বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী।

সমাজমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া এমন একটি উন্নত প্রযুক্তির প্ল্যাটফর্ম যেখানে অনেক বিস্ময়কর সুযোগ-সুবিধা আমরা পেয়ে থাকি। এটি সাহায্য করে আমাদের নিজস্ব দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, ঘটনা প্রবাহ যেমন অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারি, তেমনই দুনিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে, প্রতি মুহূর্তের খবরাখবর এবং তথ্য পেতেও এর জুড়িমেলা ভার। এমনকি, এর সাহায্যে আমরা নতুন মানুষজনের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারি।

তবে এর যেমন অনেক ভালো দিক আছে, তেমনই খারাপ দিকও আছে বহু। বিশেষ করে এই প্রজন্মের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার নিয়ে সত্যিই সচেতন হতে হবে। বলা যেতেই পারে যে, এই প্রজন্ম সমাজমাধ্যমের জগতকে সঙ্গে নিয়েই বড় হয়েছে বা হচ্ছে। তাই এটা মাথায় রাখতেই হবে, আমরা যেন সমাজমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকটি সঠিক ভাবে নজর দিই।

সমাজমাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের হতাশা, উদ্বেগ এবং একাকীত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ‘দ্য চাইল্ড মাইন্ড ইনস্টিটিউট’ এবং ‘দি ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ রিসার্চ’-এর সাম্প্রতিক গবেষণায় আমাদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে —যারা প্রায়শই সমাজমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন, তারা তুলনায় কম সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারী ও অন্যান্য কাজে বেশি সময় ব্যয় করেন তাদের চেয়ে অনেক বেশি হতাশাগ্রস্ত। সেই সঙ্গে জীবন নিয়ে তেমন খুশি বা অসন্তুষ্টও নন তারা।
 

গবেষণায় চমকপ্রদ তথ্য

হ্যাঁ, সমাজমাধ্যম শিক্ষামূলক হতে পারে। এই মাধ্যম আমাদের জন্য কোনও কোনও ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তিদায়কও হতে পারে বা জীবনের চাপ থেকে মুক্তি পেতে কিছুটা সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এর অতিতিক্ত ব্যথবহার বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাবও ফেলতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহার আমাদের উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং দীর্ঘস্থায়ী চাপের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
 

সমাজমাধ্যম কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে?

এই মাধ্যম সাধারণত আমাদের উদ্বেগ, মানসিক চাপ এবং বিষণ্নতা কমাতেই পরিচিত। সামাজিকীকরণ আমাদের জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শিখতে সাহায্য করে। আবার আত্মসম্মান বৃদ্ধিও করতে পারে। এমনকি, জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একাকীত্ব এড়াতেও সাহায্য করতে পারে।

আজকাল বহু মানুষ ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার এবং অন্যান্য সমাজমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে বেশি সময় কাটাচ্ছেন। এ সবের সাহায্যে অন্যদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন এবং বন্ধন তৈরি করছেন। অনেকের ক্ষেত্রে এটি বেশ উপভোগ্য, আনন্দদায়ক এবং স্বাস্থ্যকর মনে হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, যেকোনও সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের এই ধরনের ব্যবস্থা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের ভালো-মন্দ প্রদর্শনের এক অসম প্রতিযোগিতায় গিয়ে দাঁড় করে দিচ্ছে।

অদ্ভুত ও হাস্যকর মনে হলেও এর নামই সোশ্যাল মিডিয়া। এই সোশ্যাল মিডিয়াতে অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের ফলে নিজের অজান্তে আমাদেরকে বিচ্ছিন্নতা এবং একাকীত্বের দিকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। সর্বশেষ গবেষণাটিও দেখায়, সমাজমাধ্যম আমাদের বিষণ্নতা এবং উদ্বেগের মতো মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যাগুলিকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। বিশেষ করে অল্পবয়স্কদের মধ্যে এই নেতিবাচক প্রভাবগুলি বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

আরও পড়ুন:

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: ফুসফুসের ক্যানসারের প্রাথমিক সনাক্তকরণের জন্য শ্বাস বায়োপসি পরীক্ষার নতুন দিশা

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৬: মাছের তেল হার্ট অ্যাটাক আটকায়?

 

সমীক্ষা বলছে

২০১৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, তরুণরা নিত্যদিন তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে। এর জেরে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মত, কেউ যদি সমাজমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে এবং হতাশ, একাকীত্ব, দুঃখ বা অসন্তুষ্ট বোধ করতে শুরু হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার অবশ্যই ‘স্ক্রিন টাইম’ হ্রাস করা উচিত। সমাজমাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসার জন্য একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সেই সঙ্গে নিজেকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে ।
 

নেতিবাচক প্রভাব

সমাজমাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা একটি পুনরাবৃত্তিমূলক নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। আপনি যখন বিষণ্ণ, একাকীত্ব বা উদ্বিগ্ন বোধ করেন তখন আপনি প্রায়শই সমাজমাধ্যম ব্যবহার করতে শুরু করেন। তখন আপনি ভাবেন (বা নিজেকে বোঝান) এটি আপনাকে সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করছে। আপনাকে আনন্দ দিচ্ছে, বিনোদন দিচ্ছে এবং আপনাকে আরও আকৃষ্ট বোধ করাচ্ছে।
কিন্তু অত্যধিক সমাজমাধ্যম ব্যবহার যে নিজের অজান্তে অসন্তোষ, বিচ্ছিন্নতা, হতাশা, মানসিক অশান্তি প্রভৃতি সমস্যা তৈরি করতে পারে সে সব নিয়ে আমরা কখনও ভেবে দেখি না। এই অনুভূতিগুলি আমাদের উদ্বেগ, স্ট্রেস এবং হতাশাকে আরও তীব্র করতে পারে। এগুলো সেই সব অনুভূতি যার থেকে আপনি প্রথমে পালানোর চেষ্টা করছেন। লক্ষণগুলি ক্রমাগত খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, কিছু মানুষ সামাজমাধ্যমের প্রতি আরও বেশি আকৃষ্ট বোধ করে, আর একটি সর্পিল চক্রের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে।

আরও পড়ুন:

পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-১৭: লতা-কিশোর-পঞ্চম-গুলজারের অনবদ্য সৃষ্টি ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কই শিকওয়া নেহি’

ভৌতিক উপন্যাস: মিস মোহিনীর মায়া, পর্ব-৯: মোহাবিষ্ট মায়াবী কণ্ঠস্বর, চেনা বলার ঢং, তবে কি মোহিনী?

 

মানসিক স্বাস্থ্যের উপর সামাজমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব

হারিয়ে যাওয়ার ভয় (ফিলিং অফ মিসিং আউট, FOMO)।
আত্ম-শোষণ।
শরীরের চেহারা বা ইমেজ নিয়ে সমস্যা।
বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ।
সাইবার বুলিং।
 

কী দেখে বুঝবেন সামাজমাধ্যম মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে?

মুখোমুখি দেখা সাক্ষাৎ এড়ানো একটি বড় বিষয়। আগে আপনি মানুষের সঙ্গ উপভোগ করতেন এবং অতীতে অনেক বন্ধু ছিল। এখন আর এ সবের অভাব অনুভব করেন না।
সামাজমাধ্যমে অন্যদের সঙ্গে নিজেকে বা নিজের জীবনের তুলনা করা। বিশেষ করে যাদের আপনি জানেনই না।
আপনি প্রকৃত মানুষের তুলনায় আপনার সমাজমাধ্যমের বন্ধুরা কী বলছেন তাতেই বেশি গুরুত্ব দেন।
কর্মক্ষেত্রে, স্কুলে বা বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হলে আপনি বেশি বিভ্রান্ত হচ্ছেন।
সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
আত্ম-প্রতিফলিত করার বা এমন কিছু করার সময় নেই, যা আপনাকে বেড়ে উঠতে সহায়তা করে।
ঘুমের বেশ সমস্যা হচ্ছে।
ঝুঁকিপূর্ণ আচরণে জড়িয়ে পড়েছেন।

আরও পড়ুন:

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৪: এ শুধু অলস মায়া?

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

 

তাহলে সমাধান?

সামাজমাধ্যম আমাদের দেখতে কেমন, আমরা কেমন পোশাক পরবো বা আমাদের জীবনধারা সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তার কারণ হতে পারে। এই মাধ্যম বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারে যখন আমরা সাইবারস্পেসে বেশি সময় ব্যয় করি এবং বন্ধু ও পরিবারের সঙ্গে কাটানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাই না। তাই যদি কেউ অতিরিক্ত বিষণ্ণতা বা উদ্বিগ্ন বোধ করেন তাহলে সামাজমাধ্যমের ব্যবহার কমাতেই হবে। ঠিক যতটুক দরকার সেই মতো ব্যবহার করতে হবে। অর্থাৎ অবশ্যই আপনাকে ‘স্ক্রিন টাইম’ কমাতেই হবে। সেই সঙ্গে সামাজমাধ্যমের ব্যবহার নিয়ে আরও সচেতন হতে হবে। চেষ্টা করতে হবে সামাজমাধ্যমের বিকল্প আপনার জন্য কী কী স্বাস্থ্যকর বিকল্প রয়েছে। সেগুলি বের করে তাতেই মনোনিবেশ করতে হবে। একটা অভ্যেস তৈরি করতে হবে। আর এটি সচেতন ভাবে করতে পারলে তবে সমস্যা থেকে মুক্তি মিলবে।

* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content