শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

যখন কলেজে পড়তাম, তখন আমাদের এক সিনিয়র দাদাকে দেখতাম ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল পান করতে। তখনও বোতলবন্দি জলের এত রমরমা হয়নি। ডক্টর হস্টেলে তখন প্রায় সব ঘরেই মাটির কুঁজো রাখা থাকতো। সারাদিনে দাদা অন্তত দু’ কুঁজো, মানে প্রায় দশ লিটার জল শেষ করতেন একাই। জল খেয়ে পেট আই-ঢাই করত বলে, ডিনার লাঞ্চে খুব কমই খেতেন। মাস কয়েক এমন চলার পর দাদা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন, ভর্তি হলেন হাসপাতালে ডক্টরস কেবিনে। জানা গেল অতিরিক্ত জলপানই দাদার অসুস্থতার কারণ।

জলের আরেক নাম জীবন, জানি আমরা সবাই। কিন্তু অপরিমিত জলপান অনেক সময় বিপদেরও কারণ হতে পারে। ঠিক কতটা জল আমরা সারা দিনে খাব এবং কেন খাব, সেটা এবার জেনে নেওয়া যাক।

জল আমাদের দেহের নানা প্রয়োজনে লাগে। একজন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির দেহের মোট জলের শতকরা ৬০ ভাগ থাকে কোষের ভিতর। বাকি ৪০ ভাগ রক্তরস বা প্লাজমা, দেহরস বা বডি ফ্লুয়িড, লসিকা বা লিমফ এবং কলারস বা টিস্যু ফ্লুয়িডে থাকে। নানা কাজে লাগে এই জল।

দেহের তাপমাত্রার সমতা রক্ষা করে।

কোষের বাইরের সঙ্গে ভিতরের চাপের ভারসাম্য রাখে জল। নানা ব্রজ্য পদার্থ জলবাহিত হয়েই আমাদের রেচন অঙ্গে পৌঁছয়।

হজমের জন্য প্রয়োজনীয় পাচক রস এবং উৎসেচক জল মাধ্যমেই কাজ করে।

দেহের বিভিন্ন কলা বা টিস্যুর দৃঢ়তা এবং স্থিতিস্থাপকতা জলের উপরেই নির্ভর করে।

দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের এবং হাড়ের জয়েন্টের মধ্যে ঘর্ষণ এবং শুষ্কতা প্রতিরোধ করে জল, ক্ষয়ও রোধ করে।
কাজেই সুস্থ দেহে বেঁচেবর্তে থাকার জন্য জলের কোনও বিকল্প নেই। যেসব খাদ্যদ্রব্য আমরা গ্রহণ করি তাতেও কিন্তু অনেক জল থাকে। যেমন দুধে থাকে শতকরা ৮৭ ভাগ, ডিমে ৭৫ ভাগ, শাকসবজি ও ফলমূলে ৭০ থেকে ৯৫ ভাগ, চাল-গমে ১ থেকে ৫ ভাগ, ভাতে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ, মাংসে ৪০ ভাগ ইত্যাদি।

দিনে প্রায় আড়াই লিটার জল শরীরে প্রবেশ করে। এক থেকে দেড় লিটার আমরা পান করি। খাদ্য থেকে পাই ৮০০ সিসির মতো। নানা বিপাকীয় ক্রিয়ায় তৈরি হয় ২০০ থেকে ৩০০ সিসি। আবার এই প্রায় আড়াই লিটার জল শরীর থেকে নানাভাবে বেরিয়েও যায়। ইউরিনের মাধ্যমে প্রায় দেড় লিটার, ঘামের মাধ্যমে ৫০০ থেকে সঙ্গে ৬০০ সিসি, নিঃশ্বাসের সঙ্গে ৪০০ সিসি, স্টুলের সঙ্গে ১০০ সিসি অর্থাৎ প্রায় আড়াই লিটার।

শরীরে জল কমে গেলে যেমন বিপদ, তেমনি বেড়ে গেলেও বিপদ। অতিরিক্ত বমি পায়খানা, পুড়ে যাওয়া, হিট স্ট্রোক-সহ নানা কারণেই শরীরে জলাভাব দেখা দিতে পারে। খুব কম পরিমাণ জল পান করলেও এই বিপত্তি হতে পারে। একে বলে ডিহাইড্রেশন। এর ফলে জিভ শুকিয়ে যায়, চোখ বসে যায়, ইউরিনের পরিমাণ কমে যায়, কখনওবা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়ে রেনাল ফেলিওর হতে পারে। অতিরিক্ত জলের শূন্যতা থেকে হামেশাই মৃত্যু ঘটে। বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধদের।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-১২: ঘাম কমাতে পাউডার ব্যবহার করেন?

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৬: কবির ভালোবাসার পশুপাখি

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৮: ড. হীরালাল চৌধুরীর আবিষ্কার আজও পোনামাছ চাষীদের কাছে এক পরম আশীর্বাদ

ঠিক তেমনি অতিরিক্ত জলপান করলেও হতে পারে নানা বিপত্তি। বিশেষ করে যারা হার্ট বা কিডনির নানা অসুখে ভুগছেন। অতিরিক্ত জল আমাদের রক্তের আয়তন বাড়িয়ে দেয়। এই বাড়তি রক্তকে পাম্প করতে হার্টের ধমনী এবং পেশিকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। এর ফলে বাড়বে রক্তচাপ, হার্টের লেফট ভেন্ট্রিকল হাইপারট্রফি হবে, পরবর্তীকালে ফেলিওর হবে। ফুসফুসে জল জমবে, জল জমতে পারে পেটেও। অতিরিক্ত জল পান থেকে পা ফুলতে পারে, বমি হতে পারে, আচ্ছন্ন ভাব আসতে পারে, খিঁচুনি হতে পারে। কাজেই হার্ট ফেলিওর হলে, ভাল্বের অসুখ হলে, এনজিওপ্লাসটির পর, হৃদযন্ত্রে ছিদ্র থাকলে, বাইপাসের পর, পেসমেকার বসানোর পর ডাক্তারবাবুর পরামর্শ নিয়ে জল পান করা উচিত।

কিডনি দুটো হল আমাদের দেহের ছাঁকনি। অতিরিক্ত জল পান করলে কিডনির উপর চাপও বেশি পড়ে। কিডনি দুটো সুস্থ থাকলে এক কথা। তা না হলে অতিরিক্ত জল বাইরে বার হতে না পেরে শরীরে জমবে, ফলে হাত পা ফুলবে, চোখের পাতা ভারি হবে, পেটে-বুকে জল জমবে। শুরু হবে শ্বাসকষ্ট। কিডনির অসুখে যারা ভুগছেন, ডাক্তারের পরামর্শ মতো তারা জল খাবেন, না হলে জীবন সংশর হবে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-১১: কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই দু’ একটি ছবি তুলতে না তুলতেই হাত অসাড় হয়ে যাচ্ছিল

খাই খাই: অল্প উপকরণ দিয়েই বাড়িতে বানিয়ে ফেলুন আমিষ ধোকা

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৯: অমরগীতি ছবিতে রাজাবাবু চরিত্রে তরুণ মজুমদারের প্রথম পছন্দ ছিলেন ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায়

অতিরিক্ত জল পানের ফলে রক্তের সোডিয়াম লবণের পরিমাণ কমে গিয়ে নানা-বিপত্তি হতে পারে। দেখা দিতে পারে শারীরিক অবসাদ, চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্নতা, খিঁচুনি, এমনকি মৃত্যুও।

আমাদের সেই ডাক্তার দাদার মতো অনেকেরই অতিরিক্ত জলপানের বাতিক কাছে। এটা কিন্তু এক ধরনের অসুখ। এর নাম সাইকোজেনিক পলিডিপসিয়া। এর ফলে রক্তের ঘনত্ব কমে যায়, কমে যায় রক্তের নানা লবণের মাত্রা, মূত্রপথে দেখা দেয় নানা সমস্যা। কাজেই কোনও অসুস্থ ব্যক্তি, বিশেষ করে যারা হার্ট-কিডনি বা রক্তের অসুখে ভুগছেন, তারা ডাক্তারের পরামর্শ মতো জলপান করবেন।

এবার আসি একজন সুস্থ ব্যক্তি কতটা জল পান করবেন, সেই আলোচনায়। এগুলোও নানা ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে। ব্যক্তির বয়স, পেশা, আবহাওয়া, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি। একটি পাঁচ বছরের শিশু এবং পঞ্চাশ বছরের পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির জলের চাহিদা নিশ্চয়ই এক হবে না। আবার দিনের দশ ঘণ্টা যিনি এসিতে থাকেন, আর যিনি পথে-ঘাটে রোদে পুড়ে কাজ করেন, তাদেরও জলের প্রয়োজন কখনওই এক হবে না।
আরও পড়ুন:

ডায়েট ফটাফট: ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেড়েছে? কোন কোন খাবারে বশে থাকে এই সমস্যা? জেনে নিন কী খাবেন, কী নয়

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৯: সুরের আকাশে ঘটালে তুমি স্বপ্নের ‘শাপমোচন’

দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি

তাহলে একজন পূর্ণবয়স্ক সুস্থ মানুষ ঠিক কতখানি জল খাবেন প্রতিদিন? এক কথায়, ঠিক ততটাই খাবেন, যতটা খেলে তিনি দিনে অন্তত দেড় লিটার মূত্র ত্যাগ করতে পারেন। গড়ে প্রতিদিন দুই লিটারের মতো জল খেলেই আমাদের চলে অর্থাৎ বড় গ্লাসের সাত-আট গ্লাস। প্রচন্ড গরমে, প্রচন্ড পরিশ্রম যাদের করতে হয়, তারা আরও এক লিটার বেশি খাবেন। তাছাড়া শরীর তো নিজেই জানান দেয় তার চাহিদার কথা। আমাদের চেষ্টা পায়, গলা শুকিয়ে যায়, মূত্রের রং হলুদ হয়, মূত্রের পরিমাণও কমে যায়।

কাজেই অন্য খাবারের মতো জলও খেতে হবে চাহিদা অনুযায়ী, তবেই না শরীর ঠিক থাকবে। তবে জলটা পরিশুদ্ধ হওয়া চাই। ফুটিয়ে ঠান্ডা করা জল পান করা সব থেকে ভালো। তা নাহলে ফিল্টার করা জল ভালো। ফল, শাকসবজি, দুধ প্রতিদিন খাবেন। এগুলো থেকেও কিন্তু প্রচুর জল পাওয়া যায়।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content