রবিবার ২ জুন, ২০২৪


ক্লাসিক থিয়েটারে গিরিশচন্দ্রের ‘সৎনাম’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৯০৪ সালের ৩০ এপ্রিল। প্রথম দিনের অভিনয় রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সুরেন্দ্রনাথ ঘোষ (আওরঙ্গজেব), নটোবর চৌধুরী (হামিদ খান), অমরেন্দ্রনাথ দত্ত (রনেন্দ্র), অনুকূলচন্দ্র বটব্যাল (চরণদাস), ইন্দ্রনাথ দে (পরশুরাম), অতীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য (রঘুরাম), কুসুমকুমারী (বৈষ্ণবী), পান্নারানি (সোহিনী), রানি (গুলসানা)। এই নাটকের সংগীত শিক্ষক হলেন দেবককণ্ঠ বাগচী ও শশীভূষণ বিশ্বাস। নৃত্য শিক্ষক নৃপেন্দ্রচন্দ্র বসু।
সম্রাট ঔআওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে সৎনামী সম্প্রদায়ের বিদ্রোহ অবলম্বন করে এই ঐতিহাসিক নাটকটি গিরিশচন্দ্র লিখেছিলেন। স্কটের ইতিহাস-সহ তিনি বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে তাঁর নাটকের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। ভগবানকে সৎনাম বলে ডাকার এই সম্প্রদায় সৎনামী নামে অভিহিত হতো। বৈষ্ণবী নামের জনৈকা রাজপুত রমণী হিন্দু জোয়ান অফ আর্ক এই বিদ্রোহের নেত্রী ছিলেন। এদের শৌর্যবীর্যে মুঘল বাহিনী পরাজিত হওয়ায় সম্রাট রণস্থলে এসে সুকৌশলে বিপক্ষ দলকে দমন করেন। আদিরসের প্রধান আশ্রয় এবং প্রধানত বীররসের অঙ্গীভূত।
আরও পড়ুন:

নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৫০: ভ্রান্তি নাটকে রঙ্গলালের ভূমিকায় গিরিশের অভিনয় মুগ্ধ করেছিল দর্শকদের

এই দেশ এই মাটি, অসমের আলো-অন্ধকার, পর্ব-৪: বরাকপারের কথা

গিরিশচন্দ্র এই নাটকে দেখিয়েছেন যে ন্যায়-অন্যায়, পাপ পুণ্য, নির্বাচারে দয়া-মায়া প্রেম মমতা এমনকি মুক্তি কামনা শূন্য হয়ে লক্ষ্য পথে অগ্রসর হতে না পারলে উচ্চ সংকল্প কখনোই সিদ্ধ হয় না। আরও প্রতিপন্ন করেছেন যে বিশ্বাস অসাধ্যসাধনে সমর্থ এবং রমণীর মোহিনী শক্তি অমোঘ।

এই নাটকের নায়ক চরিত্র সৃষ্টির বিশেষত্ব এই যে, কবি যেসব উচ্চগুণে নায়ককে ভূষিত করেছেন সেই সব উচ্চগুণই নরেন্দ্রের সর্বনাশের কারণ হয়েছে। নায়িকা গুলসানা চরিত্রে প্রেম ও প্রতিহিংসা এই দুই বিপরীতভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। গুলসানা গিরিশচন্দ্রের একটি অপূর্ব সৃষ্টি।
আরও পড়ুন:

দশভুজা, শক্তিরূপেন সংস্থিতা, পর্ব-৪: আকাশী ফুল

আলোকের ঝর্ণাধারায়, পর্ব-২৬: বৃন্দাবনে জননী সারদা

ফকিররাম এবং চরণদাস দু’ জনই সৎনামী সিদ্ধ পুরুষ। ফকিরাম দেশকে মুঘল শৃংখল থেকে মুক্ত করার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন এবং সম্ভবত এজন্যই তিনি পরিব্রাজক। চরণদাস তাঁর শিষ্য, দাস্য ভক্তি সিদ্ধ, গুরুগত প্রাণ।

গিরিশচন্দ্র যেসব রাজকীয় গুণে ভারত সম্রাটকে, শুধু ভারত সম্রাটকে কেন প্রধান প্রধান মোঘল নেতাদের ভূষিত করেছেন তা হিন্দুর আদর্শ স্থানীয়, অনুকরণযোগ্য একথা গিরিশচন্দ্র ভূমিকাতে বার বার ইঙ্গিত করেছে। অতি অশুভক্ষণে গিরিশচন্দ্র ‘সৎনাম’ নাটক লিখেছিলেন। এই নাটকটি হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্ব বিষয়ক।
আরও পড়ুন:

এগুলো কিন্তু ঠিক নয়, পর্ব-৫০: কুষ্টি বিচার, না কি রক্ত বিচার! জরুরি কোনটা?

হুঁকোমুখোর চিত্রকলা, পর্ব-২৫: সে ব্যাটা চড়ছে তেরো সেমি, তো পড়ছে চোদ্দো কিমি, ভাঙবে ঠ্যাং কি?

সুতরাং পরস্পর বিবাদমান বিরোধী সম্প্রদায়ের পরস্পরের প্রতি কটুক্তি প্রয়োগ নাটকে অপরিহার্য ছিল। গিরিশচন্দ্র ‘সৎনাম’ গ্রন্থের ভূমিকায় এ কথা দৃষ্টান্ত-সহ উল্লেখ করলেও, মুসলমান সম্প্রদায় বিশেষ রূপে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। থিয়েটারে কর্তৃপক্ষ ওই নাটকের চতুর্থ রজনীতে উত্তেজিত মুসলমানদের প্রীতির জন্য ‘সৎনাম’ নাটকের অভিনয় বন্ধ করে দিয়ে তার জায়গায় ‘ভ্রমর’ এবং ‘দোললীলা’ অভিনয় ঘোষণা করেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের জীবনে এ এক স্মরণীয় ঘটনাই বটে।—চলবে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।

Skip to content