গিরিশচন্দ্র।
স্টার থিয়েটারে ফিরে এসে গিরিশচন্দ্র ম্যানেজারের পদটি গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তখন তাঁর নাম ঘোষণা করা হল নাট্যাচার্য হিসেবে (ড্রামাটিক ডিরেক্টর)। এই উপাধি বঙ্গ নাট্যশালায় প্রথম প্রচলিত হয়। স্টার থিয়েটারে ‘কালাপাহাড়’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় ১৮৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। প্রথম দিনের অভিনয় যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অমৃতলাল মিত্র (কালাপাহাড়), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (চিন্তামণি), অক্ষয় কালী (মুকুন্দ দেব), উপেন্দ্রনাথ মিত্র (বীরেশ্বর), সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (লাটু), সুরেন্দ্রনাথ মিত্র (সলিমন), প্রমদা সুন্দরী (চঞ্চলা), নগেন্দ্র বালা (ইমন), নরী সুন্দরী (দোলনা), গঙ্গাবাঈ (মুরলার ছায়া মূর্তি) প্রমুখ।
বাংলার নবাব সালমানের সেনাপতিত্ব গ্রহণ করে কালাপাহাড় ওড়িশাধিপতি মুকুন্দ দেবকে সিংহাসন চ্যূত করলেন এবং জগন্নাথ দেবের মূর্তি দগ্ধ করেন। এই ঐতিহাসিক সত্যটুকু কালাপাহাড় নাটকে থাকলেও এ নাটককে ঠিক ঐতিহাসিক নাটক বলা যায় না। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের অপূর্ব গুরু ভাব প্রকাশই এই নাটকের প্রধান উপাদান। পাঠকরা সকলেই জানেন প্রথমে গিরিশচন্দ্র নাস্তিক ছিলেন।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৪২: ফণীর মণির গীতি নৃত্যনাট্য ক্লাসিক থিয়েটারেও উচ্চ প্রশংসার সঙ্গে অভিনীত হয়েছিল
রিভিউ: নতুন থ্রিলার সিরিজ ‘সাড়ে ষোলো’—সিজন-১ ষোলো কলা পূর্ণ করেছে
মানুষকে গুরু বলতে গিরিশচন্দ্র কখনওই বিশ্বাস করতেন না। কিন্তু শেষে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপায় তিনি নবজীবন লাভ করেন। এই নাটকে বর্ণিত চিন্তামণি চরিত্রটি পরমহংসদেবের চরিত্রের ছায়ামাত্র অবলম্বন করে গঠিত হয়েছে। এই ভূমিকায় গিরিশচন্দ্র অভিনয় করতেন। গিরিশচন্দ্রের প্রথম ধর্মজীবনে যে হৃদয় দ্বন্দ্ব সূচিত হয়েছিল কালাপাহাড় চরিত্রে তার আভাস পাওয়া যায়। এই চরিত্র শ্রীরামকৃষ্ণের প্রভাবে অনুকল্পিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
ক্যাবলাদের ছোটবেলা, পর্ব-১৩: ধরবো ধরবো করছি কিন্তু…
মন্দিরময় উত্তরবঙ্গ, পর্ব-৩: কোচ কামতেশ্বরী মন্দিরের স্থাপত্য এক অনন্যসাধারণ মিশ্রশৈলীর উদাহরণ
প্রেম ও ঈর্ষার অপূর্ব সংঘর্ষে এই নাটকের গল্প এবং চরিত্র নিপুণভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে চঞ্চলা চরিত্রই এর ভিত্তি এবং এই দুটি পরস্পর বিরোধী ভাব সে তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। চঞ্চলা ও ইমন চরিত্র দুটি পাশাপাশি অঙ্কিত করে গিরিশ চন্দ্র স্বার্থ মুলক এবং নিঃস্বার্থ প্রেমের সজীব ছবি অঙ্কন করেছেন। বীরেশ্বর গিরিশচন্দ্রের আরেকটি অপূর্ব সৃষ্টি। ভগবানের কাছে কেউ শক্তি কেউ বা মুক্তি চায় এবং সেই শক্তি লাভ করে সবাই তার অপব্যবহার করে। বীরেশ্বর তাই করেছিলেন। পরিণামে পত্নীর অলৌকিক ভালোবাসায় তিনি উদ্ধার পেয়েছিলেন।
আরও পড়ুন:
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৮: নহবতে সহধর্মিণী সারদা
এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৩৪: গলায় মাছের কাঁটা ফুটলে ওষুধ খেলে গলে যায়?
এই নাটকে আরেকটি সুন্দর ভাব অঙ্কিত হয়েছে তা হল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ধর্মানুরাগ এবং ঈশ্বর প্রেম। ঠাকুর কথিত সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের এটি আভাস মাত্র বলা যায়। ‘কালা পাহাড়’ নাটকটি দেখে সুপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার মশাই গিরিশচন্দ্রকে বলেছিলেন “তোমার চরিত্র সৃষ্টি সব শেক্সপিয়ারের মতো, আশীর্বাদ করি তুমি চিরজীবী হও”। সহৃদয় ব্যক্তির আন্তরিক আশীর্বাদ বাণী কখনোই বিফলে যায়নি। কালাপাহাড় নাটকটি জাতীয় সাহিত্যে গিরিশচন্দ্রকে চিরজীবী করে রাখতে পেরেছিল।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।