গিরিশচন্দ্রের 'অভিমন্যুবধ'।
‘রাবণবধ’ এবং ‘সীতার বনবাস’ এই দুটি নাটকে আশাতীত সাফল্য লাভ করে ভক্ত ভৈরব গিরিশচন্দ্র এবার রামায়ণ ছেড়ে মহাভারত থেকে তাঁর নাটকের বিষয় নির্বাচন করলেন। সেই নাটকটির নাম ‘অভিমন্যুবধ’। এটি ন্যাশনাল থিয়েটারে প্রথম অভিনীত হয় ১২৮৮ সালের ১২ অগ্রহায়ণ (ইংরেজি তারিখ ১৮৮১ সালের ২৬ নভেম্বর)। প্রথম দিনের অভিনয় রজনীতে যাঁরা যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই দুটি করে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। যেমন গিরিশচন্দ্র ঘোষ যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন এই দুটি চরিত্রে অভিনয় করেন। কেদারনাথ চৌধুরী করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রোণাচার্যের চরিত্রে অমৃতলাল মিত্র ভীম ও গর্গের চরিত্রে। মহেন্দ্রলাল বসু অর্জুন ও জয়দ্রথের চরিত্রে। অঘোরনাথ পাঠক কর্ণ ও গণকের চরিত্রে। এছাড়া আলাদাভাবে অভিনয় করেছিলেন অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় অভিমন্যুর ভূমিকাতে। দুঃশাসনের চরিত্রে অভিনয় করলেন নীলমাধব চক্রবর্তী। গঙ্গা মনি অভিনয় করলেন সুভদ্রার চরিত্রে। বিনোদিনী অভিনয় করলেন উত্তরার চরিত্রে। কাদম্বিনী অভিনয় করলেন রোহিনীর চরিত্রে।
‘অভিমন্যুবধ’ নাটকের অভিনয় যেমন সর্বাঙ্গ সুন্দর হয়েছিল, নাট্যমোদীদের কাছেও তেমনি খুব আদরের বিষয় হয়ে উঠেছিল নাটকটি। বিশেষ করে অভিমন্যুর ভূমিকাতে অমৃতলাল মুখোপাধ্যায় অতি চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। গিরিশচন্দ্র যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন ভূমিকার পরস্পর বিরোধী দুটি বিভিন্ন ধরনের অভিনয় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুটি ছবি দেখিয়ে দর্শকদের মনের মধ্যে চিরস্থায়ী আসন পেতে নিয়েছিলেন। এই নাটকটির বিভিন্ন পত্রিকায় প্রশংসিত হয়েছিল।
আরও পড়ুন:
পর্ব-২৮: ‘সীতার বনবাস’ নাটকটি গিরিশচন্দ্র পূণ্যশ্লোক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে উৎসর্গ করেছিলেন
গল্পকথায় ঠাকুরবাড়ি, পর্ব-৫০: লুকোনো বই পড়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ বাক্সের চাবি চুরি করেছিলেন
অভিমুন্য বিশ্ববিজয়ী অর্জুন ও বীরাঙ্গনা সুভদ্রার সন্তান। তার তেজস্বীতা তো থাকবেই অথচ অভিমন্যুর কথা মনে এলে সূর্যের কথা মনে আসে না, কারণ সূর্য বললে কেবল প্রখর তীব্র তেজোরাশির সমষ্টি বোঝায় কিন্তু অভিমন্যুর সঙ্গে কেমন একটি সুকুমার সুন্দর যুবকের ভাব ঘনিষ্ঠভাবে সংযোজিত আছে, যে তার জন্য মনে পড়লে চন্দ্রের কথাই মনে হওয়া উচিত। কিন্তু সেটিও হতে পারে না। কারণ, চন্দ্রের তেজস্বিতা কিছু নেই। সেই জন্য অভিমন্যু আমরা চন্দ্র এবং সূর্যের মিশ্রিত একটি অপরূপ সামগ্রী বলেই মনে করি। গিরিশচন্দ্র তাঁর এই নাটকটিতে যেখানে অভিমন্যুকে দেখিয়েছেন কি উত্তরার সঙ্গে প্রেমালাপে, কি সুভদ্রার সঙ্গে স্নেহ বিনিময়ে, কি সপ্তরথীর দুর্ভেদ্য ব্যূহমধ্যে বীরকার্য সাধনে; সকল স্থানে এই নাটকের অভিমন্যু প্রকৃত অভিমন্যু হয়ে উঠতে পেরেছেন।
আরও পড়ুন:
হেলদি ডায়েট: গাল জুড়ে এক রাশ ব্রণ? সমাধান লুকিয়ে আছে এ সবের মধ্যে, কী ভাবে কাজে লাগাবেন ঘরোয়া টোটকা?
স্বাদে-আহ্লাদে: শীতে পছন্দের তালিকায় রয়েছে লাড্ডু? মিষ্টিমুখ হয়ে যাক গাজরের লাড্ডু দিয়েই
বলতে গেলে মহাভারতের সকল ব্যক্তিরা এই গিরিশচন্দ্রের হাতে কষ্টকর মৃত্যুতে, জীবন না ফুরালেও অপঘাত মৃত্যুতে প্রাণ ত্যাগ করেননি। ব্যাসদেবের কথা অনুসারে যাঁর যখন মৃত্যু আবশ্যক গিরিশচন্দ্র ঘোষ সেটাই করেছেন। মাইকেল যেমন অকারণের লক্ষণকে অসময়ে মেঘনাদের সঙ্গে যুদ্ধে মেরেছেন অথচ প্রকৃত প্রস্তাবে লক্ষণের ধ্বংস সাধন করেছেন, গিরিশচন্দ্র কিন্তু অভিমন্যুকে, কি অর্জুনকে, কি কৃষ্ণকে, কোথাও সেভাবে হত্যা করেননি। এটাই গিরিশচন্দ্রের বিশেষ গৌরব তবে এর মধ্যে ত্রুটিও আছে।
গিরিশচন্দ্র ও বিনোদিনী।
এই নাটকে রাক্ষস রাক্ষসীদের কথাগুলিতে ‘বেণীসংহার’ নাটকের কথা আমাদের বিশেষ করে মনে পড়ে। কিন্তু তা মনে পড়লেও, আমরা এ কথা বলতে কখনওই সংকুচিত হই না যে গিরিশচন্দ্র একজন প্রকৃত কবি একজন প্রকৃত ভাবুক ছিলেন।
অভিমন্যুবধ বীররস প্রধান নাটক হওয়াতে সীতার বনবাস এর মতো আবাল বৃদ্ধ বণিতার প্রিয় নাটক হয়ে উঠতে পারেনি। সুচতুর প্রতাপচন্দ্র জহুরি মহিলা মহলে লব কুশের সমধিক আকর্ষণ বুঝে গিরিশচন্দ্রকে বলেছিলেন, ”বাবু যব দুসরা কিতাব লিখোগে তব ফিন ওহি দোনো লেড়কা ছোড় দেও।”
অভিমন্যুবধ বীররস প্রধান নাটক হওয়াতে সীতার বনবাস এর মতো আবাল বৃদ্ধ বণিতার প্রিয় নাটক হয়ে উঠতে পারেনি। সুচতুর প্রতাপচন্দ্র জহুরি মহিলা মহলে লব কুশের সমধিক আকর্ষণ বুঝে গিরিশচন্দ্রকে বলেছিলেন, ”বাবু যব দুসরা কিতাব লিখোগে তব ফিন ওহি দোনো লেড়কা ছোড় দেও।”
আরও পড়ুন:
জ্যোতির্লিঙ্গ যাত্রাপথে, পর্ব-৩: বাবা বিশ্বনাথের দরবারে
উত্তম কথাচিত্র, পর্ব-২২: স্বপ্নের সারথি পাঠিয়েছেন ‘বকুল’ ফুল
প্রতাপচাঁদের অনুরোধে গিরিশচন্দ্র আবার লব কুশের অবতারণার জন্য এরপরে ‘লক্ষণ বর্জন’ নাটক লিখলেন। ‘অভিমন্যুবধ’ নাটকটি তিনি হাইকোর্টের বিচারপতি রমেশচন্দ্র মিত্র মশাইকে উৎসর্গ করেছিলেন।
উৎসর্গ পত্রে গিরিশচন্দ্র লিখছেন, ‘‘পরম শ্রদ্ধাস্পদ অনারেবল শ্রীযুক্ত রমেশ চন্দ্র মিত্র মহাশয় বহুমাননিধানেষু, যিনি স্বয়ং উৎকর্ষ লাভ ও মাতৃভূমির মুখোজ্জ্বল করেন, তিনি সংসারে আদর্শ। মহোদয় আমার ক্ষুদ্র উপহার গ্রহণ করুন; ভক্তির সহিত অর্পণ করিলাম।
ইতি
বিনয়াবনত শ্রীগিরিশচন্দ্র ঘোষ।”
উৎসর্গ পত্রে গিরিশচন্দ্র লিখছেন, ‘‘পরম শ্রদ্ধাস্পদ অনারেবল শ্রীযুক্ত রমেশ চন্দ্র মিত্র মহাশয় বহুমাননিধানেষু, যিনি স্বয়ং উৎকর্ষ লাভ ও মাতৃভূমির মুখোজ্জ্বল করেন, তিনি সংসারে আদর্শ। মহোদয় আমার ক্ষুদ্র উপহার গ্রহণ করুন; ভক্তির সহিত অর্পণ করিলাম।
ইতি
বিনয়াবনত শ্রীগিরিশচন্দ্র ঘোষ।”
* নাট্যকার গিরিশচন্দ্রের সন্ধানে (Girish Chandra Ghosh – Actor – Theatre) : ড. শঙ্কর ঘোষ (Shankar Ghosh) বিশিষ্ট অধ্যাপক ও অভিনেতা।