শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


গিরিশচন্দ্রের সামাজিক নাটকগুলি উনিশ শতকের শেষ দশক এবং বিশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যেই লেখা হয়েছিল। কলকাতার সমাজ অর্থাৎ উত্তর কলকাতা সমাজটাই উঠে এসেছে তাঁর নাটকে। শিক্ষা-সংস্কৃতি আমোদ-প্রমোদ সবকিছুর প্রাণকেন্দ্র ছিল উত্তর কলকাতা। আবার বেকার, মাতাল, দালাল, বেশ্যা, কাপ্তেনদের বসবাস ছিল এই কলকাতায়। গিরিশচন্দ্রের যে সময়ের চিত্রটা তুলে ধরেছেন তখন একান্নবর্তী পরিবার প্রথা সম্পূর্ণ অটুট ছিল। এই পিতৃপ্রধান পরিবারে পিতা ছিলেন কেন্দ্রীয় নিয়ামক শক্তি। তিনি সকলকে রক্ষা করতেন, পালন করতেন এবং প্রয়োজন হলে শাসন করতেন। গিরিশচন্দ্র নাটকে দেখা যায় প্রত্যেকটি দুঃখজনক ঘটনা সবচেয়ে আঘাত করেছে পরিবারের কর্তাকে। আঘাতের পর আঘাতে তিনি বিপর্যস্ত বিধ্বস্ত অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছেন।
গিরিশচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামাজিক নাটক ‘বলিদান’। এই নাটকে গিরিশচন্দ্র সমাজের প্রতি বাস্তব ও বেদনাদায়ক সমস্যার অবতারণা করেছেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে কন্যাদানের প্রকৃত অর্থে বলিদান। সেটাই নাট্যকার এই নাটকে দেখাতে চেয়েছেন। সামাজিক উদ্দেশ্য সিদ্ধি ছাড়া নাট্যরস সৃষ্টিতেও নাট্যকার এ নাটকে বিশেষ সাফল্য লাভ করেছেন। চরিত্রগুলি তাঁর নিজের চোখে দেখা প্রত্যক্ষ বাস্তব চরিত্র। এ নাটকে মন্দ চরিত্রের আধিক্য। অজগরের মতো আগ্রাসী রূপচাঁদ ঘোষ। মেকি ও মর্কট মোহিত মোহন সেন। বিকৃত স্বভাব দুলালচাঁদ। শাশুড়িকুলের তিন খান্ডারিণী মাতঙ্গিনী রাজলক্ষ্মী ও যশোমতী। মূল চরিত্র করুণাময় মধ্যবিত্ত সমাজের পরিবার পিতা-বৃহত বনস্পতি। শাখা-প্রশাখার বিস্তার করে সকলকে আশ্রয় দিচ্ছে কিন্তু ভিতরে ভিতরে নিরন্তর ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে। অনিবার্য পরিণতিতে একদিন সমূলে উৎপাটিত। এই সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন গিরিশ পরপর চমকপ্রদ পরিস্থিতি এবং চরিত্রের যথাযথ ভাষা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে।
আরও পড়ুন:

উদ্ধার নগদ ৬০ লক্ষ টাকা, হালিশহর পুরসভার চেয়ারম্যান চিটফান্ড মামলায় গ্রেফতার

ঘরের মেঝে মনের মতো পরিষ্কার হচ্ছে না? চিন্তা নেই, বাসন মাজার সাবানেই আছে জাদু! কীভাবে? রইল টিপস

‘বলিদান’ নাটকটি প্রথম অভিনীত হয় মিনার্ভা থিয়েটার তেরোশো এগারো সালের ২২শে চৈত্র (ইংরেজির ১৯১১)। গিরিশচন্দ্র অভিনয় করেছিলেন করুণাময়ের চরিত্রে। রূপচাঁদের ভূমিকায় অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি। দুলালচাঁদের চরিত্রে দানীবাবু। সরস্বতীর চরিত্রে তারাসুন্দরী, যশোমতীর চরিত্রে সরোজিনী, কিরণ্ময়ীর চরিত্রে কিরণবালা প্রথম দিনে মিনার্ভায় বলিদান নাটকে অভিনয় করেছিলেন।
গিরিশচন্দ্রের নাটকে গানের ব্যবহার লক্ষ্য করার মতো। সঙ্গীত বিহীন নাটক তিনি কল্পানাই করতে পারতেন না। এ নাটকের অধিকাংশ গান রয়েছে জোবির গলাতে। জোবি পথে পথে ঘুরে বেড়ায়, গান তার চিরসঙ্গী। তার মুখের গানগুলি হল ‘বিলিয়ে দিছিস পেটের মেয়ে’, ‘খা লো কনে আফিং কিনে’, ‘সরে পড় হতচ্ছাড়ী’ প্রভৃতি। বলিদান নাটকের সংলাপ বিভিন্ন শ্রেণির চরিত্র অনুযায়ী বিশিষ্টতা লাভ করেছে বলা যায়।
আরও পড়ুন:

পর্ব-২৮: অনুপুষ্টিতে ভরপুর পুঁটিমাছ ছোটদের দৃষ্টিশক্তির বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

অবনীন্দ্রনাথ‌: শিশুসাহিত্যের মুকুটহীন সম্রাট

প্রসঙ্গত বলা যায় এই নাটকে অভিনয় করেই গিরিশচন্দ্র রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। শেষ অভিনয় মিনার্ভা থিয়েটারে করুণাময়ের ভূমিকায়। সেদিন ছিল দুর্যোগের রাত। মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছিল। নাটকে করুণাময়কে অনেক সময় খালি গায়ে অভিনয় করতে হয়েছিল। সে রাত্রিতে ঠান্ডা বাতাস লেগে অসুস্হ হয়ে পড়েন। অসুস্হতা কাটেনি। এর কয়েক দিনের মধ্যে মৃত্যু এসে তাঁকে গ্রাস করে। কেউ কেউ মনে করেন করুণাময়ের চরিত্রে গিরিশচন্দ্রের অভিনয় তাঁর শিল্পী জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। পরে এ নাটকে বিভিন্ন সময়ে করুণাময়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, শিশিরকুমার ভাদুড়ি প্রমুখ শিল্পী। তবু গিরিশচন্দ্রের করুণাময়ের কোনও তুলনা নেই।

Skip to content