শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ছবি প্রতীকী

তীব্র দহন দিনে যাঁদের রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে কাজ করতে হয়, এই সময় তাঁদের একাধিক রকমের শারীরিক অসুস্থ দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল— হিট স্ট্রোক, হিট ক্র্যাম্প, হিট এক্সরশন এবং হিট সিঙ্কো৷ এই প্রতিবেদনে আমি এই চার ধরনের সমস্যা ও তার প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

হিট স্ট্রোক

এই প্রতিবেদনে আমরা জানব, হিট স্ট্রোক ঠিক কী এবং এই সময় হিট স্ট্রোক ছাড়া আর কী কী রোগ হতে পারে৷ হিট স্ট্রোক হল শরীরের ভেতরের এবং বাইরে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আমাদের শরীরের এক ধরনের বিশেষ ক্ষমতা আছে৷ যদি বাইরের তাপ খুব বেশি হয়ে যায় বা অনেকক্ষণ ধরে আমরা বাইরে রেদ্দুরে থাকি তাহলে আমাদের শরীর অনেক সময় তাঁর তাপ নিয়ন্ত্রক যে ব্যবস্থা আছে সেটি তার কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ ফলে আমাদের শরীর অতিরিক্ত গরম হয়ে তাপমাত্রা ১০৪ থেকে ১০৭ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে, যা শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর। এটিই হল হিট স্ট্রোক। হিট স্ট্রোকের ক্ষেত্রে ঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে মানুষের মৃত্যুও হতে পারে৷

হিট স্ট্রোক এড়াতে হলে চেষ্টা করবেন সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটের মধ্যে না বেরোতে৷ একান্ত বেরোতে হলে অতি অবশ্যই ছাতা ব্যবহার করবেন৷ অতি ঢিলেঢালা জামাকাপড় পরুন৷ সানগ্লাস ব্যবহার করতে পারেন৷ একটানা অনেকক্ষণ রোদের মধ্যে হাঁটবেন না, মাঝখানে একটু বিশ্রাম নিন৷ সব সময় ইলেকট্রলের বা ওআরএসের জল সঙ্গে রাখবেন৷ অল্প অল্প করে বারবার জল খাবেন৷ হঠাৎ করে যদি কেউ অজ্ঞান হয়ে যান, সঙ্গে অত্যধিক জ্বর থাকে তাহলে সময় নষ্ট না করে তাঁকে দ্রুত নিকটবর্তী কোনও হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। প্রথমে রোগীর জামাকাপড় খুলে দিয়ে ভিজে তোয়ালে দিয়ে ভালো করে জড়িয়ে দিতে হবে। স্ট্যান্ড ফ্যান থাকলে চালিয়ে দিতে হবে। সময়মতো হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা শুরু করলে হিট স্ট্রোক সম্পূর্ণভাবে সেরে যেতে পারে৷

যাঁদের একবার হিট স্ট্রোক হয়ে গেছে তাঁরা চেষ্টা করবেন গরমে রোদের মধ্যে না বেরোনোর৷ আর একটা কথা, বিশেষ করে বয়স্কদের বলব, বাইরে না বেরোলেও এ ধরনের সমস্যা হতে পারে৷ যেখানে উপযুক্ত পরিমাণে আলো-বাতাস প্রবেশ করে না এমন ঘরে ষাটোর্ধ্বদের না থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। তীব্র গরমের সময় এরকম ঘরে থাকলেও হিট স্ট্রোক হবার সম্ভাবনা থাকে৷ তাই গরমকালে একটু বড় ঘরে যেখানে হাওয়া বাতাস চলাচল করে বেশি এরকম ঘরে থাকতে হবে৷ এসি না থাকলেও সমস্যা নেই, সে ক্ষেত্রে চেষ্টা করবেন ঘরের জানলার পর্দাগুলো একটু ভিজিয়ে দিতে৷ এতে গরমকালে ঘরের তাপমাত্রা কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

হিট ক্র্যাম্প

গরমকালে অনেকেই হিট ক্র্যাম্প-এর সমস্যায় ভোগেন৷ হিট ক্র্যাম্প কী? অনেক সময় খুব বেশি হাঁটাচলা করলে পায়ের মাংসপেশিতে টান ধরে৷ কারও কারও ঘুম থেকে উঠতে গেলেও টান ধরে৷ বিশেষত রাতের দিকে হয়। আবার কিছু নির্দিষ্ট শরীরচর্চা, অনেকক্ষণ ধরে কাজকর্ম বা অনেকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলেও হিট ক্র্যাম্প হয়। এই সমস্যা সাধারণত গরমকালেই বেশি হয়৷ এটাকে হিট ক্র্যাম্প বলে৷ এই হিট ক্র্যাম্পকে প্রতিরোধ করতে গেলে আমাদের গরমকালে নিয়মিত সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড যুক্ত ওআরএস খেতে হবে৷ ওআরএস বা ইলেকট্রল পাউডার ২১ গ্রামের প্যাকেট পাওয়া যায় সেটা এক লিটার জলে গুলে অল্প অল্প করে বারবার খেতে হবে৷ বিশেষত যাঁরা রোদ্দুরে কাজ করেন বা দীর্ঘ সময় বাড়ির বাইরে থাকেন তাঁদের সারাদিনে দু’ থেকে তিন প্যাকেট অর্থাৎ দৈনিক দু’ থেকে তিন লিটার ওআরএস খাওয়াটা বাঞ্ছনীয়৷ পাশাপাশি, কারও হিট ক্র্যাম্প হওয়ার প্রবণতা থাকলে তাঁর একটানা অনেকক্ষণ রোদ্দুরের মধ্যে কাজ করা চলবে না৷ অর্থাৎ আপনাদের মাংসপেশিকে একটু বিশ্রাম দিতে হবে, যাতে মাংসপেশিগুলো তার নিজস্ব কর্মক্ষমতা ফিরে পায়৷

হিট এক্সরশন

হিট এক্সরশন-এর সমস্যা হলে আমাদের অবসন্ন লাগে৷ কাজকর্ম করতে ইচ্ছে করে না৷ বিশেষত গরমের সময় দেখা যায় হিট এক্সরশন৷ এতে মাথা ঘুরতে পারে। অনেক সময় শরীরও দুর্বল হয়ে যায়। কারও কারও ব্লাড প্রেশার কমে যাবার সম্ভাবনা থাকে। বমি বমি ভাব হতে পারে৷ এক্ষেত্রেও চিকিৎসার পদ্ধতি একই৷ সারাদিনে বারবার অল্প অল্প করে ইলেকট্রল বা ওআরএস খেতে হবে৷ কী ধরনের ইলেকট্রল বা ওআরএস খাওয়া যেতে পারে বুঝতে না পারলে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। কারণ, এ সময় না বুঝে গ্লুকোজের জল খেলে হিতে বিপরীত হতে পারে৷ অর্থাৎ কোনও কাজই করবে না, উলটে সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে৷ এই হিটজনিত রোগের প্রতিরোধ বা চিকিৎসাই হল ওআরএস বা ইলেকট্রলের জল বেশি করে খেতে হবে৷ এমনি জলও বেশি করে খেতে হবে৷ বিশেষ কোনও শারীরিক সমস্যা না থাকলে রোজ চার থেকে পাঁচ লিটার জল খাওয়া বাঞ্ছনীয়৷ যাঁরা বাইরে কাজ করছেন তাঁদের এই জলের মধ্যে অনেকেই ইলেকট্রল জলের মাধ্যমে পূরণ করতে হবে৷

হিট সিঙ্কো

এই রোগের উপসর্গ হল, গরমকালে অনেক সময় ব্লাড প্রেশার কমে যেতে পারে। শরীর অবসন্ন লাগে৷ শরীর দুর্বল লাগতে পারে৷ হঠাৎ করে সাময়িক বা তাৎক্ষণিকভাবে ব্লাড প্রেশার কমে গেলে অনেক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন কেউ কেউ৷ হিট সিঙ্কো সাধারণত কাদের হয়? দশ বছর বয়সের কম, আর ষাট বছর বয়সের বেশি অর্থাৎ সিনিয়র সিটিজেন এবং যাঁদের অনেকক্ষণ ধরে রোদ্দুরে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই এবং হঠাৎ করে এই গরমের মধ্যে বেরোলে হিট শিঙ্কো তাঁদের হতে পারে৷ ব্লাড প্রেশার কমে গিয়ে শরীর অবসন্ন লাগতে পারে এবং তার থেকে অজ্ঞান হয়ে যেতে পারেন৷ হিট সিঙ্কো যাতে না হয় সেজন্যে আমরা বলি, একান্তই দরকার না থাকে সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটের মধ্যে বাইরে বেরোবেন না। বেরোতে হলেও সুতির ঢিলেঢালা সাদা হালকা পোশাক পরুন৷ সঙ্গে ছাতা রাখুন। একটানা অনেকক্ষণ কোথাও দাঁড়িয়ে থাকবেন না৷ দরকার হলে কিছুটা সময় কোথাও বিশ্রাম নিন৷ পাশাপাশি এক্ষেত্রেও ওআরএস বা ইলেকট্রলের জল খেতে হবে৷ তবেই আমরা হিট শিঙ্কো এড়িয়ে যেতে পারব৷ কেউ হিট শিঙ্কোতে অজ্ঞান হয়ে গেলে তাৎক্ষণিক আলো-বাতাস চলাচল করে এরকম একটা তুলনায় ঠান্ডা ঘরে রোগীকে শুইয়ে দিতে হবে৷ এসি না থাকলেও অসুবিধা নেই, একটি পাখা থাকলেই চলবে। শোয়ানো অবস্থায় কখনও জল খাওয়ানো চলবে না৷ জামাকাপড় খুলে দিয়ে একটা তোয়ালে ভিজিয়ে ভালো করে গায়ে জড়িয়ে দিন৷ এতে আস্তে আস্তে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

তীব্র দহন দিনে গরমজনিত বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা থেকে বাঁচতে এই বিষয়গুলি অবশ্যই আমাদের মাথায় রাখতে হবে৷

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

যোগাযোগ: ৯৮৩১৬৭১৫২৫


Skip to content