মঙ্গলবার ৯ জুলাই, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়েই নানা রকম গ্যাস। কোনওটা জীবজগতের পক্ষে ভালো, কোনওটা বা ভয়ঙ্কর রকমের খারাপ। আমাদের চারপাশেই শুধু যে গ্যাস ঘুরে বেড়াচ্ছে তা নয়, গ্যাস রয়েছে আমাদের শরীরেও, বিশেষ করে পেটে। এই পেটের গ্যাস নাকি যথা ইচ্ছা তথা গমন করতে পারে! কোনও সময় সে পেট বেয়ে গলায় উঠে আসছে, কখনও বা ব্রহ্ম তালুতে গিয়ে আঘাত করছে। আবার কখনও পিঠে বা বুকে গিয়ে কার্নিক মারছে। কি বিপত্তি বলুন তো! এই গ্যাস তাড়াতে লক্ষ লক্ষ টাকার অ্যান্টাসিড, এনজাইম, হজমি গুলি, মুখশুদ্ধি, আমলকি চূর্ণ, আয়ুর্বেদিক নানা ছাই ভস্ম শুধু ওষুধের দোকানে নয় ট্রেনে, স্টেশনে, গ্রামে গঞ্জের বটতলার হাটে যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। কোষ্ঠকাঠিন্য, অম্বল, গলা জ্বালা বুক জ্বালা, পেটের গ্যাসের রমরমা ঠেকাতে সঠিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার চেয়ে জড়িবুটি, টোটকা টাটকির উপর আমাদের ভরসা এবং বিশ্বাস দুটোই বেশি।
পেটে কি সত্যি গ্যাস থাকে! হ্যাঁ থাকে, সত্যিই থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় গ্যাসের নড়াচড়ার শব্দ অনুভবও করা যায়। কি থাকে পেটের গ্যাসে? বাইরের বাতাস থেকে আসে নাইট্রোজেন আর অক্সিজেন অর্থাৎ বাতাস গিলে আমরা এই দুটোকে পাই। আর হাইড্রোজেন, মিথেন এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড পাই খাবার হজমের পর। পেটের মোট গ্যাসের ৯৯ শতাংশই হল এই পাঁচ ধরনের গ্যাসের মিশ্রণ। ডাল-শাকসবজির হজম না হওয়া অংশ কিংবা অন্ত্রনালীতে জীবাণু সংক্রমণের ফলেও গ্যাস তৈরি হতে পারে।

আমরা ভাত খাবার সময়, জল খাবার সময়, হাই তোলার সময় এবং ঢেকুর তোলার সময় অনেকটা করে বাতাস গিলে ফেলি। এই বাতাস পেটে ঢুকে সোজা জমা হয় পাকস্থলীতে এবং সেখানে আগে থেকেই জমে থাকা অল্প পরিমাণ গ্যাসের সঙ্গে মিলেমিশে অস্বস্তির কারণ হতে পারে। পেট ফুলতে পারে, আইঢাই করতে পারে। এই বাড়তি গ্যাস আরও নিচে নেমে ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদন্ত্রে প্রবেশ করে এবং মলদ্বার দিয়ে দিনে পনেরো-ষোলো বার নিঃশব্দে কিংবা সশব্দে বার হয়ে যায়, যাকে আমরা বাতকর্ম বলি। স্বাভাবিকভাবে গ্যাস বার হয়ে গেলে শরীর বা পেটে কোনও সমস্যা দেখা দেয় না। কিন্তু খাবার ঠিকমতো হজম না হয়ে যদি অতিরিক্ত গ্যাস তৈরি হয়, তখনই দেখা যায় সমস্যা।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৯: দাঁতে পোকা! সত্যি, নাকি নিছক ধোঁকা?

মহাকাব্যের কথকতা, পর্ব-১: আর্ষ মহাকাব্যের স্রষ্টাদ্বয়ের কথা

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৪: ঠাকুরবাড়িতে দোলে আসত নাচিয়ে, নাচের তালে তালে হত আবিরের আলপনা

হেলদি ডায়েট: সর্দি-কাশিতে ভুগছেন? জেনে নিন কোন ঘরোয়া টোটকায় মিলবে আরাম

অনেকে বারবার জোর করে ঢেকুর তুলে গ্যাস বার করার চেষ্টা করেন। এ ভাবে গ্যাস তো বার হয়ই না, উল্টে প্রতিবার ঢেকুর তোলার সময় কিছুটা করে বাতাস পেটে ঢুকে যায়। আরেকটা কথা, পাকস্থলীতে অ্যাসিড তৈরি হয়, গ্যাস নয়। গ্যাস তৈরি হয় ক্ষুদ্রান্ত্রের শেষাংশ এবং বৃহদন্ত্রে। এই গ্যাস ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ঢেকুর হয়ে মুখ দিয়ে বার হতে পারে না, মাথায় গিয়ে ধাক্কাও দিতে পারে না। খুব বেশি হলে পেটে-বুকে চাপ দিয়ে ব্যথার উদ্রেক করতে পারে। মুখ দিয়ে যে গ্যাস বার হয়ে যায় সেটা আদৌ গ্যাস নয়, খাবারের সঙ্গে গিলে ফেলা বাতাস। কাজেই পেটের গ্যাস মাথায় উঠে ধাক্কা মারছে, এগুলো কথার কথা, সত্যি কথা নয়। কারণ পেটের সঙ্গে আমাদের মাথার সরাসরি কোনও পাইপলাইন নেই। নেট ঘেঁটে আমাদের অন্ত্রনালীর ছবি দেখলেই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হবে।

এই হল গ্যাস কাহিনি। গ্যাস নিয়ে এত গ্যাসীয় কথা এবং গল্প বাজারে প্রচলিত আছে যে মিথ্যেটা প্রায় সময়ই সত্যি বলে ভ্রম হয়। আমাদের চারপাশে বহু গ্যাস-মানব ঘুরে বেড়াচ্ছেন, গ্যাসাতঙ্কেই যাদের সারাদিন কেটে যায় এবং এদের দৌলতেই হাবিজাবি নানা গ্যাসের ওষুধ এ দেশে রম রম করে ব্যবসা করছে।
আরও পড়ুন:

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৫: সুন্দরবনের মাছ বৈচিত্র্যের ক্ষতিকারক প্রজাতি হল ক্রোকোডাইল ফিশ

দশভুজা: এগারো রকমের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স তাঁর ঝুলিতে, একাত্তরেও তিনি গেয়ে চলেছেন জীবনের জয়গান

স্বাদে-আহ্লাদে: ম্যাগি ভালোবাসেন? এই রেসিপি ট্রাই করে দেখেছেন?

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ, আর্থারাইটিসের ব্যথায় দীর্ঘ দিন কষ্ট পাচ্ছেন? স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে ভরসা রাখুন আয়ুর্বেদে

আমরা এই যে এত পেটের গন্ডগোলে ভুগি, তার প্রধান কারণ কিন্তু খাওয়ার গন্ডগোল। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য বড় কিছু রোগও এর নেপথ্যে থাকে। এই গন্ডগোলগুলোর মধ্যে আছে বেশি খাওয়া, কম খাওয়া, বেশি পরিমাণে তেল চর্বি খাওয়া, অনিয়মিত খাওয়া, রাস্তাঘাটে খাওয়া, ঝালে ঝোলে অম্বলে খাওয়া ইত্যাদি। বেড়াতে গেলে এই ব্যাপারগুলো আরো বেশি করে ঘটে বলেই পেটে তথাকথিত গ্যাসের উপদ্রব বেশি হয়। কাজেই পথে-ঘাটে খাওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ করে জলের ব্যাপারে। যেগুলো গরম খাওয়া সম্ভব, সেগুলো অল্প গরমই খাবেন। গান্ডে পিন্ডে খাবেন না। রাতে ভালো করে ঘুমোবেন। পানাভ্যাস থাকলে কম পান করবেন।

এরপরও যদি তথাকথিত গ্যাস বিভ্রাটে পড়েন, একবেলা উপোস দিয়ে শুধু জল খান, টয়লেটে যান, প্রয়োজনে অ্যান্টাসিড খান। পেট ব্যথা থাকলে ব্যথা কমানোর ওষুধ খান। অনেকে হজম ঠিকমতো না হলে এনজাইম প্রিপারেশন খান। কিন্তু অন্ত্র বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাইরে থেকে এনজাইম শরীরে ঢুকে হজমে কোনওরকম সাহায্য করতে পারে না। যারা খান, তারা মানসিক শান্তির জন্য খান। একটু হাঁটাহাঁটি এবং পবন মুক্তাসন গ্যাস মুক্তিতে সাহায্য করে। চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ুন। হাঁটু দুটোকে পেটের উপর চেপে ধরে দশ গুনে আবার টান করে দিন। এভাবে বার দশেক করবেন। হাঁটু ভাঁজের সময় লম্বা শ্বাস টেনে নেবেন। আবার পা সোজা করার সময় শ্বাস ছেড়ে দেবেন।
আরও পড়ুন:

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-৯: মন্দির হয়ে বৌদ্ধবিহার

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১: শচীন ও মীরা দেব বর্মনের ঘর আলো করে এল এক ‘দেব শিশু’

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৬: যিনি নিরূপমা তিনিই ‘অনুপমা’

সোনার বাংলার চিঠি, পর্ব-৪: পাঠক, লেখক ও শুভাকাক্ষীদের অনুপ্রেরণায় দেশের সর্বত্র পৌঁছে যাচ্ছে বইয়ের জাহাজ বাতিঘর সম্রাজ্যের দীপ্তি

অনেকে পেটের গ্যাস বার করার জন্য ভুরিভোজের পর এক বোতল সোডা ওয়াটার গলায় ঢালেন এবং তারপর বিচিত্র শব্দ করে অনেকক্ষণ ধরে ঢেকুর তোলেন। এতে নাকি তার গ্যাস মুক্তি হয়! আগেই বলেছি, পেটের গ্যাস কখনওই মুখ দিয়ে বার হতে পারে না। যেটা বার হয় সেটা হল সোডা ওয়াটারের মধ্যে থাকা গুচ্ছের কার্বন ডাই অক্সাইড। এতে কিন্তু আমাদের পাকস্থলীরও ক্ষতি হয়। সোডা ওয়াটার কখনওই দেহের পক্ষে ভালো নয়।

শেষ কথা হল, দীর্ঘদিন যদি আপনার গ্যাস অম্বলের সমস্যা থাকে, ভুরিভুরি অ্যান্টাসিড আর টোটকা টাটকি করে সময় নষ্ট করবেন না। অবশ্যই কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন। বহু ক্ষেত্রে খাদ্যনালীর ক্যানসারের মতো ভয়ংকর রোগের প্রাথমিক উপসর্গ কিন্তু এগুলোই।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content