শনিবার ১৮ জানুয়ারি, ২০২৫


স্কেচ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

ডাক্তারবাবুর চেম্বারে অনেকে এসে আবদার করেন, শরীরে ঠিক জুত পাচ্ছি না, একটা ভালো টনিক লিখে দিন তো ডাক্তারবাবু! কিংবা বলেন, আমার বাচ্চাটা দিন দিন কেমন রোগা হয়ে যাচ্ছে, একটা ভালো টনিক খাওয়ালে কেমন হয়!

TONIC। পাঁচ অক্ষরের এই নির্দোষ শব্দগুলোর মধ্যে কী জাদু আছে কে জানে! পুষ্টিকর সুষম খাবার না খেয়ে অনেকেরই নজর এই বোতলবন্দি টনিকের দিকে। অনেকে আবার দুর্বলতা কাটানোর জন্য কোনও ভিটামিন ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল নিজের বুদ্ধিতেই দোকান থেকে কিনে খান। কিন্তু সত্যিই কি এগুলো দেহের কোনও কাজে লাগে! ভিটামিন টনিক, লিভার টনিক, আয়রন টনিক, ব্রেন টনিক সেক্স টনিক—কত বাহারি সব নাম।
 

ভিটামিন টনিক

নানা শারীরবৃত্তীয় কাজের জন্য প্রতিদিন দেহে নির্দিষ্ট পরিমাণ বিভিন্ন ভিটামিন অবশ্যই দরকার। দু’ধরনের ভিটামিন আমরা খেয়ে থাকি। প্রথমটি হল চর্বিতে দ্রবীভূত ভিটামিন। এই দলে রয়েছে এ, ডি, ই, এবং কে। আর জলে দ্রবীভূত ভিটামিনের মধ্যে রয়েছে বি গ্রুপের সব ভিটামিন এবং ভিটামিন সি। আমরা সারাদিন নানা ধরনের খাবার খাই। যেমন শাক-সব্জি, ডাল, চাল, গম, নানা ধরনের ফল, মাছ-মাংস, তেল, ঘি, মাখন ইত্যাদি। এইসব খাদ্যদ্রব্যগুলো থেকেই দেহ তার প্রয়োজনীয় ভিটামিন পেয়ে যায়। বাড়তি ভিটামিনের প্রয়োজন তখনই হয়, যখন দেহের কোনও অসুখে বা বয়স জনিত কারণে এগুলোর ঘাটতি দেখা দেয়। যে ধরনের ভিটামিনের ঘাটতি হয়, ডাক্তারবাবুরা ঠিক সেই ধরনের ভিটামিনযুক্ত খাদ্য বা ক্যাপসুল বা টনিক খেতে পরামর্শ দেন।

তথাকথিত বাজারি ভিটামিন টনিকগুলোতে থাকে নানা ধরনের ভিটামিনের জগাখিচুড়ি, সঙ্গে কোথাও ক্যালশিয়াম-সহ নানা মিনারেলস, অ্যালকোহল, কোথাও বা স্নায়ু উত্তেজক নিউরো ফসফেট, ক্যাফিন, স্টিকনিন ইত্যাদি। আর থাকে বিশুদ্ধ জল। একজন সুস্থ মানুষের এই বাড়তি ভিটামিন গুলোর কোনও প্রয়োজনই নেই। এদের অধিকাংশই মূত্রের সঙ্গে দেহ থেকে বার হয়ে যায়। অকারণে দীর্ঘদিন ধরে খেলে নানা খারাপ প্রতিক্রিয়াও দেখা দিতে পারে।
অনেকেরই অভ্যাস দুপুরে এবং রাতে দু’বেলা খাওয়ার পর দুটো ভিটামিন ক্যাপসুল মুখে ফেলা। কিংবা বিজ্ঞাপনের চটকে প্রভাবিত হয়ে এটা সেটা দুধে বা জলে গুলে খাওয়া। এতে খামোখা অর্থদণ্ড ছাড়া আর কিছুই হয় না। পেট ভরে ভাত, ডাল, শাক-সব্জি, সপ্তাহে দিন তিনেক মাছ-ডিম-দুধ খেলেই যথেষ্ট ভিটামিন পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?

কলকাতার পথ-হেঁশেল: অফিসপাড়ার ক্যান্টিন ডেকার্স লেনে কোলাহল

 

লিভার টনিক

বাঙালিদের লিভার নাকি জন্ম থেকেই খারাপ! যেজন্য শিশুকাল থেকেই অনেক মা তার সন্তানকে দুধে ভাতের বদলে লিভার টনিক ভাতে রাখার চেষ্টা করেন অর্থাৎ দুবেলা খাওয়ার পরেই দু’চামচ করে লিভার টনিক গেলান। প্রায় ক্ষেত্রেই তথাকথিত এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী ডাক্তারের এতে বাণিজ্যিক কারণে মদত থাকে।

লিভার আমাদের দেহের কোনও এলেবেলে হজম অঙ্গ নয়। অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো লিভার যখন তখন অসুস্থও হয় না। বরং আমরা যা খাই তাকে গ্লাইকোজেনে পরিণত করে নিজের মধ্যে জমিয়ে রেখে বিপদে-আপদে সে দেহকে রক্ষা করে। লিভারে থাকে অসংখ্য কোষ, যার দশ ভাগের এক ভাগ সুস্থ থাকলেই লিভার দিব্যি তার কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে। তবে হ্যাঁ, লিভারও মাঝেমধ্যে অসুস্থ হতে পারে। অ্যামিবিক হেপাটাইটিস যেখানে আমাশার জীবাণু লিভারে বাসা বাঁধে, ম্যালেরিয়ায়, কালাজ্বরে, রক্তের অসুখে, জন্ডিসে, ডায়াবেটিসে, ক্যানসারে, গলব্লাডারের অসুখে এবং সিরোসিসে লিভার আক্রান্ত হয়। এমনকি ফোঁড়া ও সিস্ট-সহ ছোটখাট রোগও লিভারে হতে পারে। এদের প্রত্যেকেরই চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন। এখানে লিভার টনিকের কোনও ভূমিকা নেই।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৯: ঠাকুরের ঘরণী সারদার গার্হস্থ্য জীবন

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪৬: বহু জনমের মায়া, ধরিল যে কায়া, ওগো ‘শিল্পী’ সে তো শুধু তোমারই ছায়া

তথাকথিত লিভার টনিকে থাকে বাইল সল্ট বা পিত্ত লবণ, যেগুলোর ব্যবহার কোনও ডাক্তারি বইতে লেখা নেই। বরং বেশি খেলে এগুলো পাকস্থলী ও ক্ষুদ্রান্তের প্রথম অংশের মিউকাস মেমব্রেনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, ফলে আলসার বা ঘা দেখা দিতে পারে। কলিন ও মিথিওনিন নামক দুটো অ্যামাইনো অ্যাসিডও লিভার টনিকে থাকে যারা লিভারের কোনও কাজে আসে না। আমরা রোজ যেসব খাবার খাই সেগুলোতে এই দুটি যথেষ্ট পরিমাণে থাকে। লিভার টনিকে যে গাদা গুচ্ছের ভিটামিনের জগাখিচুড়ি মিশ্রণ থাকে, তার সম্বন্ধেও একই কথাই বলতে হয়।

লিভার টনিকের অন্যতম উপাদান হল সরবিটল নামক এক ধরনের কার্বোহাইড্রেট, মুখে খেলে যেটি লিভারে পৌঁছনোর আগেই অন্ত্রনালীতে শোষিত হয়ে যায়। কাজেই উপকার বা অপকারের প্রশ্নই আসে না। আর আয়ুর্বেদিক যেসব ওষুধ লিভার টনিকে থাকে, সেগুলো নিয়ে সেভাবে কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা কোনও কালেই হয়নি, যা হয়েছে তার ফলাফলও ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ স্বীকৃত নয়। কীভাবে তারা দেহের কোনও কোনও অঙ্গে কাজ করে, কোন মাত্রায় করে, কেন করে—কেউ জানে না। অবশ্য প্রাজ্ঞজনেরা তো বলতেই পারেন, গাছ-গাছড়ারা মিছে কথা কয় না, উপকার ঠিকই করে, কিন্তু জানতি পারো না।
আরও পড়ুন:

প্রথম আলো, পর্ব-৩: পৃথিবীর প্রথম কবি কে, জানেন?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-১২: আমাকে আমার মতো থাকতে দাও

 

শেষ অনুরোধ

এই দুর্মূল্যের বাজারে নিজের বুদ্ধিতে বা বিজ্ঞাপনে প্রভাবিত হয়ে দয়া করে ওষুধের দোকান থেকে লিভার টনিক কেন, কোনও টনিকই কিনে খাবেন না। ডাক্তারবাবুদেরও জোরাজুরি করবেন না, এইসব ছাই-ভস্ম লেখার জন্য। দেহে নির্দিষ্ট কোনও পুষ্টিকর উপাদানের ঘাটতি হলে, কী খেতে হবে, কতটা পরিমাণে খেতে হবে, সেই পরামর্শ দেবেন শিক্ষিত ডাক্তারবাবুরাই। তাদের কথাই এই ব্যাপারে শেষ কথা।

যোগাযোগ: ৯৮৩০২১৭৯২৮

* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content