রবিবার ২৪ নভেম্বর, ২০২৪


অলঙ্করণ: গৌতম চট্টোপাধ্যায়।

খেয়ে উঠতে না উঠতেই অনেকের ঘুম পায়। বিশেষ করে সারাদিন যারা গাধার খাটুনি খাটেন। তাছাড়া পেট ভরে খাওয়ার পরে শরীরটাও যেন বিশ্রাম চায়। কিন্তু পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, খাওয়ার পর অন্তত এক-দু’ঘণ্টা বাদেই শোওয়া উচিত। ছোটবেলা থেকেই অবশ্য আমি ঠাকুমার থেকে এই কথাটি বারে বারেই শুনে এসেছি।

কেন খেয়ে উঠেই শুতে নেই, সেটা এবার চিকিৎসা বিজ্ঞানের আলোকে আলোকিত করা যাক। তার আগে আমরা কীভাবে হজম করি, সেই ব্যাপারটা একটু সহজ কথায় বলি। আমরা খাবার খেয়ে হজম করি যে নালীর সাহায্যে, তার নাম পৌষ্টিক নালী। মুখ থেকে শুরু হয়ে যা শেষ হয় মল দ্বারে। আমরা যাই খাই না কেন, মুখের লালার সঙ্গে মিশে গলবিল বা ফ্যারিংস হয়ে সেটা যায় খাদ্যনালী বা ইসোফেগাসে। সেখান থেকে পাকস্থলী হয়ে ক্ষুদ্রান্তে, তারপর যায় বৃহদন্ত্রে। পাকস্থলী এবং ক্ষুদ্রান্তে খাদ্য হজম হয় পাচক রসের সাহায্যে। হজমের মূল কাজটি সুসম্পন্ন হয় ক্ষুদ্রান্তের জেজুনামে। এরপর বৃহদন্ত্রে খাদ্যের অসার অংশটি বর্জ্য পদার্থ হিসেবে এসে জমা হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে মল হয়ে বার হয়ে যায়।
মুখের ভেতর তিন জোড়া বড় লালা গ্রন্থি এবং অসংখ্য ছোট লালাগ্রন্থি থাকে। বড়গুলোর নাম প্যারোটিড, সাব ম্যান্ডিউলার এবং সাব লিঙ্গুয়াল। শুনে আশ্চর্য হবেন, এইসব নানা ধরনের লালা গ্রন্থি থেকে দিনে প্রায় দশ কাপের মতো লালা ক্ষরিত হয়! এই লালা চর্বিত খাদ্যকে ভিজিয়ে খাদ্যনালী বা ইসোফেগাসে পাঠাতে সাহায্য করে এবং উৎসেচক বা এনজাইমের সাহায্যে শ্বেতসার জাতীয় কার্বোহাইড্রেটকে শর্করাতে পরিণত করে।

ইসোফেগাস থেকে খাদ্য প্রবেশ করে পাকস্থলী বা স্টমাকে। এই পাকস্থলীর ভিতরের আস্তরণ হল মিউকাস মেমব্রেন বা শেলষমা পর্দা। এই পর্দার বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম ক্ষরিত হয়ে নানা ধরনের খাদ্য উপাদানকে হজমে সাহায্য করে। রেনিন এনজাইমটি দুধ হজমে সহায়তা করে। পেপসিন এনজাইমটি প্রোটিন পরিপাকে সাহায্য নেয়
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩: টক খেওনা ধরবে গলা

হেলদি ডায়েট: একটুতেই নখ ভেঙে যায়? নখের স্বাস্থ্যের জন্য এই সব খাবার পাতে রাখতেই হবে

পাকস্থলীতে প্রচুর হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড তৈরি হয়, যা হজমে নানাভাবে সাহায্য করে। এই অ্যাসিড খাদ্যের প্রোটিন অংশের শৃঙ্খলগুলোকে ভেঙে দেয়, প্রোটিনকে ভেঙে পেপটোনে পরিণত করতে পেপসিন এনজাইমকে শক্তি দান করে। খাদ্যের সঙ্গে যেসব ক্ষতিকর জীবাণু পাকস্থলীতে পৌঁছয়, তাদের নিস্তেজ করে দেয়। এছাড়া আমাদের খাদ্যের খনিজ উপাদানগুলোকে ভেঙেচুরে সহজপাচ্য করতেও এই অ্যাসিডের জুড়ি নেই।

গ্যাস্ট্রিক ডাইজেশন বা পাকস্থলীর হজম প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি কার্যকরী হয় খাদ্য গ্রহণের অন্তত দু’ঘণ্টা পরে। কারণ, এই দু’ঘণ্টার মাথায় সব থেকে বেশি পরিমাণে রেনিন এবং পেপসিন উৎসেচক এবং হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড পাকস্থলীর মিউকাস পর্দা থেকে ক্ষরিত হয়। পাকস্থলীতে প্রধানত প্রোটিনের পরিপাক হয় এবং সামান্য পরিমাণে জল অ্যালকোহল এবং কিছু ওষুধ এখানে শোষিত হয়। আংশিক হজম হওয়া খাদ্য দু’ঘণ্টা পরে পাকস্থলী থেকে ক্ষুদ্রান্ত্রে চলে আসে এবং হজমের বাকি পর্বগুলো এখানে সমাধা হওয়ার পর, তা শোষিত হয়ে রক্ত স্রোতে চলে আসে। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে মূল প্রসঙ্গে অর্থাৎ খেয়ে উঠেই কেন শুতে নেই, সেটা বলি।
আরও পড়ুন:

ছোটদের যত্নে: হঠাৎই জ্বর, মুখে-হাতে ঘা হচ্ছে শিশুদের! কষ্টকর হলেও ভয়ের কিছু নেই, জেনে নিন কোন রোগের উপসর্গ এগুলি

ত্বকের পরিচর্যায়: শীতে কি আপনার ত্বক শুকিয়ে যায়? মেনে চলুন ত্বক বিশেষজ্ঞের এই পরামর্শগুলি

খাদ্য গিলে ফেলার পর যেহেতু তা ইসোফেগাস হয়ে প্রথমে স্টমাকে বা পাকস্থলীতে আসে এবং এখানকার হজম পর্ব শেষ হতে যেহেতু অন্তত ঘণ্টা দুয়েক সময় লাগে, সেই হেতু খাবার খাওয়ার দু’ঘণ্টা পর শোওয়াই ভালো। আগে শুলে পাকস্থলীর হজম পর্বকে সম্পাদন করার জন্য যে পরিমাণ হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড ক্ষরিত হয়, তার কিছুটা পাকস্থলীর উপরের স্পিনটার বা অর্গল দিয়ে ইসোফেগাস বা খাদ্যনালীতে এবং ফ্যারিংস বা গলবিলে উঠে এসে বিপত্তি বাধাতে পারে। সবার বেলায় এমনটা হবেই তা নয়, যদিও পাকস্থলীতে সবারই অ্যাসিড থাকে। হার্নিয়া-সহ পাকস্থলীর নানা অসুখেও এটা হতে পারে।
আরও পড়ুন:

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৩: বিমানবন্দর থেকে বেরিয়েই উইসকনসিনের সঙ্গে পার্থক্যটা টের পেলাম, মুহূর্তে ঠোঁট, গাল জমে যেতে লাগল

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২১: কে তুমি নিলে আমার চিরসবুজের ‘অগ্নিপরীক্ষা’

এই উঠে আসা অ্যাসিড থেকে বুক জ্বালা করে। খেয়েই যদি কেউ শুয়ে পড়ে বা সামনে ঝুঁকে কোনও কাজ করে, তখনই তার বুক জ্বালা শুরু হয়, বুকে যেন গরম ভাব লাগে। এই সময় ঠান্ডা জল খেলেও জ্বালা বোধ হতে পারে। অনেকের গলায় টক জল উঠে আসে। ঢোক গিলতে বাধো বাধো ঠেকে। এইসব উপসর্গ থাকলে আমরা বলি গ্যাস্ট্রো ইসোফিজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা GERD হয়েছে। এই রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগীরা অভিযোগ করেন সব সময় যেন তার গলায় কিছু আটকে আছে। মধ্যবয়সী মহিলাদের এটা বেশি দেখা যায়।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৪৯: গুরুদেবের দেওয়া গুরুদায়িত্ব

বিচিত্রের বৈচিত্র্য: জীবন খাতার প্রতি পাতায় যতই লেখো হিসাব নিকাশ/২

রোগীর জীবনযাত্রা এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ঘটিয়ে এই রোগের উপসর্গগুলো অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। যাঁদের ওজন বেশি, তাঁদের ওজন কমাতে হবে। পেট ভর্তি করে খাওয়া চলবে না। বেশি রাত করে বা অসময়ে খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে হবে। ঝালে ঝোলে অম্বলে খাবেন না। ভাজাভুজি, চকলেট, কফি, কোল্ড ড্রিঙ্ক টমেটো, লেবু, মদ খাবেন না। এরা অনেকক্ষণ ধরে পাকস্থলীতে থাকে, হজম হতে সময় নেয়। দুপুরে ভাতঘুম দেওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। রাত নটার মধ্যে ডিনার করে এগারোটার পর শুতে যাবেন। এই নিয়মগুলো মেনে চললেই রোগটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে, প্রয়োজনে অবশ্যই ডাক্তার বাবুর পরামর্শ নেবেন।

গ্যাস্ট্রো ইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ বা GERD আপনার হোক বা না হোক, খেয়ে উঠে যেন তখুনি শুতে যাবেন না। দু’ ঘণ্টা পর না পারেন অন্তত এক-দেড় ঘণ্টা পরে যাবেন। রাতের খাবারটা একটু হালকা খাবেন। অম্বল বা বদহজমের দোষ থাকলে অবশ্যই ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করিয়ে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করাবেন।
* এগুলো কিন্তু ঠিক নয় (Health Tips): ডাঃ অমিতাভ ভট্টাচার্য (Amitava Bhattacharrya), বিশিষ্ট স্বাস্থ্য বিজ্ঞান লেখক। পেশায় কান নাক গলা (ক্যানসার) বিশেষজ্ঞ হলেও মানুষটি আদতে ভীষণ আড্ডাবাজ এবং নাটক প্রাণ। এ পর্যন্ত ছোট বড় মিলিয়ে শতাধিক নাটক লিখেছেন। পরিচালনা করেছেন ৩০টিরও বেশি নাটক। দূরদর্শন এবং আকাশবাণীর অভিনয় পুরস্কার পেয়েছেন। বেলঘরিয়া থিয়েটার আকাডেমি নামে নিজে একটি নাটকের দল পরিচালনা করেন। দে’জ পাবলিশিং থেকে এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৫২। নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন বছর ভর।

Skip to content