শুক্রবার ২২ নভেম্বর, ২০২৪


অমৃতলাল বসু ও নটী বিনোদিনী

গিরিশচন্দ্রের ভক্তিমূলক পৌরাণিক নাটক ‘শ্রীবৎস চিন্তা’ বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন শনিবার প্রথম অভিনীত হয়েছিল। প্রথম দিনের অভিনয় রজনীতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন সেই তালিকাটা একবার দেখে নেওয়া যাক। শ্রীবৎস রাজার চরিত্রে অমৃতলাল মিত্র, বাতুলের চরিত্রে অমৃতলাল বসু, চিন্তার চরিত্রে নটী বিনোদিনী, লক্ষ্মীদেবীর চরিত্রে গঙ্গামণি অভিনয় করেছিলেন। এই সব চরিত্রসমূহ ব্যাসদেব রচিত মহাভারতের উপাখ্যানটি নেই। কিন্তু যখন বাংলায় কাশীরাম দাস মহাভারতের রূপান্তর করলেন তখন কিন্তু তিনি এই বনপর্বের মধ্যে শ্রীবৎস চিন্তার কাহিনিকে সন্নিবিষ্ট করেছিলেন। গিরিশচন্দ্রের ‘শ্রীবৎস চিন্তা’ চারটি অঙ্কবিশিষ্ট ভক্তি রসাত্মক বা ভক্তিমূলক পৌরাণিক নাটক। শ্রীবৎস, চিন্তা, লক্ষ্মীদেবী, শনিদেব, ভদ্রা প্রভৃতি প্রধান চরিত্রচিত্রণে কাশীরাম দাসের মহাভারতকে গিরিশচন্দ্র বিশ্বস্ততার সঙ্গে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু নাটকের অন্যতম চরিত্র বাতুল এর ব্যতিক্রম হয়ে রয়েছে। এটি নাট্যকারের অতুলনীয় সৃষ্টি। পূর্ববর্তী ‘ধ্রুব চরিত্র’ এবং ‘কমলে কামিনী’ নাটকের সিংহলরাজ শালিবাহনের সভাসদ চরিত্রের এক স্মরণীয় রূপান্তর। ধ্রুব চরিত্রের বিদূষকের মতো পেটুক এবং রাজার যেকোনও কাজের সমর্থক হয়ে রয়েছে এমনটিই আমরা দেখতে পাচ্ছি। বাতুল চরিত্রটি গিরিশচন্দ্র সৃষ্ট সম্পূর্ণ কাল্পনিক চরিত্র অথচ নাটকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ভূমিকা পালন করেছে কিন্তু এই বাতুল।

শ্রীবৎস চিন্তা নাটকের শেষ দিকে কাহিনি বিন্যাসের কাশীরাম দাসের মহাভারত এর চেয়ে উনিশ শতকে বাঙালি সমাজে বহুল প্রচারিত প্রচলিত বিদ্যাসুন্দর যাত্রাপালা কাহিনিকে স্মরণ করিয়ে দেয় এবং এটাও নিঃসন্দেহে বলা চলে যে নল দময়ন্তী নাটকের মতো শ্রীবৎস চিন্তা নাটকটির কাহিনিও কিন্তু মিলনাত্মক। শ্রীবৎস চিন্তার নাটকের সুরকার এবং সংগীত শিক্ষক ছিলেন সংগীতাচার্য বেণীমাধব অধিকারী ওরফে বেণী ওস্তাদ। অন্যান্য নাটকগুলির মতো এই নাটকটিতে বেণীমাধব অধিকারী বিভিন্ন রাগ ও তাল সহযোগে গানগুলিতে সুর করেছিলেন। বিখ্যাত গানগুলির মধ্যে রয়েছে; আদরের রাখিলে ঘরে, কলঙ্ক হেরে চাঁদে প্রাণ আমার সদাই কাঁদে, ডাকলে আমি রইতে নারি, দেখি আসবো ফিরে, আমি রয়েছি সাথে চলো কানন পথে, মন বোঝে না মনের কথা, কমল বড় ভালোবাসি তাই তো বলে কমলিনী প্রভৃতি গান। শ্রীবৎস চিন্তার গানগুলিকে এই নাটকের সম্পদ বলা যেতে পারে। এতে লক্ষ্মীদেবীর গানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সেখানে প্রতিভাময়ী গায়িকা-অভিনেত্রী গঙ্গামণি এই ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন এবং তিনি তাঁর মুখের গানগুলো সব নিজেই গেয়েছিলেন। এছাড়া নায়িকার চরিত্রে বিনোদিনী এবং বাহুরাজকন্যা ভদ্রাবতী চরিত্রে ভূষণকুমারী অবশিষ্ট গানগুলি গেয়েছিলেন।

গিরিশচন্দ্রের বাড়ি

ঠিক আগের নাটক ‘নল দময়ন্তী’র মতোই ‘শ্রীবৎস চিন্তা’র মধ্যে একটা সাযুজ্য রয়েছে। তবে বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটার শ্রীবৎস চিন্তা কিন্তু তেমন সফল নাটক হতে পারেনি। তবে নাটকটিতে অভিনয় ক্ষেত্রে সকলেই নিজ নিজ অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তবে বাতুল চরিত্রাভিনয়ে অমৃতলাল বসু এবং লক্ষ্মীদেবীর চরিত্রে গঙ্গামণি সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন। বিডন স্ট্রিটের স্টার থিয়েটারে শ্রীবৎস চিন্তা নাটকটি না চললেও আঠারো বছর পরে মিনার্ভা থিয়েটারে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯০২ সালে যখন এই ‘শ্রীবৎস চিন্তা’ পুনরাভিনীত হল তখন এই নাটকটি সকলের মনকে জয় করেছিল। সেই সময় সুধাকণ্ঠী গায়িকা-অভিনেত্রী সুশীলাবালা লক্ষ্মীদেবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গানে অভিনয়ে সবাইকে মাতিয়ে দিয়েছিলেন।

ছবি: লেখক

Skip to content