শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


ভক্তি রসাত্মক পৌরাণিক নাটক লেখার ক্ষেত্রে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী৷ স্টার থিয়েটারে তৃতীয় নাটকটি ছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা এবং তাঁর নির্দেশনায় ‘নল দময়ন্তী’ যেটি প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৮৮৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর শনিবার। প্রথম দিনের অভিনয়ে যে সব শিল্পী অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন; নলের ভূমিকায় অমৃতলাল মিত্র। বিদূষকের চরিত্রে অমৃতলাল বসু। দময়ন্তীর চরিত্রে বিনোদিনী। রাজমাতার চরিত্রে গঙ্গামণি। সুনন্দার চরিত্রে ভূষণকুমারী। রানির চরিত্র ক্ষেত্রমণি প্রমুখ।

‘নল দময়ন্তী’ নাটকের সুরকার এবং সংগীত শিক্ষক ছিলেন সংগীতাচার্য বেণীমাধব অধিকারী ওরফে বেনি ওস্তাদ। নৃত্যপরিচালক ছিলেন কাশীনাথ চট্টোপাধ্যায়। যদিও এই নাটকে গানের সংখ্যা পূর্ববর্তী অন্যান্য পৌরাণিক নাটকের তুলনায় অনেক কম। মাত্র ন’টি গান রয়েছে এই নাটকে। তথাপি বিভিন্ন তালে সুগঠিত করে বেনি ওস্তাদ অভূতপূর্ব সূচনা করেছিলেন, যা দর্শক সমাজে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছিল। গানগুলির মধ্যে রয়েছে ‘প্রাণ না সখা’, ‘আমি কি জানি’, ‘বল কোন গগনের ছিল রে এই দুটি চাঁদ’, ‘কুহুতানে আকুল করে প্রাণ’, ‘বলে ফুল দোলে দোলে।’ নটি গানের মধ্যে আটটি গানই সমবেত সংগীত। শুধু একটিমাত্র গান একক কণ্ঠে গাওয়া হয়েছে। ওই গানটি গেয়েছেন রাজকন্যা সুনন্দার রূপসজ্জায় সেকালের বিখ্যাত গায়িকা ও অভিনেত্রী ভূষণকুমারী। একদিকে বেনি ওস্তাদের অসামান্য শুরু সৃষ্টি অন্যদিকে কাশীনাথের পরিশীলিত নৃত্যকলা এই নাটকটির অভিনয়কে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় করে তুলেছিল বলাবাহুল্য।

নল দময়ন্তী নাটকের অসামান্য মঞ্চ সাফল্য ও বিপুল জনপ্রিয়তার মূলে স্টেজ ম্যানেজার জহরলাল ধরের বৈজ্ঞানিক শিল্প প্রয়োগ কৌশলের অবদান অনেকটাই ছিল। নাট্যাচার্য গিরিশচন্দ্র শিল্প প্রবর্তনে তাঁর নিত্যনতুন অভিনব প্রয়াসের কথা ভেবে দুটি মারাত্মক দৃশ্য পরিকল্পনা করেছিলেন এই নল দময়ন্তী নাটকটিতে। প্রথমটি হল প্রকাশ্যে রঙ্গমঞ্চে পদ্মকোরকগুলি ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার ভেতর থেকে দেববালা গানের আবির্ভাব। আর দ্বিতীয়টি হল; মহারাজা নলের বস্ত্র নিয়ে পাখির আকাশপথে উড়ে যাওয়া ও প্রস্থান। বিভিন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে মঞ্চ বিভ্রম ঘটিয়ে জহরলাল দৃশ্য দুটি সৃষ্টিতে সেকালের বঙ্গ রঙ্গমঞ্চে অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এই দৃশ্য দুটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়েছিল এবং দর্শক সমাজের অসম্ভব প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত অভিনেত্রী নটিবিনোদিনী তাঁর জীবন কথায় বলছেন, ‘স্টার থিয়েটারে নলদময়ন্তী অভিনীত হচ্ছে। তাতে একটি দৃশ্য ছিল সরোবরে পদ্ম ফুটে রয়েছে। মধ্যস্থলে পদ্ম। সবচেয়ে বড় পদ্মের মধ্য থেকে একজন দেববালা বের হয়ে তিনি পা বাড়িয়ে আরেকটি কম্পমান পদ্মে গিয়ে দাঁড়াতেন। এমনভাবে দেববালাগণ আসছেন সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের গান গাইতে হত। সরোবরের এই দৃশ্যটি দেখতে ভারী সুন্দর হত। জহর ধর মহাশয় সত্যিকারের একজন কলাবিদ ছিলেন।’

স্টার থিয়েটারে ‘নল দময়ন্তী’ নাটকের মঞ্চ সাফল্যের মূলে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অবদান অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি চরিত্রে সকলেই নিজ নিজ ভূমিকা নিজেদের অভিনয়-নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছিলেন। অমৃতলাল বিনোদিনী বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে। সমগ্র অভিনয় জীবনে অমৃতলাল মিত্র তাঁর অমৃতোপম কণ্ঠস্বরের জন্য প্রসিদ্ধ। গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটকের গিরিশচন্দ্র লেখা সংলাপগুলি তাঁর কণ্ঠস্বর আবৃত্তির মাধ্যমে গভীর ব্যঞ্জনাময় রসসমৃদ্ধ হয়ে উঠত। স্টার থিয়েটারেই ‘নল দময়ন্তী’ নাটকে বিনোদিনীর অভিনয় প্রতিভায় ভাস্বর হয়ে আছে। সর্বত্রই তিনি তাঁর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। নায়িকা দময়ন্তীর আভিজাত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, রাজ্যচ্যুত স্বামীহারা হয়ে অপরিমেয় দুঃখের বেদনা তাঁর অভিনয় মূর্ত হয়ে উঠেছিল।

গিরিশচন্দ্র সংস্কৃত নাট্যসাহিত্যের অনুকরণে তাঁর পৌরাণিক নাটকগুলিতে বিদূষক চরিত্রের সৃষ্টি করেছেন। সংস্কৃত নাটকের বিদূষক অপরিসীম লোভী, রাজার গোপন প্রেমের সহায়ক। সর্বদাই চিত্তবিনোদনের তৎপর। নাট্যকার যখন বিদূষক চরিত্র নাটকে প্রথম আনলেন তখন সংস্কৃত আদর্শকে পুরোপুরি গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি প্রাচীন গতানুগতিকতা থেকে সরে এসে নতুনত্ব সৃষ্টিতে প্রয়াসী হয়েছেন। রসরাজ অমৃতলাল বসুর বিদূষকের ভূমিকায়। তিনি হাস্যরসাত্মক অভিনেতা। চাতুর্যপূর্ণ চরিত্র সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তিনি তাঁর সেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। গিরিশচন্দ্রের নাট্য সৃষ্টির জগতে তাঁর এই পৌরাণিক নাটক ‘নল দময়ন্তী’ স্থান অনেকটাই উঁচুতে। তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই নাটকটির জন্য।

ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে।

Skip to content