বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


স্ট্রোক বা ব্রেন অ্যাটাক এই কথাটির সঙ্গে এখন আমরা প্রায় সবাই মোটামুটি পরিচিত। আমাদের মস্তিষ্কের কোষে ঠিকমতো রক্ত সরবরাহ না হলে অথবা মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী ধমনী ছিঁড়ে গিয়ে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকেই বলে স্ট্রোক। যদি রক্ত সরবরাহ ঠিকমতো না হওয়ার জন্য স্ট্রোক হয় তাহলে তাকে ইসকিমিক (ischaemic) স্ট্রোক বলা হয়। আর যদি ধমনী ছিঁড়ে গিয়ে স্ট্রোক হয় তাহলে তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় হেমাজিক (haemorrhagic) স্ট্রোক বলে। বিশ্ব স্ট্রোক সংস্থা বা ওয়ার্ল্ড স্ট্রোক অর্গানাইজেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, বর্তমানে স্ট্রোক পৃথিবীর মৃত্যুর দ্বিতীয় অন্যতম কারণ। সেই সঙ্গে মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের তৃতীয় অন্যতম কারণও। অর্থাৎ আমরা বলতে পারি যে, স্ট্রোকের জন্য পৃথিবীর একটা বিরাট অংশের মানুষ আজ আক্রান্ত। প্রতি চার জন মানুষের মধ্যে একজন আজ স্ট্রোকে আক্রান্ত হচ্ছেন।
গত এক দশকে এই স্ট্রোকের বোঝা ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের নিম্ন থেকে মধ্য উপার্জনকারী দেশগুলিতে এর হার অনেকটা বেশি। উন্নত দেশগুলি কিন্তু গত এক দশকে স্ট্রোকের বোঝা অনেকটাই কমাতে সফল হয়েছে। স্ট্রোক এমন একটি অসুখ যার ফলে শুধু স্ট্রোক আক্রান্ত ব্যক্তি নয়, পুরো পরিবারই ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। কারণ, স্ট্রোকের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি, ব্যয়বহুল এবং পঙ্গুত্বের মাত্রা যদি বেশি হয় তাহলে সেই ব্যক্তির পুনরায় সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা অনেকটাই সময় সাপেক্ষ। ফলে পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তি যদি আক্রান্ত হন, তাহলে সেই পরিবারটির বেঁচে থাকার লড়াই আরও অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আর উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন এই স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ।
আরও পড়ুন:

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: মানসিক চাপ এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন? কোন পথে সমাধান? রইল কিছু ঘরোয়া সমাধান

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়: পর্ব-১১: লিকার চা খাওয়া কি সত্যই শরীরের পক্ষে ভালো?

বিধানে বেদ-আয়ুর্বেদ: আমবাতের সমস্যায় ভুগছেন? ভালো থাকবেন এই ঘরোয়া উপায়গুলি মেনে চললে

 

কীভাবে বুঝবেন স্ট্রোক হয়েছে

‘FAST’ এই শব্দটি মনে রাখলে খুব সহজেই স্ট্রোক লক্ষণ চেনা যায়।
 

মুখের পরিবর্তন

● ‘F’ অর্থাৎ ফেস বা মুখ। এই মুখের কোনওরকম পরিবর্তন লক্ষ্য করলে যেমন একদিকে বেঁকে যাওয়া বা ঝুলে যাওয়া দেখলে বুঝতে হবে স্ট্রোক আক্রান্ত হতে পারে।
 

হাত নাড়াচাড়া করতে অসুবিধে

● ‘A’ অর্থাৎ আর্ম বা হাত যেকোনও একটি হাত তুলতে বা নাড়াচাড়া করতে অসুবিধে হলেই বুঝতে হবে স্ট্রোকের লক্ষণ।

 

কথা জড়িয়ে যাওয়া

● ‘S’ অর্থাৎ স্পিচ বা কথা বলতে কোনও অসুবিধে যেমন কথা জড়িয়ে, কথা বুঝতে অসুবিধে হওয়া ইত্যাদি হলে বুঝতে হবে স্ট্রোক।
 

সময়

● ‘T’ অর্থাৎ টাইম বা সময়, আগের তিনটির কোন একটি লক্ষণ বুঝতে পারলেই রোগীকে সঙ্গে সঙ্গে নিকটবর্তী হাসপাতালে বা নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে হবে।

কারণ, স্ট্রোক হওয়ার পর যত তাড়াতাড়ি আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করা যাবে তার সুস্থ হয়ে ওঠার এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার সম্ভাবনা তত বেশি থাকবে। সে কারণেই বলা হয়, টাইম ইজ ব্রেন। কারণ, মস্তিষ্কের কোষগুলির একবার মৃত্যু হলে সেগুলোকে আর কোনওভাবেই বাঁচিয়ে তোলা যায় না। তাই স্ট্রোক হওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করা অত্যন্ত জরুরি।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি,পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন

হেলদি ডায়েট: করলা স্বাদে তেতো হলেও পুষ্টিগুণ কিন্তু মিষ্টি! একঝলকে জেনে নিন রোজ কেন পাতে রাখবেন এই সব্জি

বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ

 

স্ট্রোকে উচ্চ রক্তচাপ কেন গুরুত্বপূর্ণ

বেশিরভাগ রোগী যারা প্রথমবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, তাদের বেশিরভাগ এরই দেখা গিয়েছে উচ্চ রক্তচাপ থাকে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোগী স্ট্রোক হওয়ার আগে পর্যন্ত জানতেনই না যে তিনি উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনে আক্রান্ত। উচ্চ রক্তচাপের ফলে আমাদের সারা শরীরের রক্ত সরবরাহকারী ধমনীর দেওয়ালগুলি ধীরে ধীরে পাতলা হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে সেগুলি খুব সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে অথবা এর ভিতরে ছোট ছোট রক্ত জমাট বেঁধে ক্লট (Clot) সৃষ্টি করতে পারে। আর মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহকারী ধমনীগুলি যদি এই রকম হয়, তাহলে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে। তাই স্ট্রোকের ঝুঁকি কমানোর জন্য উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করা ভীষণই জরুরি। উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন একটি সিম্পটমবিহীন (symptomless) নীরব ঘাতক, যা ধীরে ধীরে আপনার রক্ত সরবরাহকারী রক্তবাহ গুলিকে নষ্ট করে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। এর অন্যতম হল স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাক। আর এই উচ্চ রক্তচাপ একবার ধরা পড়লে তা সারানো সম্ভব নয়। কিন্তু আপনার জীবনযাত্রার পরিবর্তন করে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেলে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এর ফলে আপনার স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিও নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
 

কিছু পরিবর্তনে স্ট্রোকের ঝুঁকি কমে

যদি আপনি আপনার রক্তচাপ মাত্র ১০ এমএমএইচজি কমাতে পারেন, তাহলে আপনি ২৫ শতাংশ স্ট্রোকের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারবেন।

আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫৫: নৌকো উল্টে সত্যেন্দ্রনাথের আইসিএস পড়তে যাওয়া বানচাল হতে বসেছিল

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-৫: কালাদেওর কিস্‌সা

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১০: স্থাপত্য ছাড়িয়ে অভয়ারণ্য

 

কোন পথে উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশনের চিকিৎসা?

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, ওষুধ এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনলে উচ্চ রক্তচাপকে কাবু করা সম্ভব। কী কী বিষয় মানতেই হবে?
নুন কম, সোডিয়াম সমৃদ্ধ খাবারেও আমাদের রাশ টানতে হবে। তবে শরীরে যেতটা সোডিয়াম দরকার তা জোগানে যেন ঘাটতি না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। প্রতি দিন খাবারে যে পরিমাণ নুন মেশান তার চেয়ে ৫-১০ গ্রাম কমিয়ে ফেলাই ভালো। কাঁচা নুন তো চলবেই না, তার বদলে অল্প পরিমাণে সোডিয়াম সমৃদ্ধ অন্য খাবার খান।
বয়স ৩০ পেরলেই নিয়ম করে রক্তচাপ মেপে চলুন।
ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন করতে হবে।
লাগামছাড়া চা-কফিতে ‘না’ বলুন।
খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণ সব্জি রাখতে হবে।
রোজ দিন কিছু মরসুমি ফল খেতে হবে।
নিয়মিত শরীরচর্চা করতে হবে।
বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিতে হবে ওজন নিয়ন্ত্রণে।
রাজ অন্তত ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা ঘুমতে হবে।
যতটা সম্ভব চিন্তামুক্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
মাসে এক আধবার দু’-তিন টুকরো পাঁঠার মাংসে অসুবিধে নেই। ভয় বরং বেশি পরিমাণ ঝোল খেলে।
ক্ষতি নেই বিরিয়ানির মাংস খেলেও। ক্ষতি হল ভাত, বিরিয়ানি বা মাংসের ঝোলে যে মাংসের ফ্যাট মিশে থাকে সেটা আর মাংস কম খেয়ে ঝোল বেশি খাওয়া।
খাদ্যতালিকা থেকে ফ্যাট একেবারে বাদ নয়। কারণ আমাদের শরীরে প্রোটিন ও শর্করার সঙ্গে ফ্যাটও দরকার। তাই ভিটামিন এ, কে ও ডি-র আত্তীকরণের জন্য ফ্যাট থাকা প্রয়োজন।

* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content