ছবি : লেখক
পর্ব- ২
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী গিরিশচন্দ্র ঘোষ-এর নাট্যজীবনের পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক অভিনেতা ড. শঙ্কর ঘোষ।
হুগলির হরিপালের পাট উঠিয়ে রামলোচন ঘোষ কলকাতায় স্থায়ীভাবে বাগবাজারের বোসপাড়ায় বসত করলেন। রামলোচনের দুই পুত্র—রামরতন ও হরিশচন্দ্র। রামরতনের পাঁচ পুত্র। চতুর্থ পুত্র নীলকমল ঘোষ কলকাতায় সরকারি অফিসে বুককিপার পদে কাজ করতেন। নীলকমল একদিন বাড়ি ফিরে দেখলেন গিরি কাঁদছে। কেন কাঁদছে? না খিড়কির বাগানের শসাগাছের শসা খাবে বলে কাঁদছে। নীলকমলের বড়ভাই রামনারায়ণের স্ত্রীর তাতে আপত্তি। কারণ হিসেবে বলেছেন গৃহদেবতাকে দেবার পর সবাই ওই গাছের শসা খাবে। নীলকমলবাবু বললেন, ‘গিরি যার জন্য এত করে কাঁদছে, ঠাকুর কি তা তৃপ্তি সহকারে খাবেন?’ অবশেষে বাগানের শসা আনা হল এবং গিরির তেষ্টা মেটানো হল। এই গিরি হলেন গিরিশচন্দ্র। বাংলা নাট্যসাহিত্য ও নাট্যমঞ্চের জগতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্যক্তি গিরিশচন্দ্র ঘোষ। পিতা-মাতার অষ্টম গর্ভজাত সন্তান। জন্ম হল ১৮৪৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সোমবার, অষ্টমী তিথিতে। গিরিশচন্দ্র যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন বিদ্যাসাগরের বয়স ২৪, মধুসূদনের ২০, বঙ্কিমচন্দ্রের ৬ এবং দীনবন্ধু মিত্রের ১৪ বছর। এই সময় জন্মালেন গিরিশচন্দ্র। যেহেতু অষ্টম গর্ভজাত সন্তান তাই ঢাকঢোল বাজিয়ে এর খবর পাড়াতে জানানো হল। কিন্তু গিরিশচন্দ্র জন্মাবার পর মা রাইমণি সূচিকা রোগে আক্রান্ত হন। ফলে শিশু গিরিশকে দেওয়া হল পরিচারিকার কাছে পালনের জন্য। সেই মহিলার স্তন্যপান করে গিরিশ বড় হন। রাইমণি শেষ কন্যাসন্তান প্রসবের সময় অস্থির হয়ে মূর্ছা গিয়েছিলেন। একটি মৃত কন্যাসন্তান প্রসব করে নিজেও প্রাণত্যাগ করলেন। অপলক দৃষ্টিতে গিরিশচন্দ্র দেখছেন, উচ্চস্বরে কাঁদছেন, ‘মা মাগো এমন করে অনাথ করে গেলে কেন?’
ছোটবেলা থেকেই দেবদ্বিজে গিরিশের ভক্তি ছিল অপরিসীম। রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণের কাহিনি শোনার জন্য রাত্রে ঠাকুমাদের কাছে যেতেন। সে বর্ণনায় আছে অক্রূর এসেছেন বৃন্দাবনে কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন ব্রজবালাগণ রথের চাকার সামনে শুয়ে পড়লেন। ব্রজবালকগণ না যাবার জন্য কেঁদে আকুল হলেন। গাভিরা আহার ভুলে কৃষ্ণের দিকে নরম চোখে চেয়ে আছে। সেই বর্ণনা গিরিশচন্দ্রকে বেদনাপ্লুত করত। প্রশ্ন করতেন, ‘কৃষ্ণ কি আবার এলেন?’ উত্তর মিলত ‘না৷’ আবার প্রশ্ন করতেন, ‘আর আসবেন না?’ সেই একই উত্তর ‘না।’ কেঁদে ভাসাতেন গিরিশচন্দ্র। কৃষ্ণ কথকতার আসরে নিয়মিত হাজির থাকতেন। শুনতেন কৃষ্ণ কথকতার সব গান।
গিরিশচন্দ্রের পিতা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী, সংযত চরিত্র ও পরোপকারী ছিলেন। তাঁর বিষয়বুদ্ধি যেমন ছিল প্রখর তেমনি সন্তানদের জন্য স্নেহ ছিল অপরিমিত। গিরিশচন্দ্রের মা অত্যন্ত কোমলপ্রাণা, ধর্মপরায়ণা ছিলেন। গিরিশ বলতেন যে তিনি বাবার কাছ থেকে বিষয়বুদ্ধি আর মায়ের কাছ থেকে ভক্তি পেয়েছিলেন। নীলকমলবাবুর স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় বায়ু পরিবর্তনের কথা বললেন ডাক্তারবাবু। সেইমতো পুত্রদের নিয়ে নীলকমল নৌকায় ভ্রমণ করতে বেরিয়েছেন। এদিকে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। নৌকা তুফানের মতো দুলে উঠেছে। মাঝিরা তাল সামলাতে পারছে না। গিরিশ ভীত হয়ে বাবার হাতদুটো চেপে ধরেছেন। ঝড় কেটে যাওয়ার পর নীলকমলবাবু গিরিশকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই আমার হাত ধরে ছিলি কেন? আমার নিজের প্রাণ বড় না তোর? যদি নৌকা ডুবত যেমন করে পারি আগে আমি আমাকে বাঁচাতুম।’ গিরিশচন্দ্র বাকরুদ্ধ হয়ে পিতার কথা শুনছিলেন। পরে অবশ্য ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বিপদে হাত ধরার কেউ থাকে না। একমাত্র ভগবান ছাড়া হাত ধরার কেউ নেই।’ গিরিশচন্দ্রের যখন মাত্র ১৪ বছর বয়স তখন পিতা নীলকমল মারা যান। মাথার উপর থেকে সব হাত উঠে গেল। পিতার মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই বিধবা বোন কৃষ্ণকিশোরী গিরিশের বিয়ে দিলেন। পাত্রী প্রমোদিনী।
ছোটবেলায় নানান কারণে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথমে পড়তেন হেয়ার স্কুলে। পরে তিনি এলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। আর একেবারে শেষে পাইকপাড়া সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্রমাগত স্কুল পরিবর্তন এবং অনিয়মিত পড়াশোনার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তবে কিছুকাল বাড়িতে তিনি খুব মন দিয়ে বহু বই পাঠ করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
বাগবাজারে মাঝে মাঝে বড়লোকের বিশেষ করে শিক্ষিতদের আখড়াই সংগীতের আসর বসত। বসুপাড়ায় একদিন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হাফ আখড়াই-এর আসরে গান বাঁধবার জন্য এসেছিলেন। গুপ্তকবির প্রভাবে গিরিশচন্দ্র কবিতা ও গান রচনায় প্রবৃত্ত হলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার তিনি গ্রাহক হলেন। তাঁর চিকিৎসক মামা নবীনকৃষ্ণ বসু ইংরেজি সাহিত্য শিক্ষায় গিরিশচন্দ্রকে প্রভাবিত করেছিলেন। যৌবনে তিনি স্বেচ্ছাচারিতা উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। এরই মধ্যে একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দুর্গাপুজোর আগের দিন কে বা কারা দুর্গাপ্রতিমা এনে গিরিশচন্দ্রের বাড়ির উঠোনে রেখে যায়। কৃষ্ণকিশোরী চঞ্চল হয়ে উঠলেন। গিরিশ ঘুম থেকে উঠে এই দৃশ্য দেখে কালাপাহাড় মূর্তি ধারণ করে, একটা কুঠার নিয়ে সেই প্রতিমাকে ছিন্নভিন্ন করলেন। গিরিশচন্দ্র নিজের হাতে প্রতিমার ধ্বংসাবশেষ কাছের একটি আমগাছের গোড়ায় জড়ো করে রেখে গর্ত করে সেগুলো পুঁতে দিয়ে এলেন। মদ্যপ স্বেচ্ছাচারী জামাইয়ের ভাবগতিক দেখে গিরিশচন্দ্রর শ্বশুরমশাই অ্যাটকিনসন কোম্পানির বুককিপার নবীনচন্দ্র সরকার তাঁর অফিসে বুককিপারের কাজ শেখার জন্য গিরিশচন্দ্রকে সুযোগ করে দিলেন। কালে কালে তিনি বুককিপারের কাজেই বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। অফিসের হিসাবনিকাশের কাজ। শান্তি পেতেন পাড়ার বন্ধুরা মিলে যে ‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’ তৈরি করেছিলেন সেখানে রাত্রে এসে মহড়া দিতে।
ছোটবেলা থেকেই দেবদ্বিজে গিরিশের ভক্তি ছিল অপরিসীম। রামায়ণ, মহাভারত, শ্রীকৃষ্ণের কাহিনি শোনার জন্য রাত্রে ঠাকুমাদের কাছে যেতেন। সে বর্ণনায় আছে অক্রূর এসেছেন বৃন্দাবনে কৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখন ব্রজবালাগণ রথের চাকার সামনে শুয়ে পড়লেন। ব্রজবালকগণ না যাবার জন্য কেঁদে আকুল হলেন। গাভিরা আহার ভুলে কৃষ্ণের দিকে নরম চোখে চেয়ে আছে। সেই বর্ণনা গিরিশচন্দ্রকে বেদনাপ্লুত করত। প্রশ্ন করতেন, ‘কৃষ্ণ কি আবার এলেন?’ উত্তর মিলত ‘না৷’ আবার প্রশ্ন করতেন, ‘আর আসবেন না?’ সেই একই উত্তর ‘না।’ কেঁদে ভাসাতেন গিরিশচন্দ্র। কৃষ্ণ কথকতার আসরে নিয়মিত হাজির থাকতেন। শুনতেন কৃষ্ণ কথকতার সব গান।
গিরিশচন্দ্রের পিতা তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালী, সংযত চরিত্র ও পরোপকারী ছিলেন। তাঁর বিষয়বুদ্ধি যেমন ছিল প্রখর তেমনি সন্তানদের জন্য স্নেহ ছিল অপরিমিত। গিরিশচন্দ্রের মা অত্যন্ত কোমলপ্রাণা, ধর্মপরায়ণা ছিলেন। গিরিশ বলতেন যে তিনি বাবার কাছ থেকে বিষয়বুদ্ধি আর মায়ের কাছ থেকে ভক্তি পেয়েছিলেন। নীলকমলবাবুর স্বাস্থ্যের অবনতি হওয়ায় বায়ু পরিবর্তনের কথা বললেন ডাক্তারবাবু। সেইমতো পুত্রদের নিয়ে নীলকমল নৌকায় ভ্রমণ করতে বেরিয়েছেন। এদিকে প্রচণ্ড ঝড় উঠেছে। নৌকা তুফানের মতো দুলে উঠেছে। মাঝিরা তাল সামলাতে পারছে না। গিরিশ ভীত হয়ে বাবার হাতদুটো চেপে ধরেছেন। ঝড় কেটে যাওয়ার পর নীলকমলবাবু গিরিশকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুই আমার হাত ধরে ছিলি কেন? আমার নিজের প্রাণ বড় না তোর? যদি নৌকা ডুবত যেমন করে পারি আগে আমি আমাকে বাঁচাতুম।’ গিরিশচন্দ্র বাকরুদ্ধ হয়ে পিতার কথা শুনছিলেন। পরে অবশ্য ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘বিপদে হাত ধরার কেউ থাকে না। একমাত্র ভগবান ছাড়া হাত ধরার কেউ নেই।’ গিরিশচন্দ্রের যখন মাত্র ১৪ বছর বয়স তখন পিতা নীলকমল মারা যান। মাথার উপর থেকে সব হাত উঠে গেল। পিতার মৃত্যুর এক বছরের মধ্যেই বিধবা বোন কৃষ্ণকিশোরী গিরিশের বিয়ে দিলেন। পাত্রী প্রমোদিনী।
ছোটবেলায় নানান কারণে স্কুল পরিবর্তন করতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথমে পড়তেন হেয়ার স্কুলে। পরে তিনি এলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে। আর একেবারে শেষে পাইকপাড়া সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্রমাগত স্কুল পরিবর্তন এবং অনিয়মিত পড়াশোনার জন্য তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। তবে কিছুকাল বাড়িতে তিনি খুব মন দিয়ে বহু বই পাঠ করেছিলেন। ইংরেজি সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে প্রভূত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।
বাগবাজারে মাঝে মাঝে বড়লোকের বিশেষ করে শিক্ষিতদের আখড়াই সংগীতের আসর বসত। বসুপাড়ায় একদিন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত হাফ আখড়াই-এর আসরে গান বাঁধবার জন্য এসেছিলেন। গুপ্তকবির প্রভাবে গিরিশচন্দ্র কবিতা ও গান রচনায় প্রবৃত্ত হলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার তিনি গ্রাহক হলেন। তাঁর চিকিৎসক মামা নবীনকৃষ্ণ বসু ইংরেজি সাহিত্য শিক্ষায় গিরিশচন্দ্রকে প্রভাবিত করেছিলেন। যৌবনে তিনি স্বেচ্ছাচারিতা উচ্ছৃঙ্খলতার স্রোতে বেশ কিছুদিন কাটিয়েছিলেন। এরই মধ্যে একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। দুর্গাপুজোর আগের দিন কে বা কারা দুর্গাপ্রতিমা এনে গিরিশচন্দ্রের বাড়ির উঠোনে রেখে যায়। কৃষ্ণকিশোরী চঞ্চল হয়ে উঠলেন। গিরিশ ঘুম থেকে উঠে এই দৃশ্য দেখে কালাপাহাড় মূর্তি ধারণ করে, একটা কুঠার নিয়ে সেই প্রতিমাকে ছিন্নভিন্ন করলেন। গিরিশচন্দ্র নিজের হাতে প্রতিমার ধ্বংসাবশেষ কাছের একটি আমগাছের গোড়ায় জড়ো করে রেখে গর্ত করে সেগুলো পুঁতে দিয়ে এলেন। মদ্যপ স্বেচ্ছাচারী জামাইয়ের ভাবগতিক দেখে গিরিশচন্দ্রর শ্বশুরমশাই অ্যাটকিনসন কোম্পানির বুককিপার নবীনচন্দ্র সরকার তাঁর অফিসে বুককিপারের কাজ শেখার জন্য গিরিশচন্দ্রকে সুযোগ করে দিলেন। কালে কালে তিনি বুককিপারের কাজেই বিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। অফিসের হিসাবনিকাশের কাজ। শান্তি পেতেন পাড়ার বন্ধুরা মিলে যে ‘বাগবাজার অ্যামেচার থিয়েটার’ তৈরি করেছিলেন সেখানে রাত্রে এসে মহড়া দিতে।