বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চক্রবর্তী।

আমার এক চুলেল বন্ধুর বড় অহংকার ছিল তার চুল নিয়ে। শুধু সে নয়, তাদের বংশে কারও নাকি কোনও চুল পড়ার ইতিহাসই নেই। তখন বয়স অল্প। আমার ডাক্তারি বিদ্যায় যেটুকু জেনেছিলাম, তাই দিয়েই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে আমাদের প্রতিদিনই ৫০ থেকে ১০০টা চুল এমনি এমনিই পড়ে যায়। শুনে সে চমকে উঠেছিল, কিন্তু আমার কথা এক বর্ণও বিশ্বাস করেনি।

মূল আলোচনায় যাবার আগে একটু চুল কাহিনি বর্ণনা করে নেই। চুল আমাদের দেহত্বকেরই অংশ বিশেষ শুধু নয়, চুল হল দেহত্বকের মরা কোষ, জন্ম যার মাতৃগর্ভেই। ভ্রুণের বয়স যখন মাত্র তিন সপ্তাহ, তখনই তার ত্বকের উপরের স্তর এপিডার্মিসে কিছু কোষ একত্রিত হতে থাকে। এদের ধরনধারণ একই রকম। এই কোষগুলোই হল চুলের কুঁড়ি। এরা এরপর ত্বকের ভেতরের স্তর ডার্মিসে আশ্রয় নেয়। এখান থেকেই শুরু হয় চুল তৈরির কাজ। কাজেই মাতৃগর্ভে তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যেই চুল উৎপাদন শুরু হয়ে যায়, ৩৬ থেকে ৪০ সপ্তাহের মধ্যে যা পূর্ণতা পায়, শুরু হয় স্বাভাবিক চুল তৈরি।

চুলের মূল বা রুট থাকে ত্বকের নিচের কেশ কুপ বা হেয়ার ফলিকলে। একে চুলের কুঁড়িও বলা হয়। চুলের কাণ্ড বা শ্যাফট থাকে বাইরে। এই অংশটিকেই আমরা খালি চোখে দেখি। চুলের বাইরের আবরণের নাম কিউটিকল, ভেতরে থাকে কর্টেক্স, তার ভিতর মেডুলা। মাথার চুলে অবশ্য মেডুলা থাকে না। কর্টেক্সে থাকে রঞ্জক পদার্থ মেলানিন, যার পরিমাণের উপর চুল কতটা কালো হবে তা নির্ভর করে। চুলের কুঁড়ির নিচে থাকে কিছু সজীব কোষ বা হেয়ার ম্যাট্রিক্স। এই ম্যাট্রিক্সকে আবার নিয়ন্ত্রণ করে বংশগতি এবং নানা ধরনের হরমোন।
চুলে কোনও রক্তনালী না থাকার জন্য পুষ্টির জন্য চুলকে ত্বকের উপরেই নির্ভর করতে হয়। চুলের পুষ্টি মানে তাই ত্বকের পুষ্টি। চুলের যে অংশটি আমরা খালি চোখে দেখি, তা আসলে মৃত কেরাটিন কোষ, যা কিনা এক ধরনের প্রোটিন ছাড়া কিছু নয়। চুলের বিভিন্ন স্তর পরিষ্কার বোঝা যায় মাথার ত্বক বা স্ক্যালপে প্রোথিত হেয়ার ফলিকলে।

সৌন্দর্য বৃদ্ধি ছাড়াও নানা কাজ করে আমাদের চুল। দেহের সঙ্গে বাইরের তাপমাত্রার তারতম্য নিয়ন্ত্রণ করে। রোদের তাপ ও নানা ক্ষতিকর বিকিরণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। স্পর্শেন্দ্রিয়র কাজ করে। রোগ জীবাণুর আক্রমণ ঠেকায়। ধোঁয়া ধুলোর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা করে দেহের বিভিন্ন অংশের চুল। কাজেই চালচুলোহীনদের মত না-চুলোদের অবস্থা কেমন হয়, একবার নিজের টাকে হাত দিয়ে ভাবুন।

ব্যাপারটা কিন্তু সত্যি। রোজই আমাদের ৫০ থেকে ১০০টা চুল এমনি এমনিই পড়ে যায়। কারণ চুলের একটা নিজস্ব জীবনচক্র আছে। জন্মাবার পর থেকে বছর ৩-৪, তার বারবাড়ন্ত অবস্থা। একে বলে অ্যানাজেন পর্ব। এরপর সপ্তাহ তিনেক ধরে বুড়িয়ে যাওয়ার পর্ব, যাকে বলে ক্যাটাজেন পর্ব। শেষ পর্বে ৩-৪ মাস ধরে শুধুই বিশ্রাম, যার নাম টেলোজেন পর্ব। এই সময় পুরনো চুল নড়বড়ে হতে থাকে। নতুন চুল যা ধীরে ধীরে ম্যাট্রিক্সে বেড়ে উঠছিল, একদিন হঠাৎ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে পুরনোটার ঘাড় মটকে দেয়। কাজেই চুল পড়ে সবারই। মাথার একলাখ চুলের মধ্যে ৫০-১০০ টা পড়ে গেলে কিইবা আসে যায়! এ যেন বিশাল এক সমুদ্র থেকে এক ঘটি জল তুলে ফেলা।

কিন্তু যদি প্রতিদিন একশো-দুশো ছাড়িয়ে গোছা গোছা চুল পড়তে থাকে, টনক নড়ে সবারই। শ্যাম্পু, হেয়ার টনিক, ভাইটালাইজার, টোটকা-টাটকি — চুল পড়া আটকাতে কিছুই মাথায় মাখতে বাকি রাখি না আমরা! কিন্তু এত করেও কি তাকে ধরে রাখা যায়! রোজ গড়ে ৫০-১০০টা করে চুল পড়লে, বছরে প্রায় ত্রিশ হাজার চুল আমাদের মাথা থেকে ঝরে যায়। চুল যেমন পড়ে, তেমনি প্রতিনিয়ত কুঁড়ি থেকে গজায়ও। এই পড়া আর গজাবার মধ্যে সাযুজ্য না থাকলেই যত গন্ডগোল।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৪: মাথায় চোট মানেই কি ইন্টারনাল হেমারেজ?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-১: সুন্দরবনের শেকড়ের খোঁজে

নানা কারণেই আমাদের চুল পড়তে পারে কুড়ি বছর বয়সের পর থেকেই আমাদের চুল কমতে শুরু করে প্রাকৃতিক নিয়মেই। ৩০ বছরের মধ্যেই চুলের ঘনত্ব প্রতি বর্গ সেন্টিমিটারে ৬১৫ থেকে কমে ৪৮৫ হয়ে যায়। আরও বয়স বাড়লে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৩০-এ। নানা কারণ আছে চুল পড়ার পিছনে।
 

দায়ী যখন হরমোন

পুরুষ হরমোন অ্যান্ড্রোজেন কেই প্রধানত দায়ী করা হয়েছে চুল পড়ার জন্য। এই হরমোন পুরুষদের বেশি থাকে, তাই তাদের চুল পড়ে বেশি। একে বলে অ্যান্ড্রোজেনিটিক অ্যালোপেশিয়া। মহিলাদের এই হরমোন থাকে সামান্য পরিমাণে। কাজেই ত্বকে এর তারতম্যের ফলে তাদের চুলও পরে কম। বংশানুক্রমে কোনও পরিবারে এই হরমোনের প্রতি হেয়ার ফলিকলের সংবেদনশীলতা বেশি থাকলে, সেই বংশে টাক পড়ার প্রবণতা বেশি থাকে।

বাচ্চা হওয়ার পর তিন-চার মাস মায়েদের খুব চুল পড়তে দেখা যায়। এর নেপথ্য থাকে একটি হরমোনের বাড়া-কমা। হরমোনটির নাম ইস্ট্রোজেন। এই হরমোনটি চুলের কুঁড়ি অর্থাৎ হেয়ার ফলিকলের কাজ কমিয়ে দেয় গর্ভাবস্থায়। ফলে অ্যানাজেন হয়ে ক্যাটাজেন পৌঁছতে দেরি হয়ে যায় চুলের। আবার টেলোজেন দশায় পৌঁছে গেছে যে চুল, তাকেও পড়তে বাধা দেয় ইস্ট্রোজেন। এক লাখ চুলের মধ্যে মাত্র ১৫ শতাংশ টেলোজেন কুঁড়ি পাওয়া যায় স্বাভাবিক অবস্থায়। গর্ভাবস্থার শেষে বেশি পরিমাণ ইস্ট্রোজেন হরমোন এটাকে টেনে নামে পাঁচ শতাংশে। এভাবেই পতন দশা বিলম্বিত হওয়ায় বা কমে যাওয়ায়, চুল পড়ে খুবই কম।

কিন্তু সন্তান জন্ম দেবার পর ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ রক্তে কমে যাওয়াতে পুরো ছকটাই যায় উল্টে। খুব চটপট অ্যানাজেন কুঁড়ি চলে যায় টেলোজেন দশায়। চুল পড়তে থাকে গোছা গোছা। তিন চার মাসের মধ্যেই এই পতন পর্ব শেষ হয়ে যায়। উঠতে থাকে নতুন চুল।

আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৩৯: পথের প্রান্তে রয়ে গিয়েছে সে হাজার তারার ‘লক্ষহীরা’

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৬: ‘ও হানসিনি, মেরি হানসিনি কাঁহা উড় চলি’—কিশোর-পঞ্চম ম্যাজিক চলছেই

 

অপুষ্টির জন্য

দেহের পুষ্টি থেকেই আসে ত্বকের পুষ্টি, আর তার থেকেই চুলের পুষ্টি। কারণ চুল দেহত্বকেরই অংশবিশেষ। বাইরে থেকে এটা সেটা মেখে চুলের জেল্লা বাড়তে পারে, কিন্তু পুষ্টি বাড়ে না। মাথার ত্বকের ডারমিস স্তরে যে চুলের কুঁড়ি বা হেয়ার ফলিকল থাকে, সেখানে থাকে অসংখ্য রক্তবহা নালিকা। এরাই পুষ্টি বহন করে আনে চুলের কুঁড়িতে।আর এই পুষ্টি আসে রোজ সুষম খাদ্য বা ব্যালেন্সড ডায়েট খেলে।
 

থাইরয়েডের অসুখ

আমাদের গলার সামনে থাইরয়েড নামক একটি নালিবিহীন অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি থাকে, যার থেকে থাইরক্সিন নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয়ে নানা শারীরবৃত্তীয় কাজে অংশ নেয়। এই হরমোনের নিঃসরণের পরিমাণ বেড়ে গেলেও চুল পড়তে পারে, কমলেও পড়তে পারে। কমে গেলে শুধু যে চুল পড়ে তাই নয়, চুল হয়ে ওঠে শুকনো, উজ্জ্বল্যহীন এবং ভঙ্গুর। মাথার ত্বকে অসংখ্য সিবেসিয়াস গ্রন্থি থাকে, যেগুলো থেকে তৈলাক্ত সিবাম চুলের মধ্যকার ফাঁপা পথে বেরিয়ে এসে চুলের জেল্লা বজায় রাখে। এই সময় এই সিবাম নিঃসরণের পরিমাণ কমে যায় বলেই চুল হারায় তার চাকচিক্য, হয়ে ওঠে উজ্জ্বল্যহীন। আর চুলের জীবন চক্রের টেলোজেন পর্ব দীর্ঘস্থায়ী হওয়াতে পটাপট চুল পড়তে থাকে।
 

অসুখ বিসুখ

দীর্ঘস্থায়ী কোনও রোগের ফলে অনেকের দীর্ঘদিন ধরে অল্প অল্প করে চুল পড়তে পারে। যেমন ক্রনিক অ্যানিমিয়া, পেটের অসুখ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, থাইরয়েডের অসুখ, দীর্ঘদিন ধরে জন্মনিরোধক বড়ি খাওয়া ইত্যাদি। দীর্ঘ সময় ধরে হেলমেট ব্যবহার করার ফলেও অনেকের চুল ঝরে যেতে পারে। বারে বারে মাথা ন্যাড়া করলেও কিন্তু চুল পড়তে পারে।
 

বংশগত কারণ

মা বাবা, দাদু ঠাকুমার অসময়ে চুল পড়ার ইতিহাস থাকলে সন্তানেরও পড়তে পারে। এর নেপথ্যে রয়েছে জিন ঘটিত ত্রুটি। অ্যান্ড্রোজেন হরমোনও এর জন্য দায়ী। দেখা গেছে বাবার চুল পড়ার ধরনের সঙ্গে সন্তানের, আবার ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের এই ব্যাপারে মিল থাকে। মাথার দু’পাশ থেকে টাক পড়তে শুরু করলে তাকে বলে মেল টাইপ অ্যালোপেসিয়া।

আরও পড়ুন:

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২: রথ দেখো কলা বেচো

বৈষম্যের বিরোধ-জবানি, পর্ব-২৪: সতী ও অসতী মাঝে পিতৃতন্ত্র

 

মানসিক দুশ্চিন্তা

এর থেকে মুক্ত নই আমরা কেউই। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় অনেকের চুল উঠে যায়, এমন ঘটনার সাক্ষী অনেকেই। আবার ট্রাইকোটিলম্যানিয়া নামে একটি মানসিক রোগ আছে, যেখানে রোগী নিজেই নিজের চুল টেনে ছেঁড়ে।
 

ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া

ক্যানসারের ওষুধ, কেমোথেরাপি নামে যে আমাদের কাছে পরিচিত, তার থেকেও চুল পড়ে গোছা গোছা। অবশ্য কয়েক মাস বাদে আবার নতুন করে চুলও গজায়।
 

হঠাৎ করে

মাথার ত্বকে ছত্রাক সংক্রমণ হলে বা সেবোরিক ডার্মাটাইটিস-সহ নানা ত্বকের অসুখে চুল পড়তে পারে। এছাড়া হঠাৎ করে তেল বা শ্যাম্পুর ব্র্যান্ড পাল্টালে, মাথায় প্রথম কলপ করলে, মাথায় এটা সেটা মাখলে, হেয়ার স্ট্রেটনিং, কারলিং ইত্যাদি করলেও চুল পড়তে পারে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব থেকেও চুল পড়ে। অনেকে খুব টান করে চুল বাঁধেন বা খুব বেশি চুল আঁচড়ান। এর ফলেও চুল পড়তে পারে। শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে এটা দেখা যায়। একে বলে ট্রাকশন অ্যালোপেসিয়া।
 

অ্যালোপেসিয়া এরিয়েটা

বাংলায় বলে টাক পোকা। অথচ এর নেপথ্যে কোনও পোকা বা জীবাণু সংক্রমণ নেই। দেখলে মনে হবে মাথার জায়গায় জায়গায় কিছুটা করে চুল কেউ যেন খুবলে নিয়েছে। মাথা ছাড়াও দেহের অন্যান্য অংশে যেমন দাড়িতে, চোখের পাতায়, ভ্রু যুগলে এমনটা হতে পারে। এই সমস্যা অনেক সময় নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যায়, তা না হলে অবশ্যই ত্বক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেবেন।

তাহলে বুঝলেন তো, চুল এমনি এমনিই পড়তে পারে, আবার নানা কারণেই পড়তে পারে। হীনমন্যতায় ভুগবেন না। টোটকা টাটকা না করে সঠিক সময় ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন।

* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content