শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী। সংগৃহীত।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লিভার এবং মস্তিষ্ক ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত এবং একে অপরের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। তাহলে কি লিভারের স্বাস্থ্য ডিমেনশিয়ার ঝুঁকিকে প্রভাবিত করতে পারে? এই প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক গবেষণার কথাই আলোচনা করা হচ্ছে।

সাম্প্রতিক গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা খুঁজে পেয়েছেন, লিভারের স্বাস্থ্য লিভার ফাইব্রোসিস, নন-অ্যালকোহলিক ফ্যাটি লিভার ডিজিজ (NAFLD), কগনিটভ ফাংশন কমে যাওয়া এবং মস্তিষ্কের গঠন পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। প্রদাহ যকৃত এবং মস্তিষ্ক উভয় ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। এই সংযোগের ক্ষেত্রে এটিই মূল কারণ বলে মনে করা হয়। গবেষকরা একে অন্ত্র-লিভার-মস্তিষ্কের ‘অক্ষ’ হিসেবে দেখেছেন। বিজ্ঞানীরা এও দেখেছেন, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের স্বাস্থ্য অন্ত্রে প্রবেশকারী জীবাণু লিভার এবং মস্তিষ্ক উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে। তাহলে কি এটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা? নিরাময়যোগ্য অবস্থার জন্য কোনও প্রভাব ফেলে, যা মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে? বিশেষ করে ডিমেনশিয়ার ক্ষেত্রে?
 

লিভার ও মস্তিষ্কের ‘অক্ষ’ ঠিক কী?

লিভার আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ এবং এর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। এটি খাদ্য থেকে পাওয়া তিনটি মূল পুষ্টি—কার্বোহাইড্রেট, চর্বি এবং প্রোটিন প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণ করতে সাহায্য করে। এছাড়াও লিভার শরীরকে অ্যালকোহল, ড্রাগস এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে মুক্তি দেয়। এমনকি, লিভার পিত্ত নামক একটি পদার্থ তৈরি করে যা হজমে সাহায্য করে।

সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন, লিভার এবং মস্তিষ্কের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। লিভার ও মস্তিষ্ক অক্ষ একটি বিশেষ সংযোগের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।

ডাঃ ব্লেন টেসফু, একজন লিভার বিষয়ক গবেষক। তাঁর মতে, লিভার-মস্তিষ্কের অক্ষ বলতে লিভার এবং মস্তিষ্কের মধ্যে দ্বিমুখী যোগাযোগ এবং মিথস্ক্রিয়াকে বোঝায়। লিভার বিষাক্ত পদার্থ এবং প্রদাহজনক মধ্যস্থতাকারী-সহ একাধিক পদার্থের বিপাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দীর্ঘস্থায়ী লিভারের রোগে, লিভার ফাইব্রোসিস প্রদাহ বৃদ্ধি এবং রক্তের প্রবাহে প্রো-ইনফ্ল্যামেটরি অণু থেকে শরীরকে মুক্তি দিতে পারে। লিভারের রোগ প্রদাহ ডিমেনশিয়ার সম্যস্যাকে প্রভাবিত করতে পারে।

সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লিভার-মস্তিষ্কের অক্ষ এবং কগনিটভ ফাংশন কমে যাওয়ায় মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে, যার একটি অন্তর্নিহিত কারণ হিসেবে প্রদাহ দায়ী। ২০২৩ সালের মে মাসে ‘সেলস’ জার্নালে প্রকাশিত ইঁদুরের উপর একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আলঝেইমারের জিনগত প্রবণতা ছাড়া ইঁদুরের তুলনায় জিনগত প্রবণতা-সহ ইঁদুরের লিভারের কর্মহীনতা, অক্সিডেটিভ স্ট্রেস, প্রদাহ এবং লিভার আকারে বড় ছিল।
সাধারণত আলঝেইমারের গবেষণায় মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলির উপর নজর দেওয়া হয়। তবে অক্সি-ইনফ্লামেশন হাইপোথিসিস এও জানায় যে, ইমিউন সিস্টেমের সমস্যা এবং বার্ধক্যও এই রোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ডঃ টেসফু-র কথায়, প্রদাহজনিত অণুগুলি ‘ব্লাড-ব্রেন বেরিয়ার’-কে অতিক্রম করতে পারে। সেই সঙ্গে মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে এবং কগনিটিভ ফাংশনের দুর্বলতায় অবদান রাখে। প্রদাহ মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফলে এবং বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কগনিটিভ ফাংশন কমে যাওয়ার সঙ্গে যুক্ত। ২০২৩ সালের মে মাসে চিনের ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা ফ্রন্টিয়ার্স ইন নিউরোসায়েন্সে প্রকাশিত একটি গবেষণায় আলঝেইমার রোগে পুষ্টির প্রভাব নিয়ে গবেষণা চালান। তাঁরা জানান, বিপাকীয় ব্যাধি, যেমন উচ্চ কোলেস্টেরল এবং ফ্যাটি লিভারের রোগ মস্তিষ্কের পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত।

২০২২ সালের আগস্টে হেপাটোলজি জার্নালে প্রকাশিত আরেকটি গবেষণা এনএএফএলডি এবং কগনিটিভ ফাংশন কমে যাওয়ার মধ্যে সম্পর্কের দিকে নজর দিয়েছে। এই গবেষণায় এনএএফএলডি এবং স্থূলতা-সহ ইঁদুর উদ্বেগ এবং হতাশার মতো আচরণের ফলে মস্তিষ্কের অক্সিজেনের মাত্রা হ্রাস পায় বলে জানা গিয়েছে। সেই সঙ্গে এও দেখা গিয়েছে, মস্তিষ্কের কোষের কার্যকলাপেও প্রভাব ফেলে। এই সব গবেষণা থেকে পরিষ্কার, লিভারের অবস্থা মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করতে পারে।

আরও পড়ুন:

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: মানসিক অবসাদ এড়াতে ওষুধের সঙ্গেই ভরসা থাকুক পুষ্টিকর খাবারে, কী বলছে গবেষণা?

রিভিউ: ‘সির্ফ এক বান্দা কাফি হ্যায়’—মনোজ বাজপেয়ী একাই একশো

 

হার্ট, মস্তিষ্ক এবং যকৃতের স্বাস্থ্যের মধ্যে কোনও যোগ আছে?

বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দেখা গিয়েছে, এই তিন অঙ্গের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগ আছে। যেহেতু লিভার পুষ্টি প্রক্রিয়াকরণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তাই এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ডাঃ ব্লেন টেসফুরের মতে, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের আন্তঃসম্পর্ক বোঝা স্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি সামগ্রিক পদ্ধতির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে, যা মানসিক সুস্থতা এবং কগনিটভ ফাংশনের উপর বিভিন্ন অঙ্গ এবং সিস্টেমের প্রভাব বিবেচনা করে। এ ক্ষেত্রে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে, যা লিভার-মস্তিষ্কের অক্ষের অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়াগুলিকে উন্মোচন করতে সাহায্য করতে পারে। সেই সঙ্গে সম্ভাব্য লিভারের রোগ এবং কগনিটভ বৈকল্য উভয়ের জন্য নতুন থেরাপিউটিক কৌশলগুলির দিকে পরিচালিত করতে পারে।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩: আত্মারামে কুটো বাঁধা আছে

শাশ্বতী রামায়ণী, পর্ব-৫১: মারীচমায়ায় কি দিগভ্রান্ত সীতা?

 

লিভার ফাইব্রোসিস ও কগনিটিভ ফাংশন

সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা লিভার ফাইব্রোসিস, দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগের কারণে লিভারে অপ্রয়োজনীয় টিস্যু গঠন এবং কগনিটিভ ফাংশন হ্রাসের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন। এই ফলাফলগুলি ২০২৩ সালের জুলাই মাসে ইবায়োমেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রতিবেদনে লিভার এবং মস্তিষ্কের মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের উপর জোর দিয়ে লিভার-মস্তিষ্কের অক্ষের অস্তিত্বকে তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণাটি এও বলে, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অঞ্চলগুলি লিভার ফাইব্রোসিসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ‘গ্রে ম্যাটার’-এর ‘ভলিউম’ কমিয়ে দিতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লিভার ফাইব্রোসিসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্যকর অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় কগনিটিভ ফাংশন কম এবং হিপোক্যাম্পাস, থ্যালামাস, স্ট্রিয়াটাম, ব্রেন স্টেম এবং সেরিবেলাম-সহ একাধিক মস্তিষ্কের অঞ্চলে ধূসর পদার্থের পরিমাণ হ্রাস পায়।

গবেষণার প্রধান লেখক এবং ইয়েলের একজন পোস্টডক্টরাল সহযোগী ডাঃ রোংতাও জিয়াং জানিয়েছেন, “উন্নত লিভার ফাইব্রোসিসযুক্ত ব্যক্তিদের জ্ঞানের কার্যকারিতা আরও খারাপ ছিল এবং গ্রে ম্যাটার অ্যাট্রোফি এবং সিরাম [সি-রিয়েকটিভ প্রোটিন] ‘লিভার-ব্রেন অ্যাসোসিয়েশন-এর মধ্যস্থতা করেছে।”

আরও পড়ুন:

লাইট সাউন্ড ক্যামেরা অ্যাকশন, পর্ব-৭: গোদারের ব্রেথলেস ও প্যারিসের শঁসেলিজে

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৬৭: কবিকন্যার সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের সম্পর্কের অবনতি ঘটলেও কবির সঙ্গে ঘটেনি

 

লিভারের যত্ন কি ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমাতে পারে?

ডাঃ জিয়াং উল্লেখ করেছেন, তাঁদের গবেষণার ফলাফল লিভারের স্বাস্থ্য এবং কগনিটভ ফাংশনের কার্যকারিতার মধ্যে সম্পর্ককে সমর্থন করে। তবে এই সিদ্ধান্তেও পৌঁছনো যায়নি যে, লিভারের স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করছে ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি কমার। এর জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে।

ডাঃ সৌরভ শেঠি একজন গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্ট এবং হেপাটোলজিস্ট। এ প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, “জটিল লিভার-মস্তিষ্কের অক্ষ এবং কীভাবে নির্দিষ্ট কারণগুলি যেমন খাদ্য, ব্যায়াম এবং অন্যান্য জীবনধারার কারণগুলি লিভার এবং মস্তিষ্ক উভয়কে প্রভাবিত করতে পারে তা সম্পূর্ণরূপে বোঝার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন। তবুও, এই গবেষণাটি মস্তিষ্ক-সম্পর্কিত পরিস্থিতিতে একটি সম্ভাব্য কারণ হিসাবে লিভারের স্বাস্থ্যকে বিবেচনা করার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। সামগ্রিকভাবে মস্তিষ্কের স্বাস্থ্যের জন্য যকৃতের স্বাস্থ্যের সুরক্ষার সুবিধাগুলির আরও অন্বেষণকে উত্সাহিত করে।” তাঁর মতে, সামগ্রিক সুস্থতার জন্য ডায়েট এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারার মাধ্যমে সুস্থ লিভার বজায় রাখা সম্ভব।

* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content