভুজা: এগারো রকমের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে, একাত্তরেও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান

দাঁতে নানা কারণে ছোপ পরে। বেশি লজেন্স, চকলেট, ঠান্ডা পানীয়, মিষ্টি, পান-জর্দা এবং ভাজাভুজি খেলে দাঁতের ক্ষতি হয়। এটা সেটা দাঁতে ঘষে দাগ তোলা উচিত নয়। এ জন্য বিজ্ঞানসম্মত উপায় স্কেলিং এবং পলিশিং করা উচিত। আলট্রাসনিক স্কেলার আজকাল ব্যবহার করা হচ্ছে এই জন্য। অনেকের ধারণা স্কেলিং করলে দাঁতের মারাত্মক ক্ষতি হয়। এ ধারণা কিন্তু সম্পূর্ণ ভুল।

নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ, মাড়িতে ঘা, দাঁতের গোড়া থেকে রক্তপাত— সবই কিন্তু হয় দাঁতের অযত্নের ফলে। দাঁতের ফাঁকে জীবাণু বাসা বাঁধে। নানা নেশাও দাঁতের ক্ষতি করে। অনেকেই গুড়াকু দিয়ে রোজ দন্ত মার্জনা করেন। জিজ্ঞেস করলে বলেন, এতে নাকি দাঁতের ব্যথা কম থাকে, দাঁতে পোকা লাগে না। এই কথাগুলোর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এগুলো বদভ্যাস ছাড়া কিছু নয়।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৮: যেখানে বাঘের ভয় সন্ধে ঠিক সেখানেই হয়, আমারও ঠিক তাই হল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৫: আঁধার ভূবনে আবার কে তুমি জ্বেলেছ ‘সাঁঝের প্রদীপ’ খানি

ছোটদের যত্নে: ছোটদের যত্নে: সন্তান কম মনোযোগী কিন্তু অতি সক্রিয়? সহজ উপায়ে বাড়িতেই এর চিকিৎসা সম্ভব

অফিস বা ব্যবসার কাজে অনেককেই দিনের পর দিন বাইরের খাবার খেতে হয়, ফাস্টফুড যার অন্যতম। আগে থেকে তৈরি করা প্যাকড খাবারও দাঁতের ক্ষতি করতে পারে। দাঁত ঠিক রাখতে কয়েকটি নিয়ম কানুন আপনাকে মেনে চলতেই হবে।

রোজ দুপুরে ও রাতে ব্রাশ এবং টুথপেস্ট দিয়ে ঘষে ঘষে দাঁত মাজবেন। টুথপেস্ট নিয়ে কোনও বাছ বিচারের দরকার নেই, যে কোনও ভালো কোম্পানির হলেই হল। ছাই, কাঠ কয়লা, নুন-লেবু দিয়ে কক্ষনো দাঁত মাজবেন না। একটানা দু’মিনিটের বেশি দাঁত মাজবেন না।

প্রতিবার খাবার পর ভালো করে মুখ ধুয়ে নেবেন। টুথপিক দিয়ে দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবার কণা বার করে দেবেন। জলখাবার, চা, এমনকি ফলের রস খাবার পরও মুখ ভালো করে কুলকুচি করে ধুয়ে ফেলবেন।

চকলেট, লজেন্স, মিষ্টি, ভাজাভুজি কম খাবেন। যাই খান, সবসময় সেটা চিবিয়ে খাবেন।

সেফটিপিন বা হাতের কাছে যা পাবেন, তাই গিয়ে দাঁত খোঁচাবেন না।

ভিটামিন এ এবং ডি, ক্যালশিয়াম এবং প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি খাবেন। যেমন সবুজ শাকসব্জি দুধ, ডিম, গাজর বাদাম, মাংস ইত্যাদি।

মাঝে মাঝে দাঁত ব্যথা হলে টোটকা করে কিংবা ব্যথা কমানোর ওষুধ খেয়ে আসল রোগটাকে চেপে রাখার চেষ্টা করবেন না।

মুখের বা পেটের কোনও রোগ থাকলে তার চিকিৎসা করাবেন। পারলে ৬ মাস অন্তর একবার ডেন্টাল চেকআপ করাবেন।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content