মিনার্ভা থিয়েটারে ‘বলিদান’ নাটকের মঞ্চ সাফল্যের পর গিরিশচন্দ্র ঘোষ ‘রানা প্রতাপ’ নাটক লিখতে শুরু করেন। এই সময় শোনা গেল যে স্বনামখ্যাত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘রানা প্রতাপ’ নাটকটির মহড়া চলছে পুরোদমে যা মঞ্চস্থ হবে স্টার থিয়েটারে। গিরিশচন্দ্র ততদিনে তাঁর লেখা রানা প্রতাপ নাটকের দুটি মাত্র অংক লেখা শেষ করেছেন। এই দুটি অংক অধুলালুপ্ত অর্চনা মাসিক পত্রিকায় একসময় প্রকাশিত হয়েছিল। ‘সাহিত্য’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি বহুদিন ধরে গিরিশচন্দ্রকে সিরাজদ্দৌলা নাটক লেখবার জন্য অনুরোধ করছিলেন।
গিরিশচন্দ্র এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য ছিলেন। সোসাইটি থেকে সিরাজদৌলা সংক্রান্ত ইতিহাস বই সংগ্রহ করলেন এবং অন্যান্য স্থান থেকেও সংগ্রহ করলেন। ভালো করে সিরাজ চরিত্র অধ্যয়ন করলেন। রাশি রাশি বই পড়ার পর তিনি সিরাজদ্দৌলা নাটক লিখতে শুরু করলেন। সিরাজদৌল্লা শৈশব থেকে শুরু করে পূর্ণাঙ্গ জীবন তুলে ধরতে দুটি পঞ্চমাঙ্কের নাটক লেখা প্রয়োজন তাতে দর্শকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে বাধ্য। তাই গিরিশচন্দ্র একটি নাটকের মধ্যেই সিরাজের জীবনকে তুলে ধরলেন। প্রথম অংকে সিরাজের জীবনের প্রায় অর্ধেক ঘটনা তুলে ধরা হয়েছিল। অবশিষ্ট অংক গুলিতে ঐতিহাসিক চিত্রের সঙ্গে সঙ্গে সিরাজ চরিত্রের ক্রমবিকাশ ও তার মর্মান্তিক পরিনাম নিখুঁতভাবে তুলে ধরলেন গিরিশচন্দ্র।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫৩: বলিদান নাটকে গিরিশচন্দ্র অসামান্য অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন
এই দেশ এই মাটি, ত্রিপুরা: আজ কাল পরশুর গল্প, পর্ব-১: রাজমালা ও ইতিহাসের আলোকে ত্রিপুরা
সিরাজের স্বদেশ প্রীতি, তাঁর যৌবন সুলভ চাপল্য, অনুতাপ, সর্বোপরি তার গার্হস্থ্য জীবনের আনন্দময় চিত্র যেভাবে গিরিশচন্দ্র তুলে ধরেছেন, তা দেখলে অবাক লাগে। সিরাজউদ্দৌলা ঐতিহাসিক নাটক হলেও সেই নাটকীয় ঘটনার যথাযথ সংযোগ ও পরিপুষ্টির জন্য গিরিশচন্দ্র দুটি অনৈতিহাসিক চরিত্র সৃষ্টি করলেন। তার মধ্যে একটির নাম জোহরা, অপরটি করিম চাচা। কিন্তু চরিত্র দুটি নাটকের সঙ্গে এমন ভাবে মিলেমিশে গিয়েছিল যে তাদের কখনওই ইতিহাস বহির্ভূত চরিত্র বলে মনে হয়নি।
লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ দিয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে আপামর বাঙালি গর্জে উঠেছিলেন। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিবাদের সোচ্চার হয়েছিলেন। গিরিশচন্দ্র সিরাজদৌলা নাটক এক অর্থে প্রতিবাদেরই নাটক।
লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ দিয়েছিলেন। এর বিরুদ্ধে আপামর বাঙালি গর্জে উঠেছিলেন। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে প্রতিবাদের সোচ্চার হয়েছিলেন। গিরিশচন্দ্র সিরাজদৌলা নাটক এক অর্থে প্রতিবাদেরই নাটক।
আরও পড়ুন:
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-৫৮: কোন অজানায় ‘পথে হল দেরী’
দশভুজা, সরস্বতীর লীলাকমল, পর্ব-১৪: শোভনাসুন্দরী—ঠাকুরবাড়ির এক সরস্বতী!
সিরাজউদ্দৌলা নাটকের সর্বপ্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৩১২ সালের ২৪ ভাদ্র (ইংরেজিতে ১৯০৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর)। প্রথম অভিনয় রজনীতে অভিনয় করেছিলেন সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (সিরাজউদ্দৌলা), নীলমাধব চক্রবর্তী (মীরজাফর), গিরিশচন্দ্র ঘোষ (করিম চাচা ), কুমুদনাথ মুখোপাধ্যায় (মোহনলাল) সাতকড়ি গঙ্গোপাধ্যায় (জগৎ শেঠ), তারাসুন্দরী (জহুরা ), সুধীরা বালা (ঘসেটি বেগম) সুশীলা বালা (লুৎফুন্নিসা)। এই নাটকের সংগীত শিক্ষক ছিলেন দুজন শশীভূষণ বিশ্বাস ও তারাপদ রায়। নৃত্যশিক্ষক ছিলেন সাতকড়ি গঙ্গোপাধ্যায়। মেকাপের দায়িত্বে ছিলেন কালীচরণ দাস। এ নাটক থেকেই মিনার্ভা থিয়েটারের ম্যানেজার বলে গিরিশচন্দ্র ঘোষের নামেই বিজ্ঞাপিত হতো।
আরও পড়ুন:
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৮২: রবীন্দ্রনাথ সাহেব-শিক্ষকদের কাছেও পড়েছেন
আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-৩৬: সারদা মায়ের ছোটকাকা ও পুত্রপ্রতিম স্বামীজির জীবনাবসান
বলিদান নাটকের মত সিরাজউদ্দৌলা নাটকেও গিরিশচন্দ্র ও অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি শিল্পীদের অভিনয় শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। বড় বড় চরিত্রে যারা অভিনয় করছেন তারা প্রশিক্ষণ নিতেন গিরিশচন্দ্রের কাছে। ছোট চরিত্রে যারা অভিনয় করতেন তারা অর্ধেন্দু শেখার মুস্তাফির কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতেন। প্রতিটি চরিত্রের শিল্পী অভিনয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলা নাট্য জগতে যুগপ্রবর্তন করেছিল। এই নাটকের উচ্চ প্রশংসা ধ্বনিত হয়েছিল সারা বাংলার আকাশে বাতাসে। ভারত বিখ্যাত বালগঙ্গাধর তিলক কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে কলকাতা এসে এই নাটকের অভিনয় দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। নাটকের শেষে গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে তিলক এই নাটকের প্রশংসা করে যান। ইতিপূর্বে নানা কারণে মিনার্ভা থিয়েটার হাইকোর্টের থেকে নিলামে উঠে। গিরিশচন্দ্রের উৎসাহে মিনার্ভা কর্তৃপক্ষ ৫৯ হাজার ৪০০ টাকায় মিনার্ভা থিয়েটার কিনে নেন। সিরাজউদ্দৌলার মঞ্চ সাফল্যে অচিরেই বিপুল অর্থ রাশির পূরণ হয়ে যায়।
হিন্দু মুসলমান দর্শক দলে দলে এসে এ নাটক দেখছেন। উদ্দীপিত হচ্ছেন। স্বদেশপ্রেম উথলে উঠেছে। এইসব প্রত্যক্ষ করে ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালের ৮ই জানুয়ারি এই নাটক বাজেয়াপ্ত করেন। অভিনয় ও প্রচার বন্ধ করে দেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে নাটক হিসেবে সিরাজদ্দৌলা কতখানি সফল হতে পেরেছিল।—চলবে।
সিরাজউদ্দৌলা নাট্য জগতে যুগপ্রবর্তন করেছিল। এই নাটকের উচ্চ প্রশংসা ধ্বনিত হয়েছিল সারা বাংলার আকাশে বাতাসে। ভারত বিখ্যাত বালগঙ্গাধর তিলক কংগ্রেসের অধিবেশন উপলক্ষে কলকাতা এসে এই নাটকের অভিনয় দেখে অভিভূত হয়েছিলেন। নাটকের শেষে গিরিশচন্দ্রের সঙ্গে দেখা করে তিলক এই নাটকের প্রশংসা করে যান। ইতিপূর্বে নানা কারণে মিনার্ভা থিয়েটার হাইকোর্টের থেকে নিলামে উঠে। গিরিশচন্দ্রের উৎসাহে মিনার্ভা কর্তৃপক্ষ ৫৯ হাজার ৪০০ টাকায় মিনার্ভা থিয়েটার কিনে নেন। সিরাজউদ্দৌলার মঞ্চ সাফল্যে অচিরেই বিপুল অর্থ রাশির পূরণ হয়ে যায়।
হিন্দু মুসলমান দর্শক দলে দলে এসে এ নাটক দেখছেন। উদ্দীপিত হচ্ছেন। স্বদেশপ্রেম উথলে উঠেছে। এইসব প্রত্যক্ষ করে ইংরেজ সরকার ১৯১১ সালের ৮ই জানুয়ারি এই নাটক বাজেয়াপ্ত করেন। অভিনয় ও প্রচার বন্ধ করে দেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে নাটক হিসেবে সিরাজদ্দৌলা কতখানি সফল হতে পেরেছিল।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh–Actor –Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।