যে গুর্মুখ রায়ের বদান্যতায় স্টার থিয়েটার গড়ে উঠেছিল, যে গুর্মুখের সঙ্গে নটী বিনোদিনীর একটা আলাদা সম্পর্ক গড়েছিল। সেই গুর্মুখ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে সামাজিক শাসনের কঠোরতায় থিয়েটার ছাড়তে দিতে বাধ্য হতে হয়। ইনি থিয়েটার বিক্রি করার সংকল্প করলে নটগুরু গিরিশচন্দ্র সম্প্রদায়ের নেতা হয়ে তাঁদের সংকট অবস্থার কথা বিশেষভাবে বোঝালে, গুর্মুখ বলেন— “আমি বিস্তর টাকা ব্যয়ে বাড়ি তৈরি করিয়াছি। আপনারা আমায় এগারো হাজার টাকা মাত্র দিন, আমি আপনাদের থিয়েটার ছাড়িয়া দিতেছি।” এই অপ্রত্যাশিত উত্তর পেয়ে স্বভাবতই গিরিশচন্দ্র অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। তিনি তাঁর নিকটজনদের সবাইকে বললেন, “যে টাকা দিতে পারিবে তাহাকেই থিয়েটারের মালিক করিয়া দিব। কে টাকা আনিবে বল।”
গিরিশচন্দ্রের সৎ পরামর্শে এবং উৎসাহ বাক্যে উৎসাহিত হয়ে অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু, দাশু চরণ নিয়োগী এঁরা কয়েক হাজার টাকা নিয়ে এলেন। অবশিষ্ট টাকা জোড়াসাঁকো নিবাসী সুপ্রসিদ্ধ হরিধন দত্ত মহাশয়ের ভাই কৃষ্ণধন বাবুর কাছ থেকে ঋণ হিসেবে গ্রহণ করা হল। হরিপ্রসাদবাবুর পরিচয় দেওয়া যাক। তাঁর বাগবাজারের চিৎপুর রোডের উপর একটা ডাক্তারখানা ছিল। গিরিশচন্দ্র থিয়েটার যাওয়ার সময় প্রায়ই তাঁর ডাক্তারখানায় এসে খানিকক্ষণ বসে গল্পগুজব করে যেতেন। হরিবাবুও গিরিশচন্দ্রকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন।
আরও পড়ুন:
নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে, পর্ব-৩১: ‘মহাশয় থিয়েটারে যদি ফুল ফুটাইতে চান গিরিশবাবুকে লইয়া আসুন’
বিশ্বসেরাদের প্রথম গোল, পর্ব-৯: ফেরেন্তস পুসকাস: দুটি দেশের হয়েই বিশ্বকাপ খেলেছেন
হেলদি ডায়েট: বেশি কলা খাওয়ার অভ্যাস কি স্বাস্থ্যকর? মারাত্মক কোনও রোগের কারণ হয়ে উঠবে না তো?
হরিপ্রসাদবাবু হিসেব-পত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। গিরিশবাবু তাঁর হিসেব রাখবার সুপ্রণালী এবং খাতাপত্রের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা দেখে বড়ই আনন্দ প্রকাশ করতেন। গুর্মুখ রায় থিয়েটার বাড়ি নির্মাণের সময়ে হিসাবপত্র রাখবার জন্য একজন সুনিপুণ কর্মচারীর প্রয়োজন হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র হরিপ্রসাদবাবুকে নিয়ে এসে উক্ত পদ প্রদান করেন। থিয়েটার বাড়িটি নির্মাণ হয়ে যাওয়ার পর হরিপ্রসাদবাবুকে এই থিয়েটারের কোষাধ্যক্ষের পদ দিলেন গিরিশচন্দ্র।
আরও পড়ুন:
দশভুজা: সেই ষোলো মিনিটের দূরত্ব কোনওদিন পূরণ হয়নি
অমরনাথের পথে, পর্ব-৫: অমরগঙ্গাকে ডানদিকে রেখে বরফঢাকা কঠিন পথে এগিয়ে চলি গুহার পথে
বাঙালির মৎস্যপুরাণ, পর্ব-৪৬: প্রাণী জগতের অন্যতম দায়িত্বশীল বাবা হল ড্রাগন ফিশ
নাট্যাচার্য অমৃতলাল বসু কার্যকুশল, বুদ্ধিমান এবং সুশিক্ষিত বলে থিয়েটারে তিনি গিরিশচন্দ্রের ডান হাত ছিলেন। গিরিশচন্দ্র এঁকে নিয়ে থিয়েটারের চারজন স্বত্বাধিকারী নির্বাচন করলেন এবং গুর্মুখ রায়ের টাকা শোধ করে দিয়ে থিয়েটারের স্বত্ব চারজনের নামে রেজিস্ট্রি করে নিলেন। নিজে একজন স্বত্বাধিকারী হতে পারতেন। কিন্তু নিজের ছোট ভাই অতুলকৃষ্ণের কাছে তিনি সত্যবদ্ধ হয়েছিলেন, যতদিন থিয়েটারের সংস্পর্শে থাকবেন থিয়েটারের স্বত্বাধিকারী হওয়ার কোনও চেষ্টা করবেন না। সেই প্রতিজ্ঞা কিন্তু গিরিশচন্দ্র কখনও ভোলেননি। তিনি এঁদেরকে স্বত্বাধিকারী করে যেমন ভাবে থিয়েটারের অধ্যক্ষ ছিলেন, নাটক রচনা করছিলেন, শিক্ষা দিচ্ছিলেন শিল্পীদের এবং আবশ্যকবোধে নিজে অভিনয় করছিলেন, সেই রকমই করতে লাগলেন। স্বত্বাধিকারী গণক গিরিশচন্দ্রের অধিনায়কত্বে নিজের নিজের কাজ সুষ্ঠু মতো করে যেতে লাগলেন।
আরও পড়ুন:
পঞ্চমে মেলোডি, পর্ব-২: ‘আও টুইস্ট করে’ গানের জন্য পঞ্চমের সঙ্গে শচীনকর্তার বাক্যালাপও বন্ধ ছিল বেশ কিছুদিন
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২৭: আপন হতে আপন জন ‘রাইকমল’
হোমিওপ্যাথি: আপনার কি ঋতুবন্ধ আসন্ন? সমস্যা এড়াতে মেনে চলুন এই নিয়মগুলি
এই সময় কলকাতা গড়ের মাঠে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী আরম্ভ হয়। এমন বিরাট ও মহাসমারোহের প্রদর্শনী কলকাতায় এ পর্যন্ত কখনও কেউ দেখেনি। ভারতের সব রাজারা, দেশীয় রাজারা, জমিদারগণ কলকাতায় এসে এই অনুষ্ঠান দেখতেন।
দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষের সমাগম হতে শুরু করল কলকাতা শহরে। চৌরঙ্গীর পথে লোক চলাচলের সুবিধার নিমিত্তে মিউজিয়াম হাউস থেকে গড়ের মাঠ পর্যন্ত একটি সুপ্রশস্ত সেতু নির্মিত হয়েছিল। শহরে এমন ভাবে লোকসমাগম দেখে স্টার থিয়েটার সম্প্রদায়ও প্রত্যেকদিন ‘নল দময়ন্তী’ অভিনয় চালাতে লাগলেন। বিক্রয় যথেষ্ট বাড়তে লাগল। ফলত এই প্রদর্শনী থেকে সম্প্রদায়ের ঋণ পরিষদের বিশেষ সুবিধা হয়েছিল। থিয়েটারে, একটি মাত্র রয়েল বক্স থাকত। এই সময় একদিন থিয়েটারে অনেক রাজা এসে হাজির হলেন। কর্তৃপক্ষগণ কী করবেন, বুঝতেই পারছিলেন না। রয়েল বক্সের পূর্ণ মূল্য দিয়ে সাধারণ বক্সে বসে সেই সমস্ত রাজ রাজারা আনন্দের সঙ্গে অভিনয় দেখে গেলেন। এ সব কৃতিত্বই ঘটেছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের জন্যই, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষের সমাগম হতে শুরু করল কলকাতা শহরে। চৌরঙ্গীর পথে লোক চলাচলের সুবিধার নিমিত্তে মিউজিয়াম হাউস থেকে গড়ের মাঠ পর্যন্ত একটি সুপ্রশস্ত সেতু নির্মিত হয়েছিল। শহরে এমন ভাবে লোকসমাগম দেখে স্টার থিয়েটার সম্প্রদায়ও প্রত্যেকদিন ‘নল দময়ন্তী’ অভিনয় চালাতে লাগলেন। বিক্রয় যথেষ্ট বাড়তে লাগল। ফলত এই প্রদর্শনী থেকে সম্প্রদায়ের ঋণ পরিষদের বিশেষ সুবিধা হয়েছিল। থিয়েটারে, একটি মাত্র রয়েল বক্স থাকত। এই সময় একদিন থিয়েটারে অনেক রাজা এসে হাজির হলেন। কর্তৃপক্ষগণ কী করবেন, বুঝতেই পারছিলেন না। রয়েল বক্সের পূর্ণ মূল্য দিয়ে সাধারণ বক্সে বসে সেই সমস্ত রাজ রাজারা আনন্দের সঙ্গে অভিনয় দেখে গেলেন। এ সব কৃতিত্বই ঘটেছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের জন্যই, তা নিঃসন্দেহে বলা চলে।
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।