রবিবার ১০ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি।

‘সপ্তমীতে বিসর্জন’ এবং ‘বড়দিনের বখশিসের’ অভাবনীয় সাফল্যের পর গিরিশচন্দ্র ঘোষ মিনার্ভা থিয়েটার জন্য আরও একাধিক পঞ্চরং লিখেছিলেন। তার মধ্যে একটি হল ‘সভ্যতার পান্ডা’। এটি প্রথম অভিনীত হয় ১৮৯৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। প্রথম দিনের অভিনয়ে যাঁরা অংশ নিয়েছেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পুরাতন বর্ষের চরিত্রে গোবর্ধন বন্দ্যোপাধ্যায়, নতুন বর্ষের চরিত্রে শরৎচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলকান্তের চরিত্রে অঘোরনাথ পাঠক, সৃষ্টি ধরের চরিত্রে দানি বাবু (গিরিশ ঘোষের পুত্র ),সভ্যতার চরিত্রে তিন কড়িদাসী, ভবতারিণীর চরিত্রে জগত্তারিণী, বিশ্বেশ্বরীর চরিত্রে গুলফাম হরি, কুমুদিনীর চরিত্রে হরি সুন্দরী প্রমুখ।
‘সভ্যতার পান্ডা’ হল একটি রূপক পঞ্চরং। এর আগেও যে সব পঞ্চরং গিরিশচন্দ্র লিখেছিলেন, তেমনি এতেও সামাজিক শ্লেষাত্মক নব্য সভ্যতার ছবি ফুটে উঠেছে। এই সকল বিদ্রুপাত্মক রচনার মধ্যে দিয়ে জাতীয় ধর্ম, আচার অনুষ্ঠান এবং প্রাচীন সভ্যতার উপরে গিরিশচন্দ্রের প্রগাঢ় ভক্তি ও অনুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ সভ্যতা চরিত্রের গান খানি উদ্ধৃত করা গেল—
“আমার মুখে হাসি চোখে ফাঁসি ভুবন মোহিনী মাদকতা প্রবঞ্চনা চিরসঙ্গিনী।
অনাচার-আমার কণ্ঠ হার,
দাসী হ’য়ে চরণ সেবা করে ব্যভিচার,
আমি মধুমাখা কথা কয়ে আগে ভোলাই কামিনী।”
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩৮: সগৌরবে মিনার্ভা থিয়েটারে অভিনীত হয়েছিল গিরিশচন্দ্রের পঞ্চরং ‘বড়দিনের বখশিস’

এই দেশ এই মাটি, সুন্দরবনের বারোমাস্যা, পর্ব-২: চলমান সুন্দরবন

বর্তমান সমাজে হিন্দুর এই প্রাচীন সভ্যতা, নিষ্ঠা, আচার প্রবৃত্তি কেমন ভাবে পশুভাবে একাধিপত্য করছে এই প্রহসনে তা পশুশালার দৃশ্যে উজ্জ্বলভাবে এঁকেছিলেন গিরিশচন্দ্র। সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করুক বা না করুক, জাতীয় যুগ কবি প্রতিভার উদ্দীপনার সময়ে এমন চিত্র অঙ্কিত করে থাকেন। পাশ্চাত্য সভ্যজাতির ইতিহাসেও তার নিদর্শন পাওয়া যায়। সেই সময়ের গতি, মতি, প্রকৃতি, প্রভৃতি নির্ণয় ভবিষ্যৎ ঐতিহাসিকগণকে এই নাটক অবশ্যই সহায়তা করবে। এই জন্য জাতীয় রঙ্গমঞ্চ যুগ ধর্মের দর্পণ বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন:

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৪০: সে এক স্বর্গপুরীর ‘চিরকুমার সভা’

ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-৫: আমার পায়ে ঝিঁ ঝিঁ, আমি জ্ঞান হারিয়েছি

মিনার্ভা থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র ঘোষের শেষ পঞ্চরং হল ‘পাঁচকণে’ এটি প্রথম অভিনীত হয় ১৮৯৬ সালের ৫ জানুয়ারি। প্রথম রাত্রে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন কালাচাঁদের চরিত্রে অক্ষয় কুমার চক্রবর্তী, অমূল্যের চরিত্রে দানিবাবু (গিরিশ ঘোষের পুত্র)। সত্যের চরিত্রে তিনকড়ি দাসী, ক্রেতার চরিত্রে ভূষণ কুমারী, দ্বাপরের চরিত্রে ব্লাক হরি, কলির চরিত্রে কুসুমকুমারী। বনবিহারিনীর চরিত্রে হেমন্ত কুমারী, মাতঙ্গিনীর চরিত্রে জগত্তারিণী, গিন্নি চরিত্রে গুণফার্ম করি। বালিকার চরিত্রে পানি।
আরও পড়ুন:

রহস্য উপন্যাস: পিশাচ পাহাড়ের আতঙ্ক, পর্ব-২০: জীবন্ত লাশ?

চেনা দেশ অচেনা পথ, পর্ব-১৪: কাওয়ার্ধা পরিভ্রমণ

এটি একটি রসাত্মক সামাজিক পঞ্চরং। ‘সভ্যতার পান্ডা’ এ জাতীয় প্রহসন। সত্য ত্রেতা দ্বাপর কলিযুগের চারখানা রসাত্মক গান এই নাটকে বিশেষ আকর্ষণই। উড়েনি, কাটকুড়ানি, বাঙালিনী ও ভিখারিনী বালিকার গান গুলো বড়ই বৈচিত্রময় ছিল।
এই চারটি পঞ্চ রঙং এর মধ্য দিয়ে গিরিশচন্দ্র ঘোষ পঞ্চরঙ্গের মূল আদর্শটি কী হতে পারে তার একটা রূপরেখা তুলে ধরেছিলেন। সেই কারণে তিনি এই ধরনের নাটক লেখার ক্ষেত্রে যে পথিকৃৎ, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content