শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব।

গিরিশচন্দ্র ঘোষ বঙ্গ সমাজে প্রধানত মহাকবি, নাট্যকার ও নট বলেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ সঙ্ঘে তিনি ভক্তি ও ঠাকুরের অহৈতুকী কৃপার অপূর্ব নিদর্শন। রামকৃষ্ণকে অবলম্বন করে গিরিশজীবন যেমন মহিমামণ্ডিত হয়েছিল, গিরিশচন্দ্রকে অবলম্বন করে শ্রীরামকৃষ্ণেরও তেমনি জীবকল্যাণে অপূর্ব স্ফূর্তিলাভ হয়েছিল।

সাহিত্যক্ষেত্রে গিরিশচন্দ্র তখন পৌরাণিক নাটক রচনায় লিপ্ত। একটি পর একটি নাটকে সাফল্য লাভের পর ১৮৮৪ সালের আগস্ট মাসের এক শুভ মুহূর্তে তাঁর ‘চৈতন্যলীলা’ অভিনীত হয়ে নবীন বঙ্গকে পুরাতনের অবিস্মরণীয় আস্বাদ প্রদান পূর্বক তাকে প্রকৃতিস্থ করেছিল। এই নাটক অযাচিতভাবে গিরিশচন্দ্রের কাছাকাছি নিয়ে এল রামকৃষ্ণদেবকে।
এই নাটকের সুখ্যাতি শুনে ১৮৮৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ভক্তগণসহ ঠাকুর এলেন এই নাটক দেখতে। সংবাদ পেয়ে গিরিশবাবু অভ্যর্থনার জন্য অগ্রসর হলে ঠাকুর তাঁকে দেখতে পেয়ে প্রথম নমস্কার করলেন।

গিরিশ প্রতি নমস্কার করলে ঠাকুর আবার নমস্কার করলেন। এভাবে কয়েকবার চললে, গিরিশ দেখলেন ঠাকুরের ভাগে একটি নমস্কার অধিক থেকে যাচ্ছে। গিরিশচন্দ্র পরে বলেছিলেন, “রাম অবতারে ধনুর্বান নিয়ে জগৎ জয় হয়েছিল, কৃষ্ণ অবতারে জয় হয়েছিল বংশীধ্বনিতে, রামকৃষ্ণ অবতারে জয় হবে প্রণাম অস্ত্রে। “তিনি প্রণাম মন্ত্রে পরাজিত হয়ে মনে মনে শেষ নমস্কার জানালেন। ঠাকুরকে নিয়ে গিয়ে উপরে বসালেন এই নাটক দেখাতে।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব ২৯: ‘অভিমন্যুবধ’ নাটকের জন্য সুখ্যাতি হয়েছিল গিরিশচন্দ্রের

পর্দার আড়ালে, পর্ব-২৬: উত্তম কাছে এসে বললেন, “তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি সাবু, এ বার আমায় মাফ করে দে”

উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৩: মোর সাধের বাসরে ঘটল ‘গৃহ প্রবেশ’

এটি অবশ্য গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে ঠাকুরের প্রথম দর্শন নয়, প্রথম দর্শন হয়েছিল বসু পাড়ায় দীননাথ বসুর বাড়িতে। ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকাতে দক্ষিণেশ্বরের পরমহংসদেবের কথা পড়েছিলেন। এই পত্রিকা পড়ে তাঁর মনে হল, “ব্রাহ্মরা কী আবার এক পরমহংস খাঁড়া করিয়াছে?” যা হোক তিনি এসেছেন শুনে গিরিশচন্দ্র গেলেন এবং সন্ধ্যা যখন হচ্ছে তখন একজন এসে প্রদীপ জ্বেলে রামকৃষ্ণের সামনে রাখলে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ”সন্ধ্যা হয়েছে?” এ কথা শুনে গিরিশচন্দ্র ভাবলেন “ঢং দেখো। সম্মুখে সেজ জ্বলছে তবু ইনি বুঝতে পারছেন না যে সন্ধ্যা হয়েছে কি হয়নি?”

দ্বিতীয় দর্শন বলরাম বসুর বাড়িতে। সেখানে নিমন্ত্রিত হয়ে গিরিশচন্দ্র গিয়েছেন। ধারণা ছিল যোগী ও পরমহংসেরা কারও সঙ্গে কথা বলেন না এবং কাউকে নমস্কার করেন না। তবে কেউ সাধ্য সাধনা করলে পদ সেবা করতে দেন। কিন্তু এই পরমহংস ঠিক এর বিপরীত। তিনি সাগ্রহে বন্ধু ভাবে কথা বলেন। আবার দীনভাবে ভূমি স্পর্শ করে প্রণাম করেন।

তৃতীয় দর্শন নাটক দেখার দিন। চতুর্থ দর্শনটি অভিনব। তিনি রকে বসে আছেন। সেই সময়ে বলরাম মন্দিরে যাচ্ছিলেন ঠাকুর। দুজনের মধ্যে চোখ চাওয়াচাওয়ি হয়েছে। গিরিশচন্দ্র নমস্কার করলেন। জনৈক ভক্ত গিরিশচন্দ্রকে জানালেন, “পরমহংসদেব ডাকছেন”। তিনি ঢুকতেই রামকৃষ্ণ গিরিশকে বললেন, “বাবু আমি ভালো আছি। বাবু আমি ভালো আছি। না না, ঢং নয়, ঢং নয়।” অবাক হয়ে গেলেন গিরিশচন্দ্র। তারপরে গিরিশচন্দ্র আলাপ শুরু করলেন। ঠাকুর বললেন, “গুরু কি জানো? যেমন ঘটক। তোমার গুরু হয়ে গিয়েছে। মন্ত্র কী? মন্ত্র হল ঈশ্বরের নাম।” আরও কিছু কথাবার্তার পর গিরিশচন্দ্র অনুভব করলেন, যেন তাঁর দম্ভের বাধ ভেঙে পড়েছে। অবশেষে একদিন এই দেবমানবের কাছেই তাঁর মস্তক নামাতেই হবে।
আরও পড়ুন:

গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি. পর্ব-৫১: বিয়েশাদির ঠাকুরবাড়ি

রহস্য রোমাঞ্চের আলাস্কা, পর্ব-৬: বাড়িতে ঢুকে জুতো মজা দস্তানা খুলে প্রথমেই দেখলাম ‘ফ্রস্টবাইট’ হয়ে গিয়েছে কিনা!

বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৫: বলবয় থেকে বিশ্বসেরা

পঞ্চম দর্শনকালেও সেই ভগ্ন দম্ভের কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। ঠাকুর নাটক দেখতে এসেছেন। গিরিশচন্দ্র বললেন, “ভালো বক্সে লইয়া গিয়া বসান”। দেবেন মজুমদার যখন বললেন, “আপনি অভ্যর্থনা করে নিয়ে আসবেন না?” তখন গিরিশচন্দ্র বললেন, “আমি না গেলে তিনি আর গাড়ি থেকে নামতে পারবেন না?” কিন্তু গেলেন ঠিকই। সেদিন সামনে দাঁড়িয়ে ঠাকুরের ওই মুখ দর্শন করে তাঁর পাষাণ হৃদয়ও গলে গেল। ঠাকুর বলেছিলেন, “তোমার মনে বাঁক আছে।” ইনি মনের ভাব বুঝতে পেরেছেন দেখে অবাক হয়ে গিরিশ জিজ্ঞাসা করলেন, “বাঁক যায় কিসে?” ঠাকুর বললেন, “বিশ্বাসে”। ষষ্ঠ দর্শন হল মধুর রায়ের গলিতে শ্রীরামচন্দ্র দত্তের বাড়িতে। সেদিন গিরিশবাবু একটা চিরকুট পেলেন পরহংসদেব আসছেন। তিনি গেলেন এবং দেখলেন যে গান গাইতে গাইতে ঠাকুর সমাধিস্থ হয়ে যাচ্ছেন। কীর্তনের শেষে গিরিশচন্দ্র ঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার মনের বাঁক যাবে তো?” ঠাকুর বললেন, “যাবে ঠিক যাবে”।
আরও পড়ুন:

ডায়াবেটিস থাকবে দূরে, জেনে নিন কোন ফল কতটা পরিমাণে খাবেন, আর কোনটা খেতে হবে সাবধানে, দেখুন ভিডিয়ো

ত্বকের পরিচর্যায়: অবাঞ্ছিত চুল নিয়ে বিব্রত? সমস্যার সমধানে এই বিষয়গুলি মেনে চলছেন তো?

অনন্ত এক পথ পরিক্রমা, পর্ব-৭: ঈশ্বরের ভালোবাসার সমুদ্রে ডুব দিলে তবেই ভক্তিরূপ মুক্তো খুঁজে পাওয়া সম্ভব

একদিন ঠাকুর অভিনয় দেখতে গেলে অপ্রকৃতস্হ গিরিশচন্দ্র বললেন, “তুমি আমার ছেলে হবে বল।” ঠাকুর জানালেন যে, তাঁর বাবা ছিলেন শুদ্ধসত্ত্ব ব্রাহ্মণ। তিনি কেন গিরিশের ছেলে হতে যাবেন। গিরিশচন্দ্র ক্রুদ্ধ হয়ে অনেক গালাগালি করলেন। পরের দিন দক্ষিণেশ্বরে রামচন্দ্র দত্ত আসার পর ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, “রাম তুমি কি বলো?” রামবাবু উত্তর দিলেন, দেখুন “কালীয় সাপ যেমন শ্রীকৃষ্ণকে বলেছিল প্রভু আমায় বিষ দিয়েছেন আমি অমৃত পাবো কোথায়? গিরিশবাবুরও সেই দশা। তিনি অমৃত পাবেন কোথায়?” রামবাবুর কথা শুনে ঠাকুর বললেন, “তবে চলো রাম, তোমার গাড়িতে একবার সেখানে যাই।”

গিরিশচন্দ্র নিজেকে অপরাধী মনে করে আহার ত্যাগ করেছেন। ঠাকুরকে দেখে তাঁর পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়লেন। বললেন, “আজ যদি তুমি না আসতে ঠাকুর, তাহলে বুঝতাম তুমি এখনও নিন্দাস্তুতিকে সমান জ্ঞান করতে পারোনি। তোমার পরমহংস নামে অধিকার আসেনি। আজ বুঝেছি তুমি সেই, তুমি সেই। আর আমায় ফাঁকি দিতে পারবে না। এবার আমি আর তোমায় ছাড়ছি না। বলো তুমি আমার ভার নেবে? আমায় উদ্ধার করবে।” কয়েকবার যাতায়াতের পর গিরিশচন্দ্র ঠাকুরকে আত্মসমর্পণ করে বসলেন। বললেন, “এখন থেকে আমি কি করবো?” ঠাকুর উত্তর দিলেন, “যা করছো তাই করে যাও। এদিক-ওদিক দুদিক রেখেই চলো। তবে সকাল বিকাল তার স্মরণ মননটা চাই।” গিরিশ এসব কিছুই পারবেন না শুনে ঠাকুর তাঁর বকলমা নিলেন।

নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ।

কাশীপুরে ১৮৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি কল্পতরু উৎসবের দিন ঠাকুর গিরিশকে দেখে বলেছিলেন, “গিরিশ তুমি যে সকলকে এত কথা অবতারত্ব সম্বন্ধে বলে বেড়াও তুমি কি দেখেছো বুঝেছো?” তখন গিরিশ কিছু মাত্র না ভেবে বললেন, “ব্যাস বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর সম্বন্ধে অধিক আর কী বলতে পারি?”

সেই ঠাকুরের তিথিপুজো আগামী মঙ্গলবার ২১ ফেব্রুয়ারি আর গিরিশচন্দ্রের জন্মদিন পরবর্তী মঙ্গলবার ২৮ ফেব্রুয়ারি। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের চরণে রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। সশ্রদ্ধ প্রণাম রইল গিরিশচন্দ্র ঘোষেরও চরণে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content