বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি: প্রতীকী। সংগৃহীত।

বিষণ্নতা একটি সাধারণ মানসিক স্বাস্থ্য ব্যাধি, যা এখন বিশ্বব্যাপী বহু মানুষকে প্রভাবিত করছে। যদিও মানসিক অবসাদের কার্যকর চিকিৎসা আছে। কিন্তু সেগুলি সবার জন্য সমান ভাবে কাজ করে না। এরকম ক্ষেত্রে উপসর্গগুলি উপশম করার চেষ্টা করা হয় মাত্র। এ জন্য খাদ্য তালিকায় এমন কিছু পরিপূরক খাবার রাখা যেতে পারে যেগুলি হতাশাগ্রস্থ লোকেদের জন্য উপকারী হতে পারে। এখন এই বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে।

বিষণ্নতা হল দুঃখ, শূন্যতা বা আনন্দ অনুভব করার অক্ষমতার একটি স্থায়ী অনুভূতি যা সাধারণত কোনও সুস্পষ্ট কারণ ছাড়াই ঘটে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-এর মতে, এটি আসলে নিয়মিত মেজাজ পরিবর্তনের থেকে আলাদা, এটি দীর্ঘ সময়ের জন্য স্থায়ী হয় এবং একজন ব্যক্তির স্বাভাবিক কাজকর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারে এমন একটি সমস্যা। হু-র বক্তব্য, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩.৮ শতাংশ মানুষ হতাশায় ভোগেন। পুরুষদের তুলনায় নারীদের মধ্যে অবসাদ বা বিষণ্ণতা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এখানেই শেষ নয়, ৬০ বছরের বেশি বয়সীদের মধ্যে হতাশা বা অবসাদে ভোগার ঝুঁকি বেশি।
 

অবসাদের চিকিৎসা

ওষুধ অথবা মনস্তাত্ত্বিক থেরাপির মাধ্যমে অবসাদের চিকিৎসা করা যেতে পারে। চিকিৎসার ধরন হতাশাজনক লক্ষণগুলির তীব্রতার উপর নির্ভর করে। দেখা গিয়েছে, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট ওষুধগুলি সাধারণত গুরুতর অবসাদের জন্য কার্যকর হয়। তারা নিউরোট্রান্সমিটারের (রাসায়নিক যা স্নায়ু কোষগুলিকে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম করে) ক্রিয়া পরিবর্তন করে কাজ করে। বিভিন্ন অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বিভিন্ন উপায়ে নিউরোট্রান্সমিটারকে প্রভাবিত করে।

আরও পড়ুন:

প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান: একাকিত্ব মহিলাদের নয়, পুরুষদের হাড়ের স্বাস্থ্যে বড়সড় প্রভাব ফেলে, বলছে বিজ্ঞানীদের গবেষণা

দশভুজা: আমি আর কখনওই ফিরে আসার প্রত্যাশা করি না…

 

পুষ্টিকর খাবারদাবার সমস্যার সমাধান করতে পারে কি?

সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ওষুধ খাওয়ার পরও প্রায় ৬৮ শতাংশ মানুষ প্রথম সারির অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট চিকিৎসায় প্রতিক্রিয়া জানাতে ব্যর্থ হয়। ১৫-৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে দুটি পরীক্ষার পরেও তেমন সাড়া দেয় না। তাহলে কি খাদ্যতালিকায় থাকা পরিপূরকগুলি যেমন, ভিটামিন, খনিজ বা প্রোবায়োটিকগুলি অবসাদ বা বিষণ্ণতার উপসর্গগুলি উপশম করতে বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টগুলির কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে? নানা গবেষণা থেকে বেশ কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, নির্দিষ্ট খাদ্যতালিকাগত সম্পূরকগুলি হতাশাজনক উপসর্গগুলি কমাতে উপকারী প্রভাব ফেলতে পারে।

লন্ডনের রিজেনারেটিভ ইনস্টিটিউটের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার, সেবনেম আনলুইসলার জানান, এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে, পরিপূরকগুলিকে অবসাদ বা বিষণ্নতার জন্য একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা হিসাবে বিবেচনা করা উচিত নয়। কারণ তাদের কার্যকারিতা মানুষের মধ্যে পরিবর্তিত হতে পারে। খাদ্যে থাকা বিভিন্ন পরিপূরক থেকে উপকারের প্রমাণ ব্যলক্তি বিশেষে ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়। কারও ক্ষেত্রে কোনও উপকার পাওয়া যায় না। আবার অন্যদের ক্ষেত্রে হয়তো দেখা গিয়েছে বিষণ্নতার চিকিৎসার উপকারী প্রভাব রয়েছে।

২০১৯ সালে একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ডি, জিঙ্ক এবং সেলেনিয়াম ধারণকারী পুষ্টিকর পরিপূরকগুলির দৈনিক গ্রহণ বিষণ্ণতার উপশমে তেমন ভূমিকা পালন করতে পারে না। তাদের পরামর্শ, অতিরিক্ত ওজন এবং স্থূলতাকায় লোকদের জন্য, ওজন হ্রাস এবং একটি স্বাস্থ্যকর ডায়েট অনুসরণ করা দরকার। যেমন ভূমধ্যসাগরীয় খাদ্য হতাশার লক্ষণগুলি প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে।

আরও পড়ুন:

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২: মেয়েটি যেন গৃহলক্ষ্মী

ইতিহাস কথা কও, কোচবিহারের রাজকাহিনি, পর্ব-১: রাজবাড়ির ইতিকথা—ইতিহাসের অন্তরে ইতিহাস

 

সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক অবসাদের সঙ্গে লড়াই করতে সক্ষম?

কিছু সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার অবসাদ বা বিষণ্ণতার অন্যাসন্যক চিকিৎসার সঙ্গে, যেমন মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি বা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট একসঙ্গে ব্যদবহার করে ফল পাওয়া গিয়েছে। ২০২২ সালের ৪১টি গবেষণার ডেটা-বিশ্লেষণের পরে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, ভিটামিন ডি হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের উপকার করতে পারে। যদিও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, সাধারণভাবে প্রতিদিন ৫০ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি ভিটামিন ডি বিষণ্নতা বা অবসাদের উপসর্গগুলি উপশম করতে বেশি কার্যকর, যা আসলে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি। আনলুইসলারেরে মতে, এক্ষেত্রে একটি সম্ভাব্য প্রক্রিয়া হিসেবে ভিটামিন ডি সেরোটোনিনের মতো নিউরোট্রান্সমিটারের উৎপাদন এবং নিয়ন্ত্রণকে প্রভাবিত করতে পারে, যা মেজাজ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। তিনি এও জানান, ভিটামিন ডি রিসেপ্টরগুলি হতাশার সঙ্গে যুক্ত মস্তিষ্কের অঞ্চলে উপস্থিত থাকে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ভিটামিন বি৬-এর উচ্চ মাত্রা বিষণ্ণতার উপর সামান্য উপকারী প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এই সব গবেষণাগুলি সবই খুব প্রাথমিক স্তরে এবং ছোট পরিসরে করা হয়েছিল।

একটি পরীক্ষায় এও দেখা যায়, আয়রনও হতাশাজনক লক্ষণগুলিকে প্রকাশ করতে পারে। এমনকি, অ্যানিমিয়া এবং হতাশার মধ্যে সংযোগ পরিলক্ষিত হয়। ২০১৬ সালের এক গবেষণায় আয়রনের অভাবজনিত রক্তাল্পতা এবং বিষণ্ণতার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক পাওয়া গিয়েছে। দেখা গিয়েছে, কম আয়রন ডোপামিন বিপাককে পরিবর্তন করে এবং সেরোটোনিনের মাত্রাকেও প্রভাবিত করতে পারে, যার ফলে উভয়ই মেজাজ পরিবর্তন হতে পারে। আয়রনের ঘাটতি সবসময় রক্তাল্পতার কারণ হয় না, তবে অবসাদ বা বিষণ্ণতা-সহ অন্যান্য উপসর্গের কারণও হতে পারে। তাই যাদের আয়রনের মাত্রা কম এবং বিষণ্ণতা প্রতিরোধে তাদের জন্য আয়রনের পরিপূরক উপকারী হতে পারে।

২০২৩ সালের জুনে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্র আরও প্রমাণ দেয় যে প্রোবায়োটিকগুলি হতাশার চিকিৎসায় সহায়তা করতে পারে। যদিও এটির একটি ছোট নমুনার আকার ছিল। এই ডাবল-ব্লাইন্ড পরীক্ষায় যারা অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন না তাদের মধ্যে প্রোবায়োটিক গ্রহণকারীদের লক্ষণগুলির একটি স্পষ্ট উন্নতি পাওয়া গিয়েছে। সেবনেম আনলুইসলারের মতে, প্রিবায়োটিক অন্ত্রের মাইক্রোবায়োটাকে সংশোধন করতে পারে, ফলস্বরূপ নিউরোট্রান্সমিটার এবং অন্যান্য সিগন্যালিং অণুগুলির উত্পাদনকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা এবং মেজাজকে প্রভাবিত করে। উপরন্তু, প্রিবায়োটিক এবং প্রোবায়োটিকের প্রদাহ-বিরোধী প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যের উপর তাদের সম্ভাব্য প্রভাবে অবদান রাখতে পারে।

আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-২৮: সাইনাস নাকি কখনওই সারে না?

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪২: আশা-ভরসার ‘শঙ্কর নারায়ণ ব্যাঙ্ক’

 

তাহলে কি অবসাদ বা বিষণ্ণতা এড়াতে পরিপূরক গ্রহণ করা উচিত?

কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে, পরিপূরকগুলি হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে কগনিটিভ হেলথ ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ড. টমাস ম্যাকলারেন সতর্ক করেছেন যে, বিষণ্ণতার জন্য পরিপূরক ব্যবহার নিয়ে এখনও গবেষণা চলছে। সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় এ নিয়ে মিশ্র ফলাফল পাওয়া গিয়েছে, নির্দিষ্ট পরিপূরকগুলির কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নির্ধারণের জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এমনকি, প্রাকৃতিক সম্পূরকগুলির নিরাপত্তার উদ্বেগ থাকতে পারে, বিশেষ করে যারা অন্যান্য ওষুধ গ্রহণ করেন তাদের জন্য। অন্যান্য সম্পূরকগুলি যা গবেষণায় কিছুটা সুবিধা দেখিয়েছে, সেগুলিও বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

ভিটামিন ডি এবং ভিটামিন বি৬ উচ্চ মাত্রায় বিষাক্ত হতে পারে। এমনকি, অতিরিক্ত আয়রন লিভারেরও ক্ষতি করতে পারে। সম্পূরকগুলি বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। কোনও কোনও সম্পূরক কিছু নির্দিষ্ট অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট বা অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে যোগ করতে পারে, তাদের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে বা বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে। তাই কোনও নতুন পরিপূরক শুরু করার আগে একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

* প্রসঙ্গ স্বাস্থ্য বিজ্ঞান (health-science): ড. দোলন দাস, (Dolan Das) শারীরবিদ্যার অধ্যাপিকা, কল্যাণী মহাবিদ্যালয়।

Skip to content